মুসলিম লীগ (নিখিল ভারত)
ব্রিটিশ ভারতে গঠিত রাজনৈতিক দল। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য এই দলটি গঠিত হয়েছিল। শুরুর দিকে এর নাম ছিল নিখিল ভারত মুসলীম লীগ।

মুসলমানদের জন্য পৃথক রাজনৈতিক দলের ভাবনা শুরু হয়েছিল ১৮৭০-এর দশকে। ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে আমীর আলী যখন ‘সেন্ট্রাল মোহামেডান এ্যাসোসিয়েশন’ গঠন করেন, তখন তাঁর সাথে স্যার সৈয়দ আহমদ দ্বিমত পোষণ করেন। সৈয়দ আহমদ মূলত মুসলমানদেরকে রাজনীতি থেকে বিরত থাকার উপদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ ডিসেম্বর  ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠনের পর, হিন্দি ও উর্দু ভাষা নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হলে- তিনি মুসলমানদের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় সচেতন হয়ে ওঠেন। এই সূত্রে তিনি ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে গঠন করেন ‘ইউনাইটেড ন্যাশনাল ডিফেন্স এ্যাসোসিয়েশন’। এরপর থেকে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে মুলমানদের ছোটো ছোটো রাজনৈতিক দল আত্ম-প্রকাশ করতে থাকে।  এই সূত্রে ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে  উত্তর ভারতে মোহমেডান ‘এ্যাংলো ওরিয়েন্টাল ডিফেন্স অরগানাইজেশন অব আপার ইনডিয়া’, ১৯০৩  সাহরানপুরে মুসলিম রাজনৈতিক সংস্থা এবং ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে ফেব্রুয়ারিতে পাঞ্জাবে ‘মুসলিম লীগ’ গঠিত হয়।

১৯০৬-এর ভিতরে গঠিত ভারতীয় সকল মুসলিম দলগুলকে একটি একক সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষেযে, ঢাকার নবান স্যার সলিমুল্লাহ দলগুলোর সাথে পত্র-যোগাযোগ শুরু করেনকরেন এবং ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে সর্বভারতীয় মুসলিম সংঘের প্রস্তাব রাখেন। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৮-৩০শে ডিসেম্বর ঢাকাতে সর্বভারতীয় শিক্ষা সম্মেলন আহুত হল। ঢাকার শাহবাগে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে সমগ্র ভারতের প্রায় ৮ হাজার প্রতিনিধি যোগ দেন। এই সভায় নবাব সলিমুল্লাহ ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম কনফেডারেন্সী’ অর্থাৎ সর্বভারতীয় মুসলিম সংঘ গঠনের প্রস্তাব দেন।  হাকিম আজমল খান, জাফর আলী এবং আরো কিছু প্রতিনিধি প্রস্তাবটিকে সমর্থন করেন। কিন্তু কিছু প্রতিনিধির আপত্তির কারণে কনফেডারেন্সী শব্দটি পরিত্যাগ করে 'লীগ' শব্দটিকে গ্রহণ করা হয়। অবশেষে সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে 'অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ গঠিত হয়। ঢাকায় এই ঐতিহাসিক সম্মেলনে বঙ্গভঙ্গ সমর্থন এবং বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের নিন্দা করা হয়। এ সংগঠনের ব্যাপারে শুরু থেকেই হিন্দু জনগোষ্ঠী বিরূপ অবস্থান নেয়। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত দি বেঙ্গলীপত্রিকা নবগঠিত মুসলিম লীগকে সলিমুল্লাহ লীগ হিসেবে অভিহিত করে।

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ২রা মার্চ এই দলের বঙ্গীয় শাখা প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বর্তমান বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে। এই শাখার নাম রাখা হয়
বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ । এই শাখার প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা ছিল বাংলা। দলটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নওয়াব স্যার খাজা সলিমুল্লাহ, সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, স্যার আবদুল হালিম গজনবী, বিচারপতি স্যার জাহিদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল কাশেম, ওয়াহিদ হোসেন ও আবদুর রসুল। এদের মধ্যে নওয়াব স্যার খাজা সলিমুল্লাহকে সভাপতি এবং সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ও জাহিদ সোহরাওয়ার্দীকে সম্পাদক করে কমিটি ঘোষণা করা হয়। আবুল কাসেম, ওয়াহিদ হোসেন ও আবদুর রসুল সহ অনেক সদস্য একই সাথে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন।

১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে দলটির একাংশ পৃথক হয়ে তৈরি হয় প্রজা পার্টি।

১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে দলটি বাংলার আইন সভায় ৪০টি আসন পায়। এই সময় দলটি কৃষক পার্টির নেতা একে ফজলুল হককে সমর্থন করে। এই সময় এই দলের প্রধান ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দিন।

১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা কর্পরেশন নির্বাচনে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ২২টি আসনের মধ্যে ১৮টি আসন লাভ করে।
১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে একে ফজলুল হকের সরকারের প্রতি অনাস্থা দেখিয়ে, এরা সমর্থন প্রত্যাহার করে।
১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে হক-শ্যামা জোটকে সরিয়ে নাজিমুদ্দিন বাংলার প্রধানমন্ত্রী হন। এই বৎসরে বাংলায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এছাড়া প্রাদেশিক নানা সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় দলটির অভ্যন্তরীণ কোন্দল বৃদ্ধি পায়।

১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে নাজিমুদ্দিন-সরকারের পতন ঘটে এবং গভর্নরের শাসন জারি হয়। এরপর থেকে দলের নেতৃত্ব চলে আসে হোসেন শহীদ সোহওরাওয়ার্দি এব মোহম্মদ আলীর কাছে।

১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে বঙ্গীয় আইন সভায় ২৫০ আসনের মধ্যে ১১৪টিতে জয়লাভ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। অন্যান্য প্রদেশ মুসলিম লীগের অবস্থান ছিল: সিন্ধু প্রদেশ: ২৮/৬০, পাঞ্জাব: ৭৫/১৭৫, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ: ১৭/১৫০, যুক্তপ্রদেশ: ৫৪/২২৮, বিহার প্রদেশ: ৩৪/১৫২, আসাম: ৩১/১০৮, বোম্বে প্রেসিডেন্সি: ৩০/১৭৫, মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি: ২৯/২১৫ এবং ওড়িশা প্রদেশ: ৪/৬০।

বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে এই দলটি ৪৫% আসন লাভ করাই ছিল এ নির্বাচনে মুসলিম লীগের পক্ষে সবচেয়ে বড় সাফল্য। সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিসভাই ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনের পূর্ব-কাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল।

নিখিল ভারত মুসলিম লীগের বিভাজন
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে, নিখিল ভারত মুসলিম লীগ রাষ্ট্রভিত্তিক দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এই ভাগ দুটি হলো-