বাংলাদেশের প্লাবনভূমি
পূর্ব-পাঠ: বাংলাদেশে ভূ-প্রকৃতি

বাংলাদেশের প্লাবনভূমি:
উত্তরাঞ্চলের উঁচু ভূমির দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশের প্লাবনভূমি। মূলত বন্যার সময় নদীর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়। ফলে এই পানিবাহিত পলি জমে জমে এই ভূমি তৈরি করেছে। ভূতত্ত্ববিদ জাবেদ কলিম সমগ্র প্লাবনভূমিকে পনেরটি উপ-অঞ্চলে ভাগ করেছেন। এই ভাগগুলো হলো-

১. পুরাতন হিমালয় পর্বত পাদদেশীয় সমভূমি:
হিমালয় থেকে সমভূমিতে পতিত বিভিন্ন জলধারা ও নদ-নদী কর্তৃক পর্বত থেকে বাহিত পলি পর্বতের পাদদেশে অবক্ষেপণের ফলে সুষম ঢালবিশিষ্ট এই পাদদেশীয় সমভূমি গঠিত হয়েছে। হিমালয় পর্বত পাদদেশীয় সমভূমির একটি অংশ বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম কোণ দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে সম্প্রসারিত হয়েছে। বাংলাদেশের বৃহত্তর রাজশাহী, দিনাজপুর ও বগুড়া জেলার প্রায় ১৩,০০০ বর্গ কিমি এলাকা নিয়ে এই অঞ্চল গঠিত। এ অঞ্চলটি একটি পুরাতন পাললিক স্তরসমষ্টিতে অন্তর্ভুক্ত। ফ্যাকাশে লালচে বাদামি রঙের সংহত মৃন্ময়
(agrillaceous) স্তর দিয়ে গঠিত এবং এসব বস্তু প্রায়ই অবক্ষয়ের ফলে হলুদাভ রঙে পরিণত হয়। সমগ্র মৃত্তিকা জুড়ে চুনের গুটি এবং কূমাণ্ডক (pisolitic) লৌহময় অনুস্তরণজাত পিণ্ড দেখা যায়। স্থানীয়ভাবে মৃত্তিকা চুনসমৃদ্ধ। মৃত্তিকার পি.এইচ পরিসর ৬.০ থেকে ৭.৫ এর মধ্যে। মৃত্তিকাতে নাইট্রোজেন ও ফসফরাসের অভাব রয়েছে।

দিনাজপুর জেলার প্রায় অধিকাংশ অঞ্চল এই সমভূমির ভিতরে পড়ে। এর মোট আয়তন প্রায় ৩,৮৭০ বর্গকিলোমিটার। এই অঞ্চলটি হিমালয়ের পাদদেশীয় বালুকারাশি এবং নুড়ি দ্বারা আচ্ছাদিত। পাদদেশীয় সঞ্চয়সমুহ নবীন প্লাইসটোসিন অথবা প্রবীন হলোসিন সময়কালের মতো পুরানো। তবে সে তুলনায় মধুপুর নবীন। এই ভূমিরূপের নিষ্কাশন প্রণালী বিনুনি প্রকৃতির এবং একাধিক অগভীর, প্রশস্ত, মসৃণ কিন্তু অনিয়মিত আকৃতির শৈলশিরাবিশিষ্ট। এ সমস্ত শৈলশিরা অসংখ্য প্রশস্ত কিন্তু অগভীর নদীখাত দ্বারা বিভক্ত। এগুলো আবার ঘন ঘন শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত এবং পুনর্যোজিত হয়েছে। এলাকাটি উঁচু হয়ে ওঠার কারণেই এখানকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নদীগুলো বর্তমানে সমভূমির নিচে প্রায় ৬ মিটার পর্যন্ত গভীর খাদ সৃষ্টি করেছে। তবে উত্তর থেকে দক্ষিণে এই পরিমাপ ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে। পুরাতন হিমালয় পাদদেশীয় সমভূমি উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে সুষমভাবে ঢালু হয়ে গিয়েছে। ঢালের উত্তর প্রান্ত সমুদ্র সমতল থেকে গড়ে ৯৬ মিটার উঁচু এবং দক্ষিণ প্রান্ত ৩৩ মিটার। দেশের উত্তর-পশ্চিম কোণে সমগ্র ঠাকুরগাঁও জেলা এবং পঞ্চগড় ও দিনাজপুর জেলার অধিকাংশ এই ভূ-প্রাকৃতিক এককের অন্তর্ভুক্ত। এই সমভূমির অধিকাংশ স্থানই বন্যায় প্লাবিত হয় না।

২. তিস্তা প্লাবনভূমি:
পশ্চিমে হিমালয়ের পাদদেশীয় সমভূমি এবং পূর্বদিকে উত্তর দক্ষিণে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদের ডান তীর পর্যন্ত বিস্তৃত একটি বৃহৎ ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চল। বর্তমান বাংলাদেশের
বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া ও পাবনা জেলার অংশবিশেষ নিয়ে এ অঞ্চলটি গঠিত।  এই ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চল দক্ষিণে বগুড়া জেলার শেরপুর পর্যন্ত সম্প্রসারিত। প্রাচীন তিস্তা নদীর দ্বারা এই প্লাবনভূমি গঠিত হয়েছে। এর মোট আয়তন প্রায় ১৫,২৮৩ বর্গকিলোমিটার। এ অঞ্চলের অধিকাংশ ভূমিই বর্ষা মৌসুমে অগভীরভাবে প্লাবিত হয় তবে ঘাঘট নদী বরাবর একটি অগভীর নিম্নভূমি রয়েছে। এখানে বন্যার গভীরতা মাঝারি ধরনের হয়ে থাকে। তিস্তা, ধরলা, এবং দুধকুমার এই তিনটি বৃহৎ নদী তিস্তা প্লাবনভূমিকে ছেদ করেছে। এই নদীত্রয়ের বিধৌত প্লাবনভূমি ছয় কিলোমিটারের চেয়ে কম প্রশস্ত। প্রাচীন পুণ্ড্র ভুক্তির অন্তর্গত এই অঞ্চলটি প্রাচীনকালে আরও নিম্নভূমি ছিল। পলির জন্য মৃত্তিকা ছিল খুবই উর্বরা। এখানে প্রচুর ফসল উৎপন্ন হতো। এই কারণে প্রাচীনকালের মধ্যভাগ থেকেই এই অঞ্চলে ঘনলোকবসতি গড়ে উঠে। পুণ্ড্রনগরের নিকটবর্তী উত্তরপশ্চিমাঞ্চল ছিল তাদের খাদ্যশস্যের যোগানদার। প্রাগৈতিহাসিক যুগে এখানে জনবসতির প্রমাণ পাওয়া না গেলেও ঐতিহাসিক যুগের প্রথম থেকেই এখানে লোকবসতি ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

মৃত্তিকার গঠন প্রধানত বেলে দোআঁশ। পৃষ্ঠমৃত্তিকার পি.এইচ মানের পরিসর ৫.৫ থেকে ৬.৫। মৃত্তিকাগুলো সাধারণত উর্বর এবং পটাশ ও ফসফেট সমৃদ্ধ।

৩. বহ্মপুত্র পলল: বাংলাদেশের বৃহত্তর কুমিল্লা, নোয়াখালী ও পাহাড়ি এলাকা ব্যতীত সিলেট জেলা এবং ময়মনসিংহ, ঢাকা ও চট্টগ্রাম জেলার অংশবিশেষ নিয়ে এই পলল ভূমি বিস্তৃত হয়েছে।  এর আওতাধীন এলাকা ৪০,০০০ বর্গ কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রাধান্য বিস্তারকারী মৃত্তিকা গঠন হলো বেলে দোআঁশ। মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্য এসিডীয় এবং পি.এইচ মানের বিস্তার ৫.৫ থেকে ৬.৮। মৃত্তিকাগুলো প্রকৃতিগতভাবেই উর্বর এবং প্রতিবছর বন্যার পানিবাহিত নবীন পলিযুক্ত হয়ে এসব মৃত্তিকার উর্বরতাশক্তি রক্ষিত হয় বা বৃদ্ধি পায়। নবীন ও প্রবীণ ব্রহ্মপুত্রের বিচারে এই পললভূমিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। ভাগ দুটি হলো

৩.১. পুরাতন ব্রহ্মপুত্র প্লাবনভূমি:
ভূমিকম্পের কারণে, ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রহ্মপুত্র মধুপুর গড়ের পূর্ব পার্শ্ব থেকে গতি পরিবর্তন করে পশ্চিম পার্শ্ব দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করে। ব্রহ্মপুত্র নদের এই নতুন গতিপথ যমুনা নামে অভিহিত হতে থাকে। বাহাদুরাবাদ এবং ভৈরবের মধ্যবর্তী ব্রহ্মপুত্রের পুরাতন প্রবাহ, ব্রহ্মপুত্র নামে অগ্রসর হয়েছে। এই নদীটী বেশ সংকীর্ণ। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র প্লাবনভূমি গারো পাহাড়ের দক্ষিণ পশ্চিম কোণ থেকে আরম্ভ হয়ে মধুপুর গড়ের পূর্ব প্রান্ত দিয়ে মেঘনা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত। এর নিম্নভূমি বন্যার সময় প্রায় এক মিটারের অধিক গভীরতায় প্লাবিত হয়। কিন্তু শৈলশিরাসমূহ কেবল বর্ষার সময় অগভীরভাবে প্লাবিত হয়ে থাকে। এর মোট আয়তন প্রায় ৯,৪৩১ বর্গকিলোমিটার। হাজার বছর পূর্বে মধুপুর টাঙ্গাইল ও ঢাকা জেলায় লালমাটি অঞ্চলের পাদদেশ হিসেবে উচ্চভূমি ছিল। বিভিন্ন সময়ে ভূমিকম্পের কারণে এই অঞ্চলের অনেক অবনমন হয়েছে। 

.১ যমুনা (নবীন ব্রহ্মপুত্র) প্লাবনভূমি:
১৭৮৭ খ্রিষ্টব্দের ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্র তার পুরাতন গতিপথ পরিবর্তন করে দক্ষিণমুখী ঝিনাই ও কোনাই নদী বরাবর প্রবাহিত হতে শুরু করে। ব্রহ্মপুত্রের এই দিক পরিবর্তনের ঘটনা ঘটে ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। নব্য যমুনা ও ধলেশ্বরী নদী মিলিতভাবে যমুনা-ধলেশ্বরী প্লাবনভূমি তৈরি করেছে। এই উপশ্রেণীর দক্ষিণাংশ একসময় গাঙ্গের প্লাবনভূমির অংশ ছিল। ব্রহ্মপুত্র, যমুনা এবং গঙ্গার প্রবাহ বরাবর বহু সংখ্যক দিয়ারা ও চর গড়ে উঠেছে। প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশের অন্য যে কোনো নদীর চেয়ে যমুনা নদীতে চরের সংখ্যা অত্যধিক এবং বাংলাদেশে প্রবেশের পর থেকে ধলেশ্বরী নদী পর্যন্ত উভয় তীর প্রচুর সংখ্যক দিয়ারার উপস্থিতি দ্বারা বিভক্ত। চর এবং দিয়ারার মৃত্তিকা ও ভূমিরূপে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। এ সকল পরিবৃদ্ধির সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন উত্থানের মধ্যকার পার্থক্য প্রায় ৫ কিলোমিটারের মতো। কিছু কিছু শৈলশিরা অগভীরভাবে প্লাবিত হলেও অধিকাংশ শৈলশিরা এবং প্লাবনভূমি অববাহিকাসমূহ বর্ষা মৌসুমে প্রায় চার মাসাধিককাল (মধ্য জুন থেকে মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত) ০.৯১ মিটারেরও অধিক গভীরতায় প্লাবিত হয়ে প্রচুর পলি সঞ্চয় করে।

৪. মধুপুর অঞ্চল বা লাল মৃত্তিকা অঞ্চল:
বৃহত্তর ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলা এবং চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও সিলেট জেলার কিছু বিচ্ছিন্ন এলাকা নিয়ে গঠিত। এ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত এলাকার পরিমাণ প্রায় ১০,০০০ বর্গকিলোমিটার। অঞ্চলটি মধুপুর এলাকার লাল ল্যাটারাইটীয় মৃত্তিকার প্রতিনিধিত্ব করে। অঞ্চলটি প্লাবন তলের উপরে অবস্থিত উঁচুভূমি, যা স্থানীয়ভঅবে ‘বাইদ’ নামে পরিচিত অসংখ্য ছোট ও বড় আকারের খাদ দ্বারা বিভক্ত। এই শ্রেণীর মৃত্তিকাতে অধিক পরিমাণে আয়রন ও এ্যালুমিনিয়াম আছে। পৃষ্ঠমৃত্তিকার পি.এইচ মানের পরিসর ৫.৫ থেকে ৬.০। ধনাত্মক আয়রন বিনিময় ক্ষমতা কম এবং মৃত্তিকা অধিক পরিমাণে ফসফেট বন্ধনে সক্ষম। মৃত্তিকাগুলোতে জৈব পদার্থ, নাইট্রোজেন, ফসফেট ও ক্যালসিয়ামের অভাব রয়েছে।

৫. হাওড় অববাহিকা:
এই নিম্নভূমি পশ্চিমে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, উত্তরে মেঘালয় মালভূমির পাদদেশ, পূর্বে সিলেটের উঁচু সমভূমি এবং দক্ষিণে পুরাতন মেঘনা মোহনায় প্লাবনভূমি দ্বারা বেষ্টিত। এই ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চলটিকে সিলেট অববাহিকা নামেও অভিহিত করা হয়। অসংখ্য হ্রদ (বিল) ও বৃহদাকৃতির জলাশয় (হাওর) দ্বারা ৫,০২৫ বর্গকিলোমিটারের এই হাওড় এলাকা গঠিত। এই
অবাহিকা অবনমনশীল এবং ভূতত্ত্ববিদের মতে এই অবনমন প্রক্রিয়া মধুপুর গড়ের উত্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিগত ২০০ বছরে এই এলাকা ৯ থেকে ১২ মিটার অবনমিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয় এবং বর্তমানেও তা সক্রিয় রয়েছে। এই অববাহিকা বর্ষাকালে গভীরভাবে প্লাবিত হয়ে থাকে। হাওড় অঞ্চলের পূর্বদিকের উচ্চভূমিকে স্থানীয়ভাবে টিলা বলা হয়ে থাকে, যথা-কৈলাস টিলা, ডুপি টিলা, এবং বিয়ানীবাজারের টিলাসমূহ সহ সিলেটের টিলাসমুহ সাধারণত প্লাইস্টোসিন যুগের কর্করীয় পলল
(elastic sediments) দ্বারা গঠিত এবং এদের সর্বোচ্চ উচ্চতা গড় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬০ মিটারের মতো। এ অঞ্চলে লোকবসতির ইতিহাস খুব প্রাচীন নয়। বিস্তীর্ণ নিন্মভূমির এলাকা হিসেবে এখানে চাষাবাদ প্রাচীনকালে হতো বলে জানা যায় না।

৬. সুরমা-কুশিয়ারা প্লাবনভূমি:
সিলেট অববাহিকার পূর্ব অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীসমূহ দ্বারা গঠিত এই প্লাবনভূমি। এর মোট আয়তন প্রায় ৪,৮৬৫ বর্গকিলোমিটার। সিলেট অঞ্চলের নিকটবর্তী কিছু ক্ষুদ্র পাহাড় এবং পাদদেশীয় এলাকাসমূহ এই প্লাবনভূমির অন্তর্ভুক্ত। সাধারণভাবে সুপ্রশস্ত শৈলশিরা ও অববাহিকা দ্বারা গঠিত একটি সুষম গঠনবিশিষ্ট ভূমিরূপ। শৈলশিরা এলাকায় প্রধানত
ভারি পলিগঠিত এবং অববাহিকা এলাকায় কর্দমগঠিত। প্রাক-মৌসুমি বায়ু, মৌসুমি বায়ু এবং মৌসুমি বায়ু উত্তর- এই তিন সময়কালেই এই প্লাবনভূমিতে আকস্মিক বন্যা সংঘঠিত হয়ে থাকে এবং অল্প সময়ের ব্যবধানে প্লাবন গভীরতার ব্যাপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। স্বাভাবিক প্লাবনমাত্রা শৈলশিরাসমূহে প্রধানত অগভীর এবং অববাহিকা এলাকায় গভীর
হলেও দীর্ঘস্থায়ী হয় না।

৭. মেঘনা প্লাবনভূমি
এই প্লাবিত অঞ্চলকে চারটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। এগুলো হলো

৭.১. মধ্য মেঘনা প্লাবনভূমি: মেঘনার মূল প্রবাহ থেকে ভৈরব বাজারের নিম্নাঞ্চলে গঙ্গা ও ধলেশ্বরীর প্রবাহের সঙ্গে মিলিত হওয়া পর্যন্ত নদীখাত মধ্য মেঘনা নামে অভিহিত হয়ে থাকে। মধ্য মেঘনা গঠিত প্লাবনভূমি একাধিক বিস্তৃত চর ও বহু প্রশস্ত সর্পিলাকার প্রবাহবিশিষ্ট নিচু অঞ্চল লক্ষ্য করা যায়। প্রায় দুই শতাব্দী পূর্বে ব্রহ্মপুত্র তার গতিপথ পরিবর্তন করে বর্তমান যমুনার গতিপথ বরাবর প্রবাহিত হওয়ার পুর্ব পর্যন্ত সময়ে গঠিত প্লাবনভূমির অংশবিশেষ এই প্লাবনভূমির অন্তর্ভুক্ত। এই প্লাবনভূমির পলল প্রধানত পলিকণা ও কর্দম সমৃদ্ধ। উত্তরের কিছু শৈলশিরার ঊর্ধ্বভাগে বালুকাময় ব্রহ্মপুত্র পলল বিদ্যমান। এই ভূমিতে মেঘনাসৃষ্ট মৌসুমি বন্যার মাত্রা প্রধানত গভীর। অববাহিকা এলাকাসমূহ শুরুতেই জলমগ্ন হয়ে পড়ে এবং পানি নিষ্কাশিতও হয় বিলম্বে। মধ্য মেঘনা প্লাবনভূমির মোট আয়তন প্রায় ৯৭২ বর্গ কিলোমিটারের বেশি নয়।

৭.২. নিম্নমেঘনা প্লাবনভূমি: পদ্মা ও মেঘনার সঙ্গমস্থল থেকে দক্ষিণমুখী মোহনার পূর্ব পর্যন্ত অংশকে নিম্ন মেঘনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই ভূমির আয়তন প্রায় ৭৯৭ বর্গকিলোমিটার। এখানে মেঘনা নদীর বাম তীরের পলি গঙ্গা, যমুনা এবং মেঘনাবাহিত মিশ্র পলল দ্বারা গঠিত। নদীতীরের নিকটবর্তী প্লাবনভূমিতে গঙ্গার পলি অনুপ্রবেশের কারণে সামান্য পরিমাণে চুনযুক্ত। স্থলভাগের অভ্যন্তরে পলল চুনবিহীন এবং এদের বেশিরভাগই পদ্মা নদী আড়িয়াল খাঁ নদী বরাবর গতিপথ থেকে ১৮৪০ সাল নাগাদ বর্তমানের নিম্নতর মেঘনা বরাবর প্রবাহিত হওয়ার পূর্বেই সঞ্চিত হয়েছে। এই প্লাবনভূমিতে অল্পসংখ্যক অনিয়মিত শৈলশিরা এবং অববাহিকা ধরনের ভূমিরূপ বিদ্যমান, কিন্তু অধিকাংশ এলাকাই ঢিবি আকৃতির এবং বসতি ও চাষাবাদে ব্যবহৃত। পূর্বে মৌসুমি প্লাবনমাত্রা ছিল পরিমিত পরিমাণে গভীর এবং দক্ষিণ অংশে দৈনিক দুবার জোয়ারভাটার কারণে এই গভীরতার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটত। বর্তমানে চাঁদপুর সেচ প্রকল্পের সুরক্ষিত ও নিষ্কাশিত এলাকাসমূহে বন্যার মাত্রা প্রধানত অগভীর এবং প্রধানত বৃষ্টির পানি দ্বারাই তা সংঘটিত হয়।

.৩. আদি মেঘনা মোহনাজ প্লাবনভূমি: অববাহিকা এলাকা এবং শৈলশিরা এলাকার মধ্যে উচ্চতার সামান্য পার্থক্য ছাড়া আদি মেঘনা মোহনাজ প্লাবনভূমি প্রায় সমতল। এই ভূ-প্রকৃতির দক্ষিণাংশে প্রাকৃতিক নদনদী এবং জলধারার উপস্থিতি না থাকায় খাল খনন করে নিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। এ অঞ্চলের মৃত্তিকা প্রধানত গভীর এবং পলিকণাসমৃদ্ধ, তবে কিছু কিছু অববাহিকার কেন্দ্রে মৃত্তিকা অগভীর কর্দমস্তর দ্বারা আবৃত থাকে। দক্ষিণ-পূর্বাংশে ব্যতীত সর্বত্র মৌসুমি বন্যার মাত্রা প্রধানত গভীর। অববাহিকার কেন্দ্রগুলোতে শুষ্ক ঋতু জুড়ে আর্দ্র অবস্থা বিরাজ করে। বাইরের নদীসমূহ যখন উচ্চমাত্রায় প্রবাহিত হতে থাকে সে সময়ে মূলত বৃষ্টিপাতের ফলে ভূভাগে সঞ্চিত পানি দ্বারা এই এলাকায় বন্যা সংঘটিত হয়ে থাকে। শুধুমাত্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নদ-নদীর (যেমন, গোমতী) আশপাশের প্লাবনভূমিসমূহ নদীর পানি দ্বারা প্লাবিত হয়। এই ক্ষুদ্র নদীগুলোই প্রায় ৭,৩৮৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের আদি মেঘনা মোহনাজ প্লাবনভূমিকে সংলগড়ব পাহাড় এবং পাদদেশীয় এলাকাসমূহ থেকে বিছিন্ন করেছে।

মেঘনা-মোহনা নবীন প্লাবনভূমি: মেঘনা নদীর মোহনা এবং তৎসংলগ্ন এলাকা জুড়ে বিস্তৃত সমতলপ্রায় ভূমি। মোহনা সংলগ্ন দ্বীপসমূহ এবং মূল ভূখণ্ড এলাকা এই প্লাবনভূমির অন্তর্গত। প্লাবনভূমির প্রান্তীয় এলাকায় বিরামহীন নব নব পলিসঞ্চয় ও ক্ষয়কার্যের ফলে ভূমির আকৃতি প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। এই প্লাবনভূমির বহু স্থানে মৃত্তিকার ঊর্ধ্বভাগ শুষ্ক মৌসুমে বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ত হয়ে পড়ে। তবে সকল অংশে এই ঘটনা ঘটে না। মৌসুমি প্লাবনমাত্রা প্রধানত অগভীর, তবে জোয়ার-ভাটার কারণে গভীরতা ওঠানামা করে। বৃষ্টিপাত অথবা নদ-নদীর স্বাদুপানির দ্বারাই মূলত এই বন্যা সংঘটিত হয়ে থাকে। মৌসুমি ঋতুতে অপ্রত্যাশিত উচ্চ জোয়ার-ভাটা অথবা ঘূর্ণিঝড়ের সময় সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের লবণাক্ত পানি এই অঞ্চলে বন্যার কারণ হয়ে থাকে। মেঘনা প্লাবনভূমির অধিকাংশ অঞ্চল, বিশেষ করে মোহনা ও নিম্ন মেঘনা প্লাবনভূমি ও তার আশে-পাশের ভূখণ্ডগুলি অনেকাংশে নবীন। প্রাচীন যুগের পরবর্তী সময়কালেও চাষবাসের উপযোগী ছিল না। গত ১০০০ বৎসরের মধ্যে কুমিল্লা থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত মেঘনা ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার পূর্ব দিকে সরে আসায় মেঘনার পশ্চিম তীরে একটি বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চরাভূমি গঠিত হয়েছে এবং পলি পড়ে পড়ে ভরাট হয়েছে। প্রাচীন যুগের মানুষের পদচারণার কোনো স্বাক্ষর এখানে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

৮. গাঙ্গেয় প্লাবনভূমিঃ
বাংলাদেশের যশোর ও কুষ্টিয়া জেলা এবং রাজশাহী, পাবনা, ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল ও ঢাকা জেলার অংশবিশেষ নিয়ে এই প্লাবনভূমি গঠিত। এর আয়তন প্রায় ২৭,০০০ বর্গকিমি নিয়ে। মূলত গঙ্গা নদীর তীর সংলগ্ন বিস্তৃত এলাকা নিয়ে গঠিত। সর্পিলাকার এই প্লাবনভূমি প্রধানত শৈলশিরা, অববাহিকা এবং পুরাতন নদীখাত সমন্বয়ে গঠিত। গাঙ্গেয় প্লাবনভূমি স্থানীয়ভাবে বর্তমান এবং পরিত্যক্ত নদীর গতিপথ বরাবর অনিয়মিতভাবে গড়ে উঠেছে।

ভূ-প্রাকৃতিক এই অঞ্চলটি আকৃতির দিক থেকে প্রায় ত্রিকোণাকার। এর দক্ষিণে রয়েছে গাঙ্গেয় জোয়ারভাটা প্লাবনভূমি। রাজশাহী, নাটোর, পাবনা, যশোহর ও কুষ্টিয়া ব্যতীত বাকি অঞ্চলে প্রাচীন যুগের শেষ দিকে এখানে জনবসতি ও রাষ্ট্রশক্তি গড়ে উঠে। সম্ভবত এই অঞ্চলেদেব বংশ ও চন্দ্র বংশের রাজারা প্রাচীন যুগের শেষ দিকে এখানে রাজত্ব করেছেন। শেষকালে সেন বংশের শাসনাধীনে আসে।

এই প্লাবনভূমিতে গঙ্গা নদী প্রতি বছর বন্যার সময় ভাঙ্গাগড়ার মাধ্যমে গতিপথ পরিবর্তন করে। ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার তুলনায় এই নদী কম চর সৃষ্টি করে। গাঙ্গেয় পলল চুনযুক্ত, তবে অধিকাংশ অববাহিকা কর্দম শ্রেণীর। কিছু পুরাতন শৈলাশিরার মৃত্তিকা উর্ধ্বস্তরে চুনমুক্ত। মৃত্তিকার পি.এইচ মানের পরিসর ৭.০ থেকে ৮.৫। মৃত্তিকাগুলো মাঝারি মানের উর্বরতাসম্পন্ন এবং এসব মৃত্তিকাতে ক্যালসিয়াম কার্বনেট বিদ্যমান এবং ফসফেট ও পটাশিয়ামের পরিমাণও বেশি।

অববাহিকাগুলোতে এবং অধিকাংশ শৈলশিরার শিখরদেশে প্রধানত দোআঁশ মৃত্তিকা এবং কখনও কখনও বালুকা মৃত্তিকার প্রাধান্য বিদ্যমান এই প্লাবনভূমির পশ্চিম এবং উত্তরভাগে মৌসুমি বন্যার মাত্রা প্রধানত অগভীর এবং উঁচু শৈলাশিরার শিখরদেশ স্বাভাবিক বন্যার আওতামুক্ত থাকে। তবে পূর্ব এবং দক্ষিণ দিকে বন্যা বেশি হয়। মূলত বৃষ্টিপাত এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর উত্থিত হওয়ার ফলে এই অঞ্চলে বন্যা সংঘটিত হয়ে থাকে। এই প্লাবনভূমি এবং এর নিকটবর্তী উপনদী খাতসংলগ্ন এলাকায় বর্ষা ঋতুতে নদীর প্রবাহমাত্রা বেড়ে গেলে অনেক সময় এর ব্যতিক্রম হয়ে থাকে। উত্তর-পশ্চিমের মহানন্দা প্লাবনভূমির কিছু বিচ্ছিন্ন এলাকা এই ভূ-প্রাকৃতিক অংশের অন্তর্ভুক্ত। তিস্তা ও গঙ্গার মিশ্র পলল দ্বারা সৃষ্ট সকল অনিয়মিত ভূ-প্রকৃতি নিয়ে মহানন্দা প্লাবনভূমি গঠিত। মেঘনা প্লাবনভূমির বিচ্ছিন্ন অংশসমূহ প্রধানত পলিমাটি দ্বারা গঠিত। মৌসুমি বৃষ্টিপাতের কারণে এই অঞ্চল প্লাবিত হয়ে থাকে। রাজশাহী, নাটোর, পাবনা ও যশোর জেলার বেশিরভাগ এলাকা, সমগ্র কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুরা জেলা; মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, বরিশাল, গোপালগঞ্জ, নড়াইল, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার অংশবিশেষ গাঙ্গেয় প্লাবনভূমির অন্তর্ভুক্ত।

গঙ্গার জোয়ারভাটা প্লাবনভূমি:
স্রোতযুক্ত নদনদী
(tidal rivers) ও খাড়ির (crecks) সমন্বয়ে দাবার ছক-কাটা ঘরের মতো কর্তিত অনুচ্চ শৈলশিরা এবং অববাহিকা নিয়ে গাঙ্গেয় জোয়ারভাটা প্লাবনভূমি গঠিত। স্থানীয় ভূমির উচ্চতার পার্থক্য সাধারণত ১ মিটারের কম, কিন্তু গাঙ্গেয় প্লাবনভূমিতে এই পার্থক্য ২ থেকে ৩ মিটারের মতো। ভূমি গঠনকারী পলল প্রধানত চুনবিহীন কর্দম জাতীয়, তবে নদীতীরসমূহে এবং পূর্বদিকে অপেক্ষাকৃত নিচু মেঘনা প্লাবনভূমি সংলগ্ন স্থানান্তরিত অঞ্চল পলিকণাসমৃদ্ধ এবং সামান্য পরিমাণে চুনযুক্ত। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী ও ভোলা জেলার অধিকাংশ এলাকা এবং সমগ্র ঝালকাঠি ও বরগুনা জেলা গাঙ্গেয় জোয়ারভাটা প্লাবনভূমির অন্তর্গত। তবে দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত সুন্দরবন এই প্লাবনভূমির বহির্ভূত।

গঙ্গা নদী সারা বছর উত্তর-পূর্ব এবং পূর্বদিকে স্বাদুপানি বহন করে। পশ্চিমের শুষ্ক মৌসুমে প্রায় সারা বছরই  লবণাক্ত পানি স্থলভাগের দিকে বা বছরের বেশিরভাগ সময় দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে ক্রমেই অনুপ্রবেশ করছে। গঙ্গার শাখানদীসমূহ এবং মেঘনা নদী উচ্চ প্লাবনমাত্রায় থাকায় বৃষ্টির পানি ভূভাগে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। ফলে উত্তর-পূর্বাংশে মৌসুমি ঋতুতে পরিমিত গভীরতার বন্যা সংঘটিত হয়। অন্যত্র সারা বছর অথবা মৌসুমি ঋতুতে ভরা জোয়ারের সময় প্রধানত অগভীর প্লাবন সংঘটিত হয়ে থাকে। তবে যে সকল বিস্তৃত এলাকায় বাঁধ বা পোল্ডার দিয়ে জোয়ারসৃষ্ট বন্যা প্রতিরোধ করা হয়েছে সে সকল এলাকা এর ব্যতিক্রম। উভয়ের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ এলাকা এবং পূর্বাংশের মাটি সারা বছর লবণমুক্ত থাকে, কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মাটি বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ত হয়ে পড়ে। সমুদ্রগর্ভ থেকে এই অঞ্চলটি সর্বশেষে উত্থিত হয়েছে।

সুন্দরবন অঞ্চল:
বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণাঞ্চলের ভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ০.৯১ মি. উঁচু। এই অত্যধিক নিম্নভূমি জুড়ে গড়ে উঠেছে সুন্দরবন। মোহনা এলাকা অত্যধিক নিচু থাকার পেছনে সম্ভবত দুটি কারণ রয়েছে। কারণ দুটি হলো
গঙ্গার শাখাসমূহ কর্তৃক অপর্যাপ্ত সঞ্চয়কার্য অথবা ভূ-অবনমন। গঙ্গার প্রধান শাখাসমূহের কোনোটিই কখনও এই অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হতো না। বরং ছোট ছোট কিছু শাখাই বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে সঞ্চয়কার্য করে আসছে। এই মোহনা এলাকার গঠনকার্য এখনও সম্পূর্ণ হয় নি। ধারণা করা হয় যে,সম্ভবত ভূ-অবনমন প্রক্রিয়া এই এলাকার অত্যধিক নিচু হয়েছে। এই এলাকার মধ্যভাগে শেখেরটেক ও বেদকাশি এলাকায় বৃহৎ ধ্বংসাবশেষের অস্তিত্ব রয়েছে। উল্লিখিত এলাকাসমূহে সমুদ্রপৃষ্ঠের অনেক নিচে নৃতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং গাছপালার গুঁড়ি পলি দ্বারা চাপা পড়ে গিয়েছে।

নিম্ন আত্রাই অববাহিকা:
৮৫৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ক্ষুদ্র ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চলটি আত্রাই এবং গঙ্গা নদীর মিশ্র পলি দ্বারা গঠিত। আত্রাই নদীর উত্তরের ভূমিরূপ প্রধানত সমতল, তবে নদীর দক্ষিণে অবস্থিত ভূ-প্রকৃতিতে প্লাবনভূমি শৈলশিরাসমূহ এবং সুবিস্তৃত অববাহিকা বিদ্যমান। মৃত্তিকা বৈশিষ্ট্যে ভারি কর্দমের প্রাধান্য রয়েছে। তবে দক্ষিণ এবং পশ্চিমের শৈলশিরাসমূহের মৃত্তিকা দোআঁশ প্রকৃতির। বর্ষায় যমুনার অতিরিক্ত প্রবাহ হুরাসাগর নদীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময়ে এই ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চলের নিষ্কাশন ব্যবস্থা আবদ্ধ হয়ে পড়ে। পূর্বে মৌসুমি বন্যার মাত্রা ছিল গভীর এবং চলন বিলের বিস্তৃত এলাকা সারা বছরই জলমগ্ন থাকত। পরবর্তীকালে ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পোল্ডার নির্মাণের ফলে এই এলাকার নিষ্কাশন ব্যবস্থা অনেকাংশেই উন্নতি লাভ করে। তা সত্ত্বেও কখনও কখনও স্থানীয়ভাবে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে কিংবা আত্রাই নদীতে অথবা বরেন্দ্রভূমির সংলগ্ন এলাকায় সৃষ্ট আকস্মিক বন্যা হয়।

আড়িয়াল বিল:
পদ্মা ও ধলেশ্বরী নদীর মাঝখানে এবং ঢাকার দক্ষিণে অবস্থিত প্রায় ১৩৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি অবভূমি। প্রায় সমগ্র এলাকাই ভারি কাদা দিয়ে আবৃত। দুটি বৃহৎ নদীখাত কাছাকাছি থাকার পরও বৃষ্টিপাতের সঞ্চিত পানি দ্বারা এখানে গভীর মাত্রায় মৌসুমি প্লাবন সংঘটিত হয়ে থাকে। কেননা নদীগুলোর প্রবাহ সে সময় পরিপূর্ণ থাকার কারণে তারা এই সঞ্চিত পানি নিষ্কাশন করতে ব্যর্থ হয়। শুষ্ক ঋতুতেও এই এলাকার বেশিরভাগ আর্দ্র থাকে। নিম্ন আত্রাই অববাহিকা ও আড়িয়াল বিল বাংলাদেশের প্রাচীনতম ভূখণ্ডের দ্বিতীয় স্তরে গঠিত। প্রাচীন যুগে এই এলাকা মানব বসতির উপযুক্ত ছিল না।

গোপালগঞ্জ-খুলনা পিট অববাহিকা:
গঙ্গা নদীর প্লাবনভূমি এবং গঙ্গার জোয়ার-ভাটাপ্লাবনভূমি এলাকার মধ্যে অবস্থিত একাধিক নিম্ন এলাকা নিয়ে গঠিত। এর আয়তন ২,৭৬৮ বর্গকিলোমিটার। এই এলাকার প্রধান দুটি বিল হচ্ছে বাঘিয়া বিল ও চান্দা বিল। আর্দ্র অববাহিকাসমূহ জুড়ে ভারি পীট মৃত্তিকা বিদ্যমান, তবে প্রান্তীয় এলাকায় এই মৃত্তিকা কর্দম দ্বারা আবৃত। বিল এলাকার উপর দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গার শাখানদীসমূহ বরাবর এলাকা বাংলাদেশের বৃহত্তম পিট মজুতকারী অববাহিকা। বর্ষায় এই অববাহিকা অঞ্চল বৃষ্টির পানির দ্বারা গভীরভাবে প্লাবিত হয়ে থাকে। খুলনার কাছাকাছি অবস্থিত বিলসমূহে বন্যার পানি ঈষৎ লবণাক্ত হয়ে থাকে। এই ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চলে ভূঅবনমন প্রক্রিয়া এখনও সক্রিয়। এই এলাকা সুন্দরবন অঞ্চলের অনুরূপ। প্রাচীন যুগে এখানে জনবসতি ছিল না।

৯. চট্টগ্রাম উপকূলীয় সমভূমি:
সমুদ্র উপকূল বরাবর চট্টগ্রাম জেলার সংকীর্ণ স্থান জুড়ে অবস্থিত এই ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চল। উত্তরে ফেনী নদী থেকে শুরু করে দক্ষিণে মাতামূহুরী নদীর বদ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত এ সমভূমি ১২১ কিমি দীর্ঘ। প্রস্থ ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার এবং কর্ণফুলি নদীর মোহনায় প্রায় ২৬ কিলোমিটার। পার্বত্য এলাকার কাছাকাছি এই ভূমি সুষম ঢালবিশিষ্ট পাদদেশীয় সমভূমি গঠিত হয়েছে। ফেনী, কর্ণফুলি, হালদা এবং অন্যান্য নদীর গতিপথ বরাবর গঠিত হয়েছে জোয়াট-ভাটা প্লাবনভূমি, উত্তরাংশে গঠিত হয়েছে নবীন মোহনাজ ক্ষুদ্র প্লাবনভূমি এবং দক্ষিণে সাগর উপকূল বরাবর গঠিত হয়েছে বালুকাময় উপকূলীয় শৈলশিরাভূমি। পার্বত্য এলাকায় কাছাকাছি পললের বৈশিষ্ট্য প্রধানত পলিকণাময় ও স্থানীয়ভাবে বালিসমৃদ্ধ এবং প্লাবনভূমি অববাহিকাসমূহে অধিকতর বিস্তৃত কর্দমবিশিষ্ট্য। সমগ্র মূল ভূখণ্ড আকস্মিক বন্যার শিকার। বন্যার মাত্রা প্রধানত অগভীর এবং বন্যার গভীরতা জোয়ার-ভাটা দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়। জোয়ারভাটার দৈনিক গড় ব্যবধান প্রায় ২ মিটার। শুষ্ক মৌসুমে জোয়ার-ভাটা এবং মোহনাজ প্লাবনভূমির মৃত্তিকা লবণাক্ত হয়ে পড়ে।

১০. উত্তর ও পশ্চিমের পাদদেশীয় সমভূমি:
উত্তর এবং পূর্বের পাহাড়সমূহের পাদদেশীয় সীমানা ঘেঁষে ঢালু প্রকৃতির এই পাদদেশীয় সমভূমি অবস্থিত। চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাহাড়সমূহের পাদদেশ সংলগ্ন একই প্রকার ভূমিকে চট্টগ্রাম উপকূলীয় সমভূমির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পলি দ্বারা গঠিত এই সমভূমি পাহাড়ের কাছাকাছি এলাকায় প্রধানত পলিকণা অথবা বালুকাময় অবক্ষেপণ দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। আশেপাশের প্লাবনভূমির নিকটবর্তী অববাহিকাসমূহে কাদার প্রাধান্য রয়েছে। সমগ্র এলাকা বর্ষা ঋতুতে আকস্মিক বন্যার শিকার হয়ে থাকে। উচ্চতর অংশে সংঘটিত বন্যা প্রধানত অগভীর এবং থেকে থেকে সংঘটিত হয়, তবে অববাহিকা এলাকায় বন্যার মাত্রা অল্প গভীর থেকে গভীরতর হয়ে থাকে। এই ভূ-প্রকৃতির আওতায় রয়েছে শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার বেশিরভাগ এলাকা, সিলেট অঞ্চলের তাহিরপুর বিশ্বম্ভরপুর, দোয়ারাবাজার, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, মাধবপুর, হবিগঞ্জ, সদর, চুনারুঘাট, শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ এবং কুলাউড়া, ভূ-প্রাকৃতিক এককটির আয়তন প্রায় ৪,০৬৬ বর্গকিলোমিটার। এই প্লাবনভূমির উচ্চতা, আকার ও আয়তন সময়ের পরিক্রমায় কিছু কিছু পরিবর্তন হচ্ছে। পলিবাহিত পানি দ্বারা ভূমি ক্রমাগত ভরাট হচ্ছে। ভরাট হওয়ার ফলে দেশের জলবায়ুতে পরিবর্তন লক্ষণীয়। ঐতিহাসিক যুগের প্রারম্ভিককালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, বায়ুর আর্দ্রতা, পানিতে পলির পরিমাণ বর্তমানে অনেক কমে গেছে। অপরদিকে উচ্চভূমিতে বরফের স্তর কমতে থাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

১১. উপকূলীয় লবণাক্ত অঞ্চল:
বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম জেলার অংশবিশেষ নিয়ে এই অঞ্চলটি গঠিত। এই এলাকার অন্তর্ভুক্ত ভূমির পরিমাণ প্রায় ২০,০০০ বর্গ কিমি। এটি উপকূলীয় বলয় বরাবর এবং মোহনাজ দ্বীপমালার সমতল নিচু এলাকার প্রতিনিধিত্ব করে। মৃত্তিকাগুলো লবণাক্ত এবং পি.এইচ মান নিরপেক্ষ থেকে মৃদুক্ষারীয়। মৃত্তিকাগুলোতে পটাশ ও ফসফেটের পরিমাণ বেশি। এই অঞ্চলেই সুন্দরবন অবস্থিত।

১২. পার্বত্য চট্টগ্রামেরে পাহাড়ী অঞ্চল:
পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পূর্বেকার বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার গারো পাহাড় নিয়ে গঠিত। পাহাড় অঞ্চলে প্রায় ১৫,০০০ বর্গ কিমি এলাকা অন্তর্ভুক্ত। মৃত্তিকাগুলো শক্ত লাল এঁটেল ও সেই সঙ্গে একই রঙের মিহি বালির মিশ্রণ দিয়ে গঠিত এবং মৃত্তিকাতে বিদ্যমান গুটিগুলোতে অধিক পরিমাণে সেসকুইঅক্সাইড
(sesquioxides) থাকে। মৃত্তিকাগুলো মধ্যম থেকে তীব্র এসিডীয়। মৃত্তিকাতে অধিক ক্ষালিত এবং স্বাভাবিক উর্বরতামাত্রা কম। পাহাড়গুলো সাধারণত প্রাকৃতিক ও আবাদি বনবৃক্ষের অধীনে অবস্থিত। স্থানান্তর প্রথায় চাষও কোনো কোনো এলাকায় করা হয়।


সূত্র:
ভূগঠন বিদ্যা। বিধানচন্দ্র মন্ডল ও আসম উবাইদ উল্লাহ।
কোয়াটারনারি এবং বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক ক্রম বিকাশ/ মোঃ হোসেন মনসুর।
Geological Survey of Bangladesh বকর, এম এ
Holcene Sea-Level Changes Along the Maiskhali & Cox’s Bazar./Hossain Mansoor
Tectonics of Bengal Basin/Sikder, A.M