মারমা
অন্যান্য নাম : মার্মা।
বাংলাদেশ ও মায়ানমারে বসবাসকারী একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী।
নৃতাত্ত্বিক পরিচয়
নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের বিচারে এরা মোঙ্গোলীয়।
ইতিহাস:
আদিতে এরা মায়ানমারে বসবাস করতো। বার্মিজ ভাষায় এদের বলা হতো ম্রাইমা।
গোষ্ঠীগত সংহিসতার কারণে এরা মায়ানমার থেকে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে
চলে আসে। কালক্রমে এরা বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এরই ভিতর
দিয়ে এরা নানা গোত্রে বিভাজিত হয়ে যায়। বর্তমানে এদের দশটি গোত্রের সন্ধান পাওয়া
যায়। এগুলো হলো- রিগো বা খ্যংসা, কক্দাইংসা, মারোসা, ক্যক্ফ্যাসা, ফ্রাংসা, থংসা,
প্যালেঙসা, ওয়ইংসা, মুরিখ্যংসা, লংদুসা।
বর্তমানে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে অঞ্চলের সকল জেলাতেই এদের দেখা যায়। তবে জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই বান্দরবান জেলাতে বাস করে। এছাড়া বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্ত বরাবর মায়ানমারে এদের দেখা যায়। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের আদমশুমারী অনুসারে বাংলাদেশের মারমা নৃ-গোষ্ঠির জনসংখ্যা ১,৫৭,৩০১জন ।
ভাষা:
এদের নিজস্ব ভাষা আছে। তবে এরা লেখার ক্ষেত্রে বার্মিজ লিপি ব্যবহার করে থাকে। এরা
ছাড়া ম্রো ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীর লোকেরাও মারমা ভাষা ব্যবহার করে। বাংলাদেশের মার্মাদের
দ্বিতীয় ভাষা বাংলা।
ধর্ম:
এরা মূলত বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। তবে এর পাশাপাশি কিছু নিজস্ব সনাতন আচারানুষ্ঠান
করে।
খাদ্য
ম্রোদের প্রধান খাদ্য ভাত। ভাতের সাথে এরা মূলত
সব্জি খায়। পাহাড়ি পশুপাখি, মাছও এদের খাদ্য তালিকায় আছে। উৎসবে এরা গরু, ছাগল,
শুকর খায়। এরা তরকারীতে ঝোল রাখে না। মদ এদের প্রিয় পানীয়। এবং এই মদ এরা নিজেরাই
তৈরি করে।
জীবিকা
এরা মূলত পাহাড় ও বনজ সম্পদের উপর নির্ভরশীল। তবে জুম চাষ তাদের জীবিকার একটি অন্যতম অংশ। বছরের মার্চ-এপ্রিল মাসের দিকে এরা জুমের জন্য পাহাড়ে আগুন দেয়। মে-জুন মাসের দিকে আগুনে পোড়ানো পাহাড়ে জুম চাষ শুরু করে। এরা পাহাড়ের ধান, ভূট্টা, মরিচ, যব, সরিষা, মিষ্টি কুমড়া, মারমা, টকপাতাসহ বিভিন্ন রকম সবজির চাষ করে। এছাড়া এরা ছোটো পাহাড়ি পশুপাখি শিকার করে। পাহাড়ি নদীর মাছও শিকার করে খায়। অবসর সময়ে মারমা মেয়েরা কাপড় তৈরি করে।
বোমাং সার্কেলের প্রধান নামের
তালিকা ক্রমানুসারে:- ১. মংচপ্রু-(১৫৯৯-১৬৩১ইং) ২. পুত্র মিরাইপ্রু ৩. পুত্র হরিপ্র-(১৬৬৫-১৬৮৭ইং) ৪. ভাগ্নি হরি জিনিউ (১৬৮৭-১৭২৭ইং) ৫. কংহ্লাপ্রু-(১৭২৭-১৮১১ইং) ৬. পুত্র সাথুইপ্রু-(১৮১১-১৮৪০ইং) ৭. ভাগ্নে কংহ্লা জিনিউ (১৮৪০-১৮৬৬ইং) ৮. মংপ্রু-(১৮৬৬-১৮৭৫ইং) ৯. সানাউ-(১৮৭৫-১৯০১ইং) ১০. ভাগ্নে চুহ্লাপ্রু-(১৯০১-১৯২৩ইং) ১১. ভাগ্নে মংচ জিনিউ (১৯১৬-১৯২৩ইং) ১২. ভাগ্নে ক্যজাইপ্রু-(১৯২৩-১৯৩৩ইং) ১৩. পুত্র ক্যজসাই-(১৯৩৩-১৯৫৩ইং) ১৪. ভাই মংসুইপ্রু-(১৯৫৯-) ১৫. অংসুইপ্রু-(বর্তমানে) । |
সমাজ ব্যবস্থা:
মারমা সমাজ ব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক। তবে
পুরুষদের মতো মেয়েরাও পৈতৃক সম্পত্তির সমান উত্তরাধিকারিণী হয়। ঐহিত্যগত মারমা
সমাজ ব্যবস্থাপনাকে গ্রাম, মোজা ও সার্কেল তিন পর্যায়ে ভাগ করে পরিচালনা করা হয়।
গ্রাম পরিচালনায় প্রধান হচ্ছেন "কার্বারী"। মোজা পর্যায়ে "হেডমেন" এবং সার্কেল
প্রধান হচ্ছে রাজা বা মাং। বতর্মানে মারমাদের দুটি সার্কেল বিদ্যমান। খাগড়াছড়িতে মং
সার্কেল ও বান্দরবানে বোমাং সার্কেল। বোমাং সার্কেলের প্রথম রাজা ছিলেন মংচপ্রু ।
পিতার নাম রাজা নাইদা বায়িন। এদের ছিল মায়ানমারের পেগু নামক স্থানে।
জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ এ তিনটি অধ্যায়কে মারমারা নিজেদের সামাজিক রীতিনীতি ও
আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজসিদ্ধ (আবদ্ধ) করেছে। মারমা সমাজের বিভিন্ন গোত্র ও
উপ-গোত্রের মধ্যে রীতিনীতি,আচার-অনুষ্ঠান পালনের ক্ষেত্রে কিছু কিছু ব্যতিক্রম ও
সূক্ষ্ম তারতম্য রয়েছে। রীতিনীতি অনুসরণ ও আচার-অনুষ্ঠান মেনে চলার বাধ্যবাধকতা
মারমা সমাজে রয়েছে।
বিবাহ
মারমা সমাজে বিবাহের অনুষ্ঠানটি শুরু হয় "লাকপাই-পোই" বা বিবাহের প্রস্তুতিমূলক
অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। এই অনুষ্ঠানটি মূলত আয়োজন করা হয়
আত্নীয়স্বজন,বন্ধু-বান্ধব ও পাড়া-প্রতিবেশীদের জানানোর জন্য। উভয়পক্ষের সম্মতিতে
ও সামাজিক রীতি অনুসারে পাত্রের পিতা-মাতা বা বন্ধু-বান্ধব কয়েকজন বয়বৃদ্ধ
প্রথাগতভাবে ব্যবহার্য উপকরণ নিয়ে কনের বাড়িতে যায়। এইসকল উপকরণের ভিতরে থাকে−
বোতল মদ, ২৫টি সুপারী, ১ বিড়া পান, বিন্নি ভাত, মিষ্টি, আখ ও ১ জোড়া নারিকেল।
কনের বাড়িতে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কনের মা-বাবার কাছে তাদের মেয়ের বিবাহের প্রস্তাব
করা হয়। মা-বাবার সম্মতির পর মেয়ের মতামত নেয়া হয়। মেয়ের মতামত পাওয়ার পর
পাত্রীপক্ষ অনুরূপ আর এক বোতল মদ পাত্র পক্ষকে প্রদান করে। এরপর জ্যোতিষ ডেকে
রাশিফল ও বিয়ের দিন ক্ষণ ও তারিখ ঠিক করা হয়। সবকিছু শুভ লক্ষণযুক্ত হলে
পাত্রপক্ষ একটি থামী (মেয়েদের কাপড়), রূপা বা স্বর্ণের একটি আংটি দিয়ে পাত্রীকে
আশীর্বাদ করেন। বিয়ের ২দিন আগে পাত্রের বাবা বা অভিভাবক নিজ বাড়িতে গৃহ দেবতা
উদ্দ্যেশ্য (চুং মং লে) পুজার আয়োজন করে। পূজাতে দেবতার উদ্দেশ্যে ১টি শুকর.
পাঁচটি মুরগী বলি দেয়া হয়। বিয়ের তারিখ ধার্য্য হলে পাত্রপক্ষ থেকে পাত্রীপক্ষের
বাড়িতে ১টি মোরগসহ বিয়ের নিমন্ত্রণ পাঠানো হয়। বিয়ের দিন সামাজিক ও ধর্মীয়
রীতি অনুসারের পাত্রের বাড়ি প্রবেশ দ্বারে ২টি কচি কলা গাছ, সাদা সুতা দিয়ে
পেচানো ২ টি পানি ভর্তি কলস (রিজাংও) ও সিফাইক্ও রাখে। বউ আনতে যাওয়ার সময় সিদ্ধ
মোরগ, মদ তৈরি হওয়ার পূর্বে ভাত,পানি মুলির সংমিশ্রণ ১ বোতল মদ,১টি থামি (মেয়েদের
নিম্নাংশের পরিধেয় কাপড়) ও ১ টি বেদাই আংগি (উর্ধাঙ্গের পোষাক) সহ নানা উপকরণ
নিয়ে যাওয়া হয়। বিয়ের দিন সিদ্ধ মোরগটিকে প্রয়োজনীয় উপকরণ মিশিয়ে বর-কনের
জন্য একটি পাত্রে পরিবেশন করে। বিবাহ অনুষ্ঠানে বৌদ্ধ ভিক্ষু দ্বারা পঞশীল গ্রহণ ,
মঙ্গল সূত্র পাঠ ও পিণ্ড দানসহ নানা রকম ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা হয়। অবশেষে,
বিবাহের "লাক্ ছং চা-চ" অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়। এরপর থেকে তারা স্বামী-স্ত্রী
রূপে সমাজে স্বীকৃতি লাভ করে।
উৎসব:
মারমাদের সাংগ্রাই
অনুষ্ঠান দিয়ে নববর্ষ শুরু করে। মারমারা বর্ষবরণকে প্রধান সামাজিক উৎসব হিসেবে
পালন করে থাকেন। মারমাদের আদি সংস্কৃতি মধ্যে রয়েছে থালা নৃত্য, পাখা নৃত্য, মাছ
ধরা নৃত্য, পাংখুং,জাইক, কাপ্যা প্রভৃতি । নিজেদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মারমা সমাজে
খুবই জনপ্রিয়।