কর্রানি রাজবংশের শাসন
কর্রানিরা ছিল মূলত পাঠনদের একটি শাখা। এদের আদি বাসস্থান ছিল বঙ্গসখ আধুনিক নাম কুর্রম। এদের প্রধান ছিলেন তাজ কর্রানী। তিনি ছিলেন শেরশাহের একজন অন্যতম কর্মচারী ইসলাম শাহের অধীনে তিনি দক্ষিণ-বিহারের শাসনকর্তার পদে ছিলেন। পরে গোয়ালিয়রের আদিল শাহ স্বাধীনভাবে রাজত্ব শুরু করলে, তাজ কর্রানি তাঁর আমির হন। কিন্তু আদিল শাহের কার্যকলাপে বিরক্ত হয়ে তিনি গাঙ্গেয় দোয়াব অঞ্চলে স্বাধীনভাবে বসবাস শুরু করেন। কিন্তু আদিল শাহ তাঁকে এই অঞ্চল থেকে বিতারিত করেন। এরপর তিনি বর্তমান মালদহ শহরের ১৫ মাইল দক্ষিণে বসবাস শুরু করেন। এই অঞ্চলের তৎকালীন নাম ছিল তাণ্ডা। সেই সময় তাঁর অপর তিন ভাই ইমাদ, সুলেমান এবং ইলিয়াস জায়গিরদার হিসেবে বসবাস করতেন। তাজ কর্রানি এদের সাথে যুক্ত হন। এই সময় উত্তর ভারত মোগল কর্তৃক বিতারিত আফগান ও অন্যান্য সৈন্যরা বাংলাদেশে চলে আসে। কর্রানি ভাইয়েরা এদের একত্রিত করে একটি সেনাবাহিনী তৈরি করে। ১৫৬৪ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এঁরা কৌশলে বাংলার সুলতান তৃতীয় গিয়াসউদ্দিনকে পরাজিত ও হত্যা করে বাংলার সিংহাসন দখল করেন। তখন সুলতান হন তাজ কর্রানি।
১৫৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তাজ কর্রানি মৃত্যুবরণ
করলে, সুলতান হন সুলেমান কর্রানি। তিনি সম্রাট আকবরের প্রতি মৌখিক আনুগত্য দেখিয়ে
সাত বৎসর রাজত্ব করেন। এছাড়া বিহারের সীমান্তবর্তী শাসকদের উপঢৌকন দিয়ে রাজত্ব
নিরাপদে রাখেন। এরপর তিনি সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করে, উড়িষ্যা দখল করেন। এই সময়
তিনি পুরীর জগন্নাথের মন্দির লুণ্ঠন করে প্রচর ধনরত্ন লাভ করেন। এছাড়া তিনি বাংলার
উত্তর সীমান্তরাজ্য কুচবিহার আক্রমণ করে দখল করেন। পরে ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকা
ধরে তেজপুর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে নিজ রাজ্যে ফিরে আসেন।
১৬৭২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর সুলতান কর্রানি মৃত্যুবরণ করলে, তাঁর পুত্র
বায়েজিদ কর্রানি সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর দুঃশাসনে অতীষ্ট হয়ে, হান্সু নামক একি
আমির তাঁকে হত্যা করেন। এরপরই সুলেমানের বিশ্বস্ত মন্ত্রী মিঞা লুদি হান্সুকে হত্যা
করে সুলেমানের কনিষ্ঠ পুত্র দাউদ কর্রানিকে সিংহাসনে বসান।
দাউদ ছিলেন অনভিজ্ঞ এবং অহঙ্কারী শাসক। তিনি তাঁর পিতার আমলের অভিজ্ঞ এবং হিতাকাঙ্ক্ষী আমিরদের লাঞ্চিত করেন। এছাড়া তিনি লুদি মিঞার জামাতেকে হত্যা করেন। ফলে লুদি মিঞা তাঁর বিপক্ষে চলে যান। এই সময় তিনি মোগলদের আনুগত্য অস্বীকার করেন। ফলে, মোগল সম্রাট আকবরের শত্রুতে পরিণত হন। এই অবস্থায় বিহারের কর্রানি শাসনকর্তা বায়াজিদের এক পুত্রকে বাংলার সুলতান ঘোষণা করেন। এই বিদ্রোহ দমনের জন্য দাউদ লুদি মিঞাকে পাঠান। লুদি মিঞা জামাতা হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য গুজর খাঁর সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এই ষড়যন্ত্রের সুযোগ নেন বিহারের সীমান্তে অবস্থিত মোগল সেনাপতি মুনিম খাঁ। তিনি সরাসরি লুদি মিঞাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন। এই সংবাদ পেয়ে দাউদ লুদি মিঞাকে দমন করার জন্য সসৈন্যে অগ্রসর হন। এরই মধ্যে মুনিম খাঁ এবং আকবর সম্মিলিত আক্রমণ চালিয়ে পাঠনা দুর্গ অবরোধ করেন। দাউদ অবস্থা বেগতিক দেখে বাংলার দিকে পালিয়ে যান। আকবর মুনিম খাঁকে দাউদকে অনুসরণ করার আদেশ দিয়ে দিল্লী ফিরে যান। মুনিম খাঁ রাজমহলের কাছে তেলিয়াগড়ে এসে দাউদের পথ অবরোধ করেন। দাউদ মোগল বাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধ করতে অসমর্থ হয়ে উড়িষ্যার দিকে পালিয়ে যান। ফলে, মুনিম খাঁ ১৫৭৪ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন বাংলার রাজধানী তাণ্ডা বিনা বাধায় দখল করেন।
এরপর মুনিম খাঁ এবং টোডরমল দাউদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। তুকারই অঞ্চলে দাউদের সাথে যুদ্ধে মোগল বাহিনী জয়লাভ করে। দাউদ বন্দী হয়ে আকবরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। বিনিময়ে দাউদ উড়িষ্যার জায়গির লাভ করেন। এরপর বাংলাদেশে মোগল রাজত্ব শুরু হয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে মোগল শিবিরে অসন্তোষ শুরু হলে, দায়ুদ পুনরায় বিদ্রোহ করে। তিনি দ্রুত বাংলা দখল করতেও সমর্থ হন। এরপর ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে দাউদের সাথে মোগল বাহিনীর পুনরায় যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে দাউদ পরাজিত হয়ে বন্দী হন। পরে তাঁকে হত্যা করা হয়। এর ভিতর দিয়ে বাংলার কর্রানি বংশের শাসন শেষ হয়ে যায়।
সূত্র :
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।