মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ
বাংলাদেশের
মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরে অবস্থিত একটি স্মৃতিসৌধ। মেহেরপুর জেলা সদর থেকে সড়ক পথে
এই আম্রকাননের দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার। মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলী
তুলে ধরার জন্য এই কমপ্লেক্সে রয়েছে- একটি স্মৃতিসৌধ এবং যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের
সেক্টরগুলোর অবস্থান সম্বলিত একটি মানচিত্র। এই কমপ্লেক্স মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলীর স্মারক
নমুনা স্থাপন করা হয়েছে। সার্বিকভাবে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি
কমপ্লেক্স, ঐতিহাসিক আম্রকানন, ঐতিহাসিক ছয় দফার রূপক উপস্থাপনকারী ছয় ধাপের
গোলাপ বাগান, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক জীবন্ত প্রদর্শন স্থানে পরিণত হয়েছে।
বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্সের ভিতরের অংশে মুক্তিযুদ্ধকালীন কিছু
ঐতিহাসিক ঘটনার কিছু নানন্দিনক ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দর মুক্তিযুদ্ধের সময়, ১৭ই এপ্রিল বর্তমান মেহেরপুর জেলার
বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ করে।
এই স্থানকে পরবর্তী সময়ে 'মুজিবনগর' নামকরণ করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের
কালানুক্রমিক ধারায় এই অস্থায়ী সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণের দিনকে 'মুজিবনগর
দিবস হিসাবে' আখ্যায়িত করা হয়।
বাংলাদেশের যুদ্ধকালীন সময়ে এই অস্থায়ী সরকার যেখানে গঠিত হয় সেখানে এই
স্মৃতিসৌধটি গড়ে তোলা হয়েছে। এর স্থপতি তানভীর করিম।
মূল স্মৃতিসৌধ:
মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার মুজিবনগরকে স্মরণীয় করে রাখার
উদ্যোগ নেয়। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ শে আগস্ট সরকার মুজিবনগরে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের
নির্দেশ দেয়। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর দিবসে মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারপ্রাপ্ত
রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এ প্রকল্পের কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। কিন্তু
১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে
বঙ্গবন্ধু
শেখ
মুজিবর
রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এই সময়ে বাংলাদেশে স্বাধীনতা বিরোধী সরকারের
উত্থান ঘটে। এই সরকার
এই প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেয়। এর প্রায় ১১ বছর পর ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে এরশাদ
সরকারের আমলে মুজিবনগরে স্মৃতিসৌধের
কাজ সমাপ্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয় এবং এই সময় প্রায় দুই কোটি টাকা বরাদ্দ করা
হয়।
তৎকালীন সরকারের গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে মেসার্স এভ্রি-ডে ইঞ্জিনিয়ারিং
নামীয় নির্মাণ প্রতিষ্ঠান স্মৃতিসৌধের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে। ১৯৮৭
খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই এপ্রিল রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের আনুষ্ঠানিক
উদ্বোধন করেন। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে এখানে পাঠাগার, মসজিদ ও অতিথিশালা নির্মাণ করে একে মুজিবনগর
স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্সে রূপান্তরিত করা হয়।
এই স্মৃতিসৌধের প্রকল্পটি ২০.১০ একর জমির উপর স্থাপিত হয়েছে।
এর মূল বেদী আয়তকার। এর দৈর্ঘ্য
২৪ ফুট এবং প্রস্থ ১৪ ফুট। বেদীটি লাল বর্ণের। মূল স্মৃতিসৌধটিতে রয়েছে ২৩ টি
ত্রিভূজাকৃতি দেয়াল। দেয়ালগুলো বৃত্তাকারের সারিবদ্ধভাবে সাজানো রয়েছে। এই ২৩ টি
দেয়াল [আগষ্ট ১৯৪৭] থেকে [মার্চ ১৯৭১]- এই ২৩ বছরের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতীক
হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
এর প্রথম দেয়ালটির উচ্চতা ৯ ফুট ৯ ইঞ্চি এবং দৈর্ঘ্য ২০ ফুট। পরবর্তী প্রতিটি
দেয়ালকে ক্রমান্বয়ে দৈর্ঘ্য ১ ফুট ও উচ্চতা ৯ ইঞ্চি করে বাড়ানো হয়েছে। এর
দ্বারা বুঝানো হয়েছে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার চলমান ৯টি মাস। শেষ দেয়ালের উচ্চতা
২৫ ফুট ৬ ইঞ্চি ও দৈর্ঘ্য ৪২ ফুট। প্রতিটি দেয়ালের ফাঁকে অসংখ্য ছিদ্র রয়েছে। এই
ছিদ্রগুলো পাকিস্থানি শাসক গোষ্ঠীর অত্যাচারের চিহ্ন হিসেবে প্রদর্শন করা হয়েছে।
স্মৃতিসৌধটির ভূমি থেকে ২ ফুট ৬ ইঞ্চি উঁচু বেদীতে অসংখ্য গোলাকার বৃত্ত
রয়েছে। এগুলোর দ্বারা ১ লক্ষ বুদ্ধিজীবীর খুলিকে বোঝানো হয়েছে।
এছাড়া
স্মৃতিসৌধের ভূমি থেকে ৩ ফুট উচ্চতার বেদীতে রয়েছে অসংখ্য পাথর। এই পাথরগুলো ৩০ লক্ষ শহিদ ও মা-বোনের সম্মানের
প্রতীক হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে। পাথরগুলো মাঝখানে ১৯টি রেখা দ্বারা তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্থানের ১৯টি জেলাকে বুঝানো হয়েছে।
স্মৃতিসৌধের বেদীতে আরোহণের জন্য ১১টি সিঁড়ি রয়েছে। এর দ্বারা
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সমগ্র বাংলাদেশকে যে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়েছিল তা
বুঝানো হয়েছে।
স্মৃতিসৌধের উত্তর পাশের আম বাগান ঘেঁষা স্থানটিতে মোজাইক করা স্থানটি
বঙ্গোপসাগরের প্রতীক।
যদিও
বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত। কিন্তু শপথ গ্রহণের মঞ্চটির সাথে স্মৃতিসৌধের সামঞ্জস্য
রক্ষার জন্য এখানে
বঙ্গোপসাগরকে উত্তর দিকে স্থান দেয়া হয়েছে।
স্মৃতিসৌধের মূল ফটকের রাস্তাটি মূল স্মৃতিসৌধের রক্তের সাগর নামক ঢালকে
স্পর্শ করেছে। ঢালের রাস্তাটি ভাষা আন্দোলনের প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
স্মৃতিসৌধের ভাস্কর্যসমূহ: স্মৃতি কমপ্লেক্সের বাইরের অংশে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের
ভাষণ, মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ এবং পাকিস্থানি বাহিনীর আত্নসমর্পণ এর দৃশ্যসহ
বেশকিছু ঐতিহাসিক ঘটনার ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। নিচে এই কিছু ভাস্কর্যের
নমুনা তুলে ধরা হলো।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ |
সৈয়দ নজরুল ইসলাম অভিবাদন গ্রহণ করছেন |
|
নারীনির্যাতন |
|
গণহত্যা |
মিত্রবাহিনীর কাছে ১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ |
তথ্যসূত্র: