১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে এখানে ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রেডিও স্টেশন (গল্লামারী
রেডিও সেন্টার)। সে সময়ের বেতার ভবন ছিল পাকিস্তানি সৈন্য, রাজাকার ও শান্তি কমিটির
অত্যাচার ও গণহত্যার অাঞ্চলিক কেন্দ্র। এখানে বেশিরভাগ মানুষকে জবাই করে
হত্যা করা হতো। প্রথম দিকে শুধুমাত্র রাতের বেলাতে নিরপরাধ মানুষদের হত্যা করা হলেও
শেষের দিকে তারা দিনে রাতে সমানে নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে
সন্দেহভাজন মানুষকে ধরে এনে হাত বেঁধে বেতার কেন্দ্রের সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়
করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হত। প্রতি রাতে প্রায় শতাধিক মানুষ হত্যা করা হত। এ
ছাড়া এরা নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের কেন্দ্রও ছিল। খুলনা শহর মুক্ত হবার পর গল্লামারী
খাল ও এর আশেপাশের স্থান থেকে প্রায় পাঁচ ট্রাক ভর্তি মানুষের মাথার খুলি ও
হাড়গোড় পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, ঐ স্থানে আনুমানিক ১৫,০০০ মানুষ হত্যা করা
হয়। স্বাধীনতার পর রেডিও সেন্টার (বর্তমান বাংলাদেশ বেতার, খুলনা কেন্দ্র) নগরীর
নূরনগর এলাকায় স্থানান্তরিত হয়েছে।
১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে খুলনার মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও
পেশাজীবী সংগঠনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে, খুলনা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উদ্যোগে
গল্লামারী বধ্যভূমিতে ছোট একটি স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলা হয়। ওই বছরের ২৬শে
মার্চ এটির উদ্বোধন করেন জনৈক শহিদসন্তানের পিতা আলতাউদ্দিন আহম্মদ। এরপর এখানে
একটি পরিকল্পিতভাবে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের উদ্যো গ্রহণ করা হয় সরকারিভাবে এবং একটি
চমৎকার স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। ১৯৯৫ তৎকালীন জেলা
প্রশাসক কাজী রিয়াজুল হক ও পুলিশ সুপার আওলাদ হোসেনের উদ্যোগে অস্থায়ীভাবে
এবং পরে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) নকশা অনুযায়ী
স্থায়ীভাবে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ হয়। এরপরও খুলনার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী
ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে এখানে আধুনিক স্থাপত্য
শৈলীর সৌধ নির্মাণের দাবি অব্যাহত থাকে।
১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে জেলা প্রশাসন আধুনিক নকশায় স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পুনরায় উদ্যোগ নেয়।
এই সময় স্মৃতিসৌধের পাশেই তৈরি
করা হয় একটি মুক্তমঞ্চ। এরপর ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে জেলা পরিষদ উদ্যোগ নেয় ওই এলাকায় একটি আধুনিক স্মৃতিসৌধ নির্মাণের
জন্য তিন একর খাস জমি অধিগ্রহণ করা হয়।
২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে ডিসেম্বর তৎকালীন
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আনোয়ারুল ইকবাল নতুন ডিজাইনের গল্লামারী
স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। আধুনিক স্থাপত্যশৈলী
সমৃদ্ধ সৌধের নকশা প্রণনয় করেন স্থপতি আমিনুল ইসলাম ইমন। স্মৃতিসৌধে রয়েছে
পাশাপাশি দু'টি সুউচ্চ স্তম্ভ। মাঝে লাল রক্তিম সূর্য। ৭টি দণ্ড সাত
বীরশ্রেষ্ঠ'র প্রতীক। লাল রক্তিম সূর্য সাত বীরশ্রেষ্ঠ ধারণ করে আছেন। এর সামনে
রয়েছে একটি প্রশস্ত সিঁড়ি। নকশা অনুসারে স্মৃতিসৌধটির নির্মাণ কাজের
প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয় ২ কোটি টাকা। প্রথম দরপত্র আহ্বানে নির্মাণ কাজের জন্য
চাহিদা অনুযায়ী যোগ্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান না পাওয়ায় সেবার তা বাতিল করা হয়।
পরবর্তীতে এলজিইডি সদর দপ্তরের নির্দেশে প্রাক্কলনের স্থায়িত্ব বিবেচনায় খুলনা
প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েটে) পরামর্শ নেয়া হয়।
২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে জেলা পরিষদ
উন্নয়ন সমন্বয় পরিষদের বৈঠকে দ্বিতীয় দফায় দরপত্র আহ্বান করা হয়। সেবার
আজাদ ইলোরা জয়েন্ট ভেঞ্চার ২ কোটি ১৬ লাখ টাকায় সর্বনিম্ন দরদাতা নির্বাচিত
হয় ও স্মৃতিসৌধের নির্মাণ কাজ পায়। এ অর্থের মধ্যে ২ কোটি টাকা মুক্তিযোদ্ধা
মন্ত্রণালয় ও ১৬ লাখ টাকা জেলা পরিষদ বরাদ্দ দেয়। এছাড়া ডিজাইনে সৌধের
সিঁড়ি নিয়ে আপত্তি ওঠায় তার প্রশস্ততা ২ ইঞ্চি বাড়াতে অতিরিক্ত ৯ লাখ ৩৫
হাজার ৩১২ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।
২০১১ খ্রিষ্টাব্দে মূল স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন হলেও, এর কাজ শেষ পর্যন্ত শেষ করা
সম্ভব হয় নি।
তথ্যসূত্র: