শাড়ি
বানান বিশ্লেষণ:
শ্+আ+ড়্+ই।
উচ্চারণ:
ʃa.ɽi
(শা.ড়ি)
শা.ড়ি [শা এবং ড়ি ধ্বনি দুটি একাক্ষর সৃষ্টি করে]
শব্দ-উৎস:
সংস্কৃত শাটী (शाटी)>প্রাকৃত
সাডী, সাড়ী>বাংলা শাড়ি।
পদ:
বিশেষ্য
ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা
{
নারীর অখণ্ড পোশাক |
নারীর পরিচ্ছদ |
পরিচ্ছদ |
আবরক
|
মানবসৃষ্টি |
সমগ্র |
দৈহিক লক্ষ্যবস্তু
|
দৈহিক সত্তা
|
সত্তা
|}}
অর্থ:
ভারত উপমহাদেশের নারীর পরিধেয় অখণ্ড দীর্ঘ
বস্ত্র বিশেষ।
ইংরেজি: sari, saree
সূত্র:
বঙ্গীয় শব্দকোষ (প্রথম খণ্ড)। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সাহিত্য অকাদেমী। ২০০১।
বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান। মার্চ ২০০৫।
বাঙ্গালা ভাষার অভিধান (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড)। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস। সাহিত্য সংসদ। নভেম্বর ২০০০।
বাঙ্গালা শব্দকোষ। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি। ভূর্জপত্র। দোলযাত্রা ১৩৯৭।
সরল বাঙ্গালা অভিধান। সুবলচন্দ্র মিত্র।
wordnet 2.1
বিস্তারিত
ভারত উপমহাদেশের নারীর পরিধেয় অখণ্ড
দীর্ঘ বস্ত্র বিশেষ। শাড়ি বাঙালির জাতীয় এবং ঐতিহ্যবাহী পোশাক। প্রাচীনকাল থেকে
শাড়ির প্রকৃতি এবং পরিধান-শৈলীতে নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। পাহাড়পুরের পাল আমলের কিছু ভাস্কর্যে
শাড়ি পরিহিতা নারী দেখা যায়। এই সূত্রে ধারণা করা হয়, অষ্টম শতাব্দীতে শাড়ি পরার
চল ছিল।
প্রাচীন ভারতে সেলাই করা কাপড় পরাটা শাস্ত্রীয় রীতির পরিপন্থি ছিল।
এই কারণে পুরুষরা সেলাইবিহীন অখণ্ড কাপড় পররিধান করতো। এই সূত্রে পুরুষের পোশাক ‘ধুতি’
এবং মেয়েদের বেলায় তা ‘শাড়ি’র প্রচলন ঘটেছিল। প্রাচীন মিশর, রোম, গ্রিস দেশেও সেলাইবিহীন
পোশাক পরার চল ছিল। প্রাচীন সভ্যতায় সুচারুরূপে সেলাই করার জ্ঞান মানুষের ছিল না।
পরে সেলাই করার প্রক্রিয়াটি জানার পর, ভারতবর্ষের বাইরে মানুষ সেলাই করার কাপড় পরতে
শেখে। প্রাচীন ভারতে সেলাইবিহীন কাপড় পরাটা শাস্ত্র সম্মত হওয়ার কারণে, ধূতি ও শাড়ি
থেকেই গিয়েছিল।
প্রাচীন বাংলায় মেয়েরা শাড়ির নিচে পেটিকোট, ব্লাউজ ইত্যাদি পরতো না। বাংলাদেশের
মানুষ শীতকালে অখণ্ড কাপড়ে তৈরি চাদর পরতো। গ্রীষ্মপ্রধান বাংলাদেশে
ধূতি নিম্নাঙ্গে থাকলেও, মেয়েরা কোমড় থেকে পেঁচিয়ে স্তন আবরিত করে শাড়ি পড়তো।
পুরুষরা ধূতি পরিধানে নিম্নাঙ্গে কাছা দিত। মেয়েরা কাছার পরিবর্তে নিম্নাঙ্গকে
একালের লুঙ্গির মতো করে আবৃত করে রাখতো। মেয়েরা উর্ধাঙ্গের কাপড়ের বাড়তি অংশ
রাখতো। এই বাড়তি অংশ দিয়ে, এরা নিত্য গৃহকর্মে, হাত-মুখ মোছা জন্য গামছার মতো
ব্যবহার করতো। কালক্রমে এই বাড়তি অংশ আঁচলে পরিণত হয়ে। কোমড়ের কাছে শাড়িকে গিঠ
দিয়ে আটকে, পরে এর বর্ধিত অংশ প্রথমে ডানে, পরে বাঁয়ে লম্বা ভাঁজ দিয়ে জড়িয়ে
টেনে এনে ডান হাতের নিচ দিয়ে আলগা করে বাঁ কাঁধের উপর আঁচলের সামান্য অংশ রাখার চল
ছিল। শাড়ি পরার এই ধরণটি ‘এক প্যাঁচ’-এ শাড়ি বলা হতো। সংসারের কাজের সুবিধা,
প্রয়োজনে ঢিলা আঁচল কোমরে জড়িয়ে নেওয়া, সন্তান লালনে-পালনে ও শীত-বর্ষায় লম্বা
আঁচল বিশেষ সুবিধা দিত।
ব্রিটিশ শাসনামলে কুঁচি দিয়ে
শাড়ি পড়ার রীতি চালু হয়। শুরুর দিকে কুচি পদ্ধতির শাড়ি পরাকে অনেকে খ্রিষ্টানি, ব্রাহ্মী-চল
বলতো। কুচি পদ্ধতির শাড়িকে নান্দনিক করেন, রবীন্দ্রনাথের বৌদি জ্ঞানদানন্দিনী। এই
পদ্ধতি প্রথম চালুও ঠাকুরবাড়ির। কালক্রমে তা সমগ্র বঙ্গদেশে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে
গ্রামবাংলায় নিম্নস্তরের মেয়েরা এক পেচের শাড়ি এখনও পড়ে থাকেন। বয়ষ্কা মহিলাদের
অনেকে ফ্যাসান পরিহার করার জন্য এই রীতির শাড়ি পরেন। তবে একালের সকল আধুনিক
মহিলারাই কুঁচি-পদ্ধতির শাড়ি পরে থাকেন।
‘কুচি’ দিয়ে শাড়ির পরার প্রথম চল হয়েছিল অবাঙালি মেয়েমহলে। ঘাগরার ঘেরাও কুচির
দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মেয়েরা শাড়িতে কুচি দেওয়া শুরু করেছিল।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত শাড়ির কুচির অনেকটাই
সাদামাটা। ক্রমে ক্রমে শাড়ির
কুচির অংশ বাড়তে থাকে। অল্পকুচিতে শাড়ি পরা হতো ঢিলেঢালা ভাবে। কুচির সংখ্যা বাড়ার
কারণে শাড়ি গায়ের সঙ্গে টেনে পরা শুরু হয়েছিল। ফলে কোমর, বুক, পাছা বরাবর শাড়িতে টান
টান দশায় পৌঁছায়।
আধুনিক কালে ‘কুচি পদ্ধতি’তে
শাড়িকে কোমরে পেঁচিয়ে, শাড়ির সামনের অংশে কুচি পেটের উপর (নাভি বরাবর বা নাভির
নিচে) পেটিকোটের ভিতরে গুঁজে দেন। এর বর্ধিত অংশ সামনের দিকে এনে তা লতিয়ে স্তনকে
আবৃত করে ঘিরে ছন্দোময়
ভঙ্গিতে উপরে তুলে বাঁ কাঁধের উপর ফেলেন। কাঁধের পিছনে এই অংশ আঁচল হিসেবে ঝুলে
থাকে। আঁচল কখনো মাথাকে ঘিরে ঘোমটার জন্য ব্যবহার করা হয়।
খ্রিষ্টাব্দ-পূর্ব কাল বঙ্গদেশে বস্ত্রশিল্পের বুনিয়াদ গড়ে ওঠেছিল। বিশেষ করে ঢাকা,
কাপাসিয়া, সোনারগাঁও, দিনাজপুর, পাবনা, বগুড়া, রাজশাহী, নোয়াখালী, কুষ্টিয়া, খুলনা,
কুমিল্লা বস্ত্রশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। সোনারগাঁয়ে মসলিন জগদ্বিখ্যাত ছিল।
পাবনার সাদুল্লাপুর, নিশ্চিন্তপুর, আমিনপুর অঞ্চলে বিখ্যাত ‘পাবনাই পাড়’ কাপড়
তৈরি হতো। বাংলাদেশের জামদানির খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। সুতিবস্ত্রের মতোই বিখ্যাত
হয়েছিল বাংলার রেশমি বস্ত্রও।
বাংলাদেশে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত সব পরিবারের মহিলারা শাড়ি পরেন।
তবে তাদের শাড়ি পরার ধরন এবং শাড়ির মানের মধ্যে ব্যবধান অনেক। বিষয়টি পরিবারের
আর্থিক সঙ্গতি, সামাজিক প্রতিপত্তি এবং ব্যক্তিগত রুচিবোধের ওপর নির্ভর করে। বাজারে
এখন হরেক রকমের শাড়ির আবির্ভাব ঘটেছে, যেমন বেনারসি, জামদানি, সিল্ক, তাঁতের
শাড়ি, মিলের শাড়ি, সুতি শাড়ি, জর্জেট, শিফন, টাঙ্গাইল শাড়ি, পাবনার শাড়ি,
ঢাকাই শাড়ি, বিভিন্ন নামের প্রিন্ট শাড়ি ইত্যাদি। এছাড়া রয়েছে বাটিক, বুটিক,
টাই-ডাই, ব্লক-প্রিন্ট, ফেব্রিক, নকশি কাঁথাসহ হাজারো রকম শাড়ি। এর মধ্যে সাধারণ
ব্যবহার্য শাড়িগুলি হয় সুতির।
আজকাল বাংলাদেশের মেয়েরা শাড়ি ছাড়াও সালোয়ার-কামিজ, ম্যাক্সি ইত্যাদি পোশাক
পরে। তবে অনুষ্ঠানাদিতে প্রায় সব পরিবারের মেয়েরাই শাড়ি পরে।
তবে
বাংলাদেশে বিয়ে, বৌভাত, মেহেদি অনুষ্ঠান, গায়ে হলুদ ইত্যাদি অনুষ্ঠানে শাড়িই
প্রধান পোশাক। বিয়ে এবং বৌভাত অনুষ্ঠানে বিয়ের কনেকে সাজানোর জন্য উজ্জ্বল রঙের বেনারসি,
কাতান শাড়ি পরিয়ে সাজানো হয়। আবার এসব অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত অতিথিরাও যার যার
সাধ্যমতো দামি শাড়ি পরেন। তবে গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে ছেলে পক্ষ এবং কনে পক্ষ একই
রঙের অথবা সম্ভব হলে দুই রঙের বাহারি শাড়িতে নিজেদের সাজাতে চান। মিলাদ মাহফিল,
ওয়াজ মাহফিল, ঈদুল আযহা, ঈদুল ফিত্র, শবে বরাআত, শবে কদর প্রভৃতি ধর্মীয়
অনুষ্ঠানে ধবধবে সাদা, হালকা এবং ধূসর রঙের শাড়ি পরা হয়। তরুণীরা ঈদের দিনে
চটকদার সালোয়ার কামিজ, কুর্তা, স্কার্ট এবং রঙিন উজ্জ্বল শাড়ি পরে, কিন্তু
বর্ষীয়সী মহিলারা হালকা রঙের বা সাদা শাড়ি পরেন।
সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে যেকোন ধরনের উজ্জ্বল শাড়ি পরার রেওয়াজ আছে। তবে
বাংলা নববর্ষ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি ইত্যাদি দিনে বিশেষ
ধরনের শাড়ি পরা হয়। বাংলা নববর্ষে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরার রীতি দীর্ঘদিন ধরে
প্রচলিত। অন্যান্য দিবসে উজ্জ্বল রঙের শাড়ি পরলেও একুশে ফেব্রুয়ারি কালো পাড়ের
সাদা শাড়ি পরা হয়।