বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি

বাংলাদেশ অখণ্ড বঙ্গদেশের একটি অংশ। বাংলাদেশের মোট আয়তন ৫৬,৯৭৭ বর্গমাইল বা ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটার। এই অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতির বর্ণনায় অত্যন্ত স্বাভাবিকভভাবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, গারো পাহাড়ি অঞ্চল, সিলেট-সংলগ্ন পাহাড়ি অঞ্চল এবং ত্রিপুরার কথা চলে আসে। সর্বোপরি এই ভূখণ্ড তৈরির সাথে জড়িয়ে আছে হিমালয় পর্বতমালার উত্থান এবং নেপাল ও তিব্বত উপত্যাকা সৃষ্টির বিষয়। তাই এসব নিয়েই বাংলদেশের ভূপ্রকৃতি আলোচনা করা হলো।

বাংলাদেশে ভূ-প্রকৃতির কালানুক্রমিক প্রক্রিয়া:
সামগ্রিকভাবে বিচার করলে পৃথিবীর অন্যান্য ভূখণ্ডের মতোই এর সৃষ্টি রহস্য জড়িয়ে আছে পৃথিবী সৃষ্টির রহস্যের ভিতরে। পৃথিবী সৃষ্টির সূত্রে ধরেই এই অঞ্চলের ভূমি গঠন প্রক্রিয়াকে ৫টি ধাপে ভাগ করা যায়। এই ভাগগুলো হলো

প্রথম ধাপ : প্রাগ-হিমালয়সৃষ্ট যুগ:
বিগব্যাং -এর সূত্রে বলা হয়ে থাকে, ১৩.৭৯৮± ০.০৩৭০০ কোটি বৎসর আগের একটি বিশাল বস্তুপিণ্ডের বিস্ফোরণের ফলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তৈরি হয়েছিল। আর আমদের সৌরজগত তৈরী হয়েছিল ৫০০ থেকে ৪৬০ কোটি বৎসর আগে। তখনকার পৃথিবী ছিল একটি সুবৃহৎ গ্যাসের গোলক। ৪৫০ কোটি বৎসরের ভিতর গ্যাসীয় গোলক ঠাণ্ডা হয়ে পৃথিবীর উপরিভাগে কঠিন ত্বকের সৃষ্টি হয়েছিল। অজস্র অগ্ন্যুৎপাত, ঝড়, কঠিন ভূমির পরস্পরের ঠোকাঠুকিতে ভূখণ্ডের ভাঙাচোরা চলেছিল কোটি কোটি বছর ধরে।

একসময় ক্রমবিবর্তনের ধারায় সৃষ্টি হয়েছিল আদি সমুদ্র এবং মহাদেশগুলো। প্রায় ৩৫ কোটি ৬০ লক্ষ বৎসর আগে প্যালোজোয়িক (Paleozoic) যুগের কার্বোনিফেরাস (Carboniferous) অধিযুগ-এ ভারতীয় পাত গভীর অরণ্যে ঢাকা ছিল। কালক্রমে এই অঞ্চল মাটির নিচে চাপা পড়ে গেলে গাছগুলো কয়লায় পরিণত হয়।

পৃথিবীর মহাদেশ ও তার ক্রমবিবর্তন-এর ধারায় জানা যায়, ৩৮ কোটি বৎসর আগে ওল্ডেরিয়  নামক প্রাচীন মহা-মহাদেশ বিভাজিত হয়ে যায় এবং নতুনভাবে সজ্জিত হতে থাকে। এরই ভিতরে ৩৬ কোটি বৎসর আগে কারু বরফযুগের সূচনা হয়েছিল এবং শেষ হয়েছিল ২৬ কোটি বৎসর পূর্বে। দক্ষিণ আফ্রিকার কারু (Karoo) অঞ্চলে এই বরফযুগের সুষ্পষ্ট নমুনা পাওয়া গিয়েছিল। এই কারণে এই বরফযুগকে কারু বরফযুগ বলা হয়। বরফ-শীতল পৃথিবীতে ৩০ কোটি বৎসর আগে জন্ম নিয়েছিল ইউরোমেরিকা নামক একটি মহাদেশ। একই সময় একটি বড় মহা-মহাদেশ তৈরি হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন প্যাঙ্গিয়া ২৯ কোটি ৯০ লক্ষ বৎসর আগে পার্মিয়ান (Permian) যুগের সূচনা হয়েছিল আর শেষ হয়েছিল ২৫ কোটি ১০ লক্ষ বৎসর আগে।

মেসোজোয়িক যুগ-এর অন্তর্গত ট্রায়াসিক (Triassic) অধিযুগের শুরুতে (২৫ কোটি বৎসর আগে) এই বৃহৎ মহা-মহাদেশটি অখণ্ড ছিল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রক্রিয়া ছিল। মূলত ২০ কোটি বৎসর আগে উভয় মহা-মহাদেশটি স্পষ্টভাবে পৃথক ভূখণ্ড হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। মেসোজোয়িক যুগ-এর অন্তর্গত  জুরাসিক অধিযুগে (২০ কোটি বৎসর আগে) গোণ্ডোয়ানা উত্তর আফ্রিকা অংশের সাথে যুক্ত ছিল এ্যান্টাক্টিকা  পাত সঞ্চালন মতে, ভারতীয় পাতটি মূলত প্রাচীন গোণ্ডোয়ানা (Gondwana) মহাদেশের সাথে যুক্ত ছিল।

প্রায় ১৪ কোটি বৎসর আগে ভারতীয় পাত যুক্ত হয়ে যায় অষ্ট্রেলিয়া, এ্যান্টার্ক্টিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার সাথে। ৯ কোটি বৎসর আগে আবার ভারত উপমহাদেশ গোণ্ডোয়ানা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই সময় এই পাতের সাথে মাদাগাস্কার যুক্ত ছিল। পরে মাদাগাস্কার থেকে ভারতীয় পাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর ভারতীয় পাত বাৎসরিক ২০ সেন্টিমিটার গতিতে উত্তর দিকে অগ্রসর হয় এবং সেনোজোয়িক (Cenozoic) যুগের ঈয়োসিন (Eocene) অন্তযুগে অর্থাৎ ৫ কোটি ৫০ লক্ষ থেকে ৫ কোটি বৎসরের ভিতরে ভারতীয় পাত ইউরেশিয়ার পাতের সাথে যুক্ত হয়ে যায়।

দ্বিতীয় ধাপ: হিমালয় এবং তৎসংলগ্ন উচ্চভূমির সৃষ্টি
প্রাথমিক ভাবে
ভারতীয় পাতটি একটি মৃদু ধাক্কায় মিলিত হয়েছিল ইউরেশিয়ান পাতের সাথে। ঘটনাটি ঘটেছিল একালের নেপাল অঞ্চলের কাছাকাছি জায়গায়। এই ধাক্কায় তিব্বত উপত্যাকা এবং নেপালের উত্থান ঘটেছিল। এর পরপরই অপর একটি তীব্র ধাক্কায় হিমালয় উচ্চতর শৃঙ্গগুলোর উৎপত্তি ঘটেছিল। উল্লেখ্য ইউরেশিয়ান পাতের সাথে ভারতীয় পাতের ধাক্কার আগে, দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ অঞ্চল এবং আজকের ভারতবর্ষ ভারত মহাসাগরের পানির নিচে ছিল। হিমালয়, নেপাল এবং তিব্বত উপত্যাকা সৃষ্টির সময় ভারত মহাসাগরের দিকে পর্বতমালা সংলগ্ন বিস্তৃর্ণ এলাকায় উঁচু ভূমি তৈরি হয়েছিল। হিমালয় সংলগ্ন বঙ্গভূমিও তেমনটি ছিল।

তৃতীয় ধাপ: হিমালয়ের পাদদেশীয় প্লাবনভূমি
৫ কোটি ৫০ লক্ষ থেকে ৫ কোটি বৎসর আগে হিমালয়ের উত্থানের পর, ভারতীয় এবং ইউরেশীয় পাতের ধ্বংসাবশেষে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল
হিমালয়ের পাদদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। ক্রমে ক্রমে এই অঞ্চল প্রাথমিক সুস্থির দশায় পৌঁছাতে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছিল। এই সময় সাগরের পানি হিমালয়ের উচ্চভূমির পাদদেশ স্পর্শ করেছিল। ভিতরে প্রবল বৃষ্টিপাতের সূত্রে উচ্চভূমির মাটি এবং পাথরের কণা, বঙ্গীয় অববাহিকার মহাসাগরীয় ভূত্বকের উপর জমা শুরু হয়। ফলে এই উচ্চভূমি সংলগ্ন সাগরের নিমজ্জিত অংশ অগভীর জলাশয়ে পরিণত হতে থাকে। উচ্চভূমি থেকে জলবাহিত উপকরণের সূত্রে সিলেট এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে চুনাপাথর জমা শুরু হয়। এই সময় থেকে এই বঙ্গীয় অববাহিকা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ইয়োসিন অন্তঃযুগের শেষ সময়ে সামুদ্রিক পশ্চাদগমন আরো ব্যাপকভাবে সংঘটিত হয়। এর ফলে কোপিলি শেল স্তরের (Kopili shale formation) উৎপত্তি হয়েছে। উল্লেখ্য কোপিলি শেষ স্তরের পুরুত্ব ১৫০ মিঃ পর্যন্ত পাওয়া গেছে বাংলাদেশের পশ্চিমাংশে এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে।

৩ কোটি ৭০ লক্ষ বৎসর পূর্বে সারা পৃথিবী থেকে সমুদ্রপৃষ্ঠ নেমে যায়। এই সময় প্রচুর পরিমাণে পললের অধঃক্ষেপণ হয বঙ্গীয় অববহিকায়। এক্ষেত্রে  দুই ধরনের পললায়ন ঘটেছিল। এর একটি হলো স্বল্প গভীর কার্বনেট ফেসিস (Carbonate facies) এবং অপরটি গভীর সামুদ্রিক ফেসিস (deep basinal facies)। এই সময়ে বঙ্গীয় অববাহিকার পূর্বদিকে বর্তমানে আরাকান-ইন্দো-বার্মা রেঞ্জ (Indo-Burma ranges) এর গঠন প্রক্রিয়া উৎপত্তি শুরু হয় এবং এই অঞ্চলে বিশাল পাহাড় শ্রেণিরও উৎপত্তি ঘটতে থাকে। ৩ কোটি ৪০ লক্ষ বৎসর থেকে ২ কোটি ৩০ লক্ষ বৎসর আগে ওলিগোসিন (Oligocene) অন্তঃযুগ বঙ্গীয় অববাহিকায় ভূ-আন্দোলনজনিত ঘটনায় আসাম থেকে দূরে সরে যায়। এই সময় বরাইল কাচার-মিকির পর্বতের উদ্ভব হয়। একই সময়েই আরাকান, ইওমা ভাঁজ অঞ্চল, শিলং ম্যাসিফ ও কাচার পর্বত পূর্ণতা লাভ করে। পরবর্তী প্রায় ২ কোটি বৎসর ধরে বঙ্গীয় অববাহিকার পূর্বাঞ্চলে নানারকম পরিবর্তন ঘটে। এই সময় ইন্দো-বার্মা রেঞ্জে পর্বতমালার উত্থান হতে থাকে। ৫৩ লক্ষ বৎসর আগে সৃষ্ট ইন্দো-বার্মা রেঞ্জ পশ্চিমদিকে ধাবিত হয় এবং বার্মা প্লেটের সঙ্গে ধাক্কা লাগতে শুরু করে। ফলে মাইওসিন অন্তঃযুগ (৫৩-২ লক্ষ বৎসর) সময়েই বঙ্গীয় উপত্যাকায় সঞ্চিত পললে ভাঁজ পড়া শুরু হয়। এর ভিতর দিয়ে বঙ্গীয় উপত্যাকায় ভূ-আন্দোলন প্রক্রিয়া পূর্ণতা লাভ করতে শুরু করে। এই সময়ে হিমালয় পর্বত গঠন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হতে থাকে। শিলং ম্যাসিফ-এর উর্ধ্বক্ষেপণ হয় এবং আঞ্চলিক ডাউকি চ্যুতির (regional dauki fault) সৃষ্টি হয়। প্লিয়োসিন এবং মাইয়োসিন বঙ্গীয় উপত্যাকার পূর্ব-উত্তর দিকে এবং পূর্বদিকে যে বিপুল পরিমাণে পললায়ন ঘটেছিল, তা ভাঁজগঠন, চ্যুতিগঠন ও অভিক্ষেপ হতে শুরু হয়। এই সময়েই ভারতীয় পাত উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসরমান ছিল। অন্যাদিকে বার্মা পাত পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। একসময় উভয় পাতের মধ্যে কয়েক দফা সংঘর্ষ ধাক্কা লাগে। এর ফলে ভারতীয় পাতে ত্রিভুজাকৃতির কৌণিক দিকটা উত্তরের উপহিমালয়ের পাদদেশে সম্মুখ গভীরের (Sub-Himalayan foredeep) সাথে ধাক্কা খায়। কিন্তু ভারতীয় পাত দক্ষিণ দিকে বিশাল অংশ তখনও প্রবহমান থাকে এবং এটির দক্ষিণ প্রান্ত পূর্বদিকে ঘড়ির কাঁটার বিপরীতমুখী ঘূর্ণায়মান গতি সৃষ্টি করে এবং পূর্বদিকের পশ্চিমে এগিয়ে আসা বার্মা পাতের সাথে ঘূর্ণনগতির সৃষ্টি করে। এর ফলে বঙ্গীয় উপত্যাকয় উঁচু-নিচু ভূমির সৃষ্টি হয়। 

বঙ্গীয় উপত্যাকয় উত্তরপর্বাংশে ও পূর্বাংশে অবস্থিত পাহাড়শ্রেণীর উৎপত্তি কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়। প্রথম ধাপে চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরা মিজোরাম এলাকায় বেশ কিছু সংখ্যক উত্তর-দক্ষিণ বরাবর বিস্তৃত ভাঁজ এলাকার সৃষ্টি হয়। এই সংকোচনের তীব্রতা পশ্চিম দিকের চেয়ে পূর্বদিকের বেশি ছিল। পূর্বাংশের ভাঁজ এলাকার ভিতরে জলপানি, কাসালং, শিশক, মউডক, বান্দরবানে  ঊর্ধ্বভাঁজের তীব্রতা অনেক বেশি ছিল। এসব ঊর্ধ্বভাঁজের প্রায় উভয় ধারের বাহুতে লম্বালম্বি অভিক্ষেপ চ্যুতি রয়েছে এবং প্রচুর পরিমাণ স্থানীয় আড়াআড়ি চ্যুতি রয়েছে। কিন্তু পশ্চিমদিকের উর্ধ্বভাঁজ যেমন সেমুতাং সীতাকুণ্ড, পটিয়া, নীলা, ইনানী ঊর্ধ্বভাঁজের তীব্রতা তত বেশি নয়। এগুলোকে বক্স প্রকৃতির মৃদু ভাঁজ বলে। প্লেট সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট সংকোচনের প্রথম ধাপে এই ভাঁজ অঞ্চল সৃষ্টি হয়।বান্দরবান, গিলাছড়ি, সিতাপাহাড়, চ্যাংগুতাং, বড়মুড়া উর্ধ্বভাঁজের অবস্থান একই রেখা বরাবর রয়েছে। এদের স্তরতত্ত্ব ও ভূ-গঠনও প্রায় একই রকমের।

চতুর্থ ধাপ: বরফযুগ
প্লেইস্টোসিন (Pleistocene) অন্তঃযুগ (২৫ লক্ষ ৮৮ হাজার থেকে ১১ হাজার বৎসর পূর্ব-কাল) -এর গেলাসিয়ান আমল (Gelasian age)-এর শেষের দিকে ১৮ লক্ষ ৬ হাজার বৎসর আগে পৃথিবীর শেষ বরফযুগের সূচনা হয়েছিল। পরবর্তী গ্যালাব্রিয়ান আমল (Calabrian age) আমলে সারা পৃথিবী জুড়ে শৈত প্রবাহের সৃষ্টি হয়েছিল। এই আমলকে কোয়াটার্নারি বরফযুগের প্রথম ধাপ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই সময় ভূপৃষ্ঠের উঁচু স্থানগুলোতে বরফ জমা শুরু হয়। ৭ লক্ষ ৮১ হাজার বৎসর আগে। এই আমলের শেষ হয়। এরপর শুরু হয় কোয়াটার্নারি বরফযুগের আয়োনিয়ান আমল (Ionian age)। এই আমলকে বলা হয়  কোয়াটার্নারি বরফযুগের মধ্য ধাপ। এই ধাপে সমুদ্রের পানি বরফ আকারে স্থলভাগে জমা হওয়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠ সর্বনিম্ন অবস্থানে পৌঁছে যায়। সে সময়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বর্তমান সময়েরউচ্চতার চেয়ে প্রায় ১৩০ মিটার নিচে ছিল। কোয়াটার্নারি বরফযুগের শেষ ধাপ সম্পন্ন হয় টারান্টিয়ান আমল (Tarantian age) -এ। এই আমলের শেষ হয় ১২ হাজার থেকে ১১ হাজার ৭ শত বৎসর বা  আগে। এই বরফযুগ চলাকালে তৈরি হয়েছিল হিমালয়ের পাদদেশের উচ্চভূমিসংলগ্ন ভূমিসমূহ। এর ভিতরে রয়েছে বাংলাদেশের  উত্তর-পশ্চিমাংশের বরেন্দ্রভূমি, মধ্যভাগের মধুপুর ও ভাওয়ালের গড়, কুমিল্লার লালমাই পাহাড়।

উষ্ণকাল শুরু হয় হোলোসিন (
Holocene) অন্তঃযুগে। এর সময়কাল মোটামুটিভাবে ১২ হাজার বৎসর পূর্বাব্দ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বরফযুগের শেষে হিমালয়ে জমে থাকা বিশাল বরফের স্তর গলে তৈরি করে পানির ধারা। এছাড়া মৌসুমি বায়ুর অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের পানি একযোগে প্রচণ্ড বেগে বঙ্গীয় অববাহিকায় সংকীর্ণ নদী দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। এই প্রবাহে সংকীর্ণ নদীগুলো প্রসারিত হয় এবং পার্শ্ববর্তী প্লাবনভূমিতে উপচে পড়ে। বরফ গলা পানি ও মৌসুমি বায়ুর তীব্র মাত্রার এ প্রবল ঢল বঙ্গীয় অববাহিকায় উপর দিয়ে দক্ষিণে প্রবাহিত হতে থাকলে লালমাটির প্লাবনভূমির নিচু এলাকা বিশাল নদীতে রূপান্তরিত হয়। উত্তর-দক্ষিণ লম্বালম্বি ভূখণ্ডগুলো উত্তর-দক্ষিণ স্রোতধারাই নির্দেশ করে। এ সকল ভূখণ্ডের পার্শ্বে প্রবল স্রোতের আবর্ত তৈরি করে বিরাট গভীর খাদ। হিমালয়ের পাদদেশে হিমযুগে জমে উঠা মোরেন ও টিল (হিমকর্দ) প্রবল স্রোতের টানে দক্ষিণ দিকে বিস্তৃত হতে থাকে। স্রোতের প্রবল টানে দক্ষিণে বহুদূর পর্যন্ত নদীতল দিয়ে গড়াতে গড়াতে আসে। দহগ্রাম থেকে পঞ্চগড় পর্যন্ত বিশাল এলাকায় জমে উঠে মোটা বালি ও নুড়িপাথরের অসংখ্য বিশাল স্তর গড়ে উঠে এই সময়। এই সময়ে স্রোতের প্রবল টাএন বহু গাছপালা নদীগর্ভে নিমজ্জিত হয়। তাই ঐ সময়ের বালি ও নুড়িপাথরের স্তরে এবং তৎকালীন অবক্ষেপের মধ্যে পাওয়া যায় বিরাট কাষ্ঠখণ্ড বা আস্ত গাছ। কার্বন-১৪ পদ্ধতিতে নির্ণীত এ সকল গাছের বয়স হোলোসিন সময় নির্দেশ করে। ঠাণ্ডা থেকে উষ্ণ আবহাওয়ার এ রূপান্তরে সাগরপৃষ্ঠ দ্রুত উপরে উঠতে থাকে। ফলে বাংলা বেসিনের উপরে প্রবাহিত নদীর স্রোতের গতিতে বিরাট পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ উপরে উঠায় খরস্রোতা নদী হয়ে উঠে মন্থর বা ধীরগতিসম্পন্ন। নদী উপত্যকা ও প্লাবন ভূমির ক্ষয়িত অংশগুলো ভরে ওঠে নতুন নতুন তলানি দ্বারা। এই পরিবর্তিত আবহাওয়ায় লালমাটির ক্ষয়িত অংশে বা ক্ষয়িত তলে জমে উঠা নব অবক্ষেপই হলো হলোসিন শ্রেণির ভূমি। রহনপুর, চলনবিল, বোয়ালমারি সংঘসমূহের ভূমি এই প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠেছিল।

পঞ্চম ধাপ: নবীন প্লাবন ভূমি:
হোলোসিন অন্তঃযুগে সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেলেও, বঙ্গীয় অববাহিকায় পলি জমে উঠা উচ্চ ভূমিকে প্লাবিত করতে পারে নি। বরেন্দ্র ও মধুপুর এলাকার লালমাটির ভূখণ্ডগুলোর কিছু নিচে ক্রমাবনতিতে পার্শ্ববর্তী প্লাবনভূমি সৃষ্টি হয়। প্রবল বৃষ্টিপাত এবং পাহাড়ি ঢলে মাটির লবণাক্ততা হ্রাস পায় এবং নদী ও বিলগুলো মিঠা পানিতে ভরে যায়। হলোসিন অবক্ষেপের নিচের তল অর্থাৎ বরেন্দ্র সংঘের উপরের তলের হাজার বছর আগে সাগরপৃষ্ঠে দেড় মিটার উপরে উঠলেও ক্ষয়িত তল তৎকালীন সমুদ্রপৃষ্ঠ অপেক্ষা আড়াই মিটার উঁচুতে ছিল। এই প্রক্রিয়া বাংলাদেশের মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলের ভূমির উত্থান হয়।

অন্যদিকে সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগের সমুদ্রপৃষ্ঠ বর্তমান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দেড় মিটার উপরে চলে আসে। ফলে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত সৈকত থেকে উন্নত পাহাড়গুলোর পাদদেশ পর্যন্ত সাগর জলে প্লাবিত হয়েছিল। কক্সবাজারের পূর্বদিকের এলাকা সে সময়ে সাগরের জলে প্লাবিত হয়েছিল। সে সময়ে সেন্টমার্টিন ও সোনাদিয়া দ্বীপগুলো সমুদ্রের পানির নিচে তলিয়ে যায়। মহেশখালি দ্বীপের পশ্চিমাংশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে সমুদ্রসৈকত পূর্বে অগ্রসর হয়। অবশ্য বোকাবিল পাহাড় ক্ষয় হয়ে যে বিরাট পাথর অবশিষ্ট থাকতো তা সমুদ্র সৈকতকে ক্ষয় থেকে রক্ষা করতো সে সময়। ইনানী এলাকার সৈকত তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তবে টিপামের পাহাড়ি সৈকতে এমন গোল পাথর বা বিরাট কংকর না থাকায়  পাহাড় ক্ষয়ের প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। ধারণা করা হয়, এ সকল বিপুল কংকর আধিক্য এলাকা কোনো পুরাতন নদীর তলদেশ ছিল। ওই নদীর দুই পাড় থেকে গড়িয়ে পড়া বিরাট কংকর নদীতলে জমা হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে সাগরের ক্ষয়সাধনে সকল বালিকণা সাগরগর্ভে চলে যাওয়ায় শুধু কংকরগুলোই রয়ে গেছে। হলোসিন সাগরপৃষ্ঠ নিচে নামায় মহেশখালি দ্বীপের পশ্চিমাংশে তৈরি হয়েছিল বিশাল লবণবিল। তবে সৈকত রেখার পূর্বাংশে আগের পাহাড়িয়া ভূমিরূপ রয়েই গেছে। হোলোসিন অন্তঃযুগে সাগরপৃষ্ঠ বর্তমানের চেয়ে উপরে উঠায় বঙ্গোপসাগরে জেগে উঠেছে। এসব দ্বীপের উপরিভাগ তখনও উচ্চ জোয়ারের নিচে ছিল। হলোসিন সময়ে অর্থাৎ প্রায় ৫,৫০০ বছর পূর্ব থেকে সাগরপৃষ্ঠ নিচে নেমে বর্তমান অবস্থানে আসায় ঐ সকল নিমজ্জিত দ্বীপ জেগে উঠে। হাতিয়া, কুতুবদিয়া, সন্দ্বীপ ইত্যাদি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

বাংলাদেশের বর্তমানে প্রতি বছর নদীর মাধ্যমে প্রায় ১৩৫০ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে যায়। এই পানির সাথে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন টন পলি সমুদ্রে পতিত হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গত ৫ হাজার বছরে কম করে হলেও ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার জায়গা এই পলির দ্বারা ভরাট হয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের সমতলে এসে গেছে। ধারণা করা হয় সুন্দরবন অঞ্চল এই পলির ভাগ তেমন প্রভাবিত করতে পারে নি।

বাংলাদেশের ভূমির ঢাল
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত তেতুলিয়ার উত্তরে বাংলাবান্দা সমুদ্রসীমা হতে ৯৭ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। এখান হতে সমভূমি অঞ্চল উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্বদিকে ক্রমান্বয়ে ঢালু এবং বঙ্গোপসাগর পাড় খেপুপাড়া পর্যন্ত প্রায় ৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ। সমুদ্রতীর থেকে ২৫ হতে ৫০ কি.মি. দূরে খুলনা-বরিশাল লক্ষ্মীপুর বরাবর সমভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে মাত্র ১.৫ মিটার উঁচু। অন্যদিকে মেঘনা অববাহিকা মোহনা হতে উত্তর-পূর্ব দিকে মেঘালয় সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত যার উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে অনূর্ধ্ব ৩ মিটারের মধ্যে। দেশের মাঝামাঝি কিছুটা উঁচু চত্বর ভূমি ব্যতিরেকে এ বিস্তীর্ণ সমভূমি অঞ্চলকে ঢালের তারতম্য হিসেবে মোট পাঁচ ভাগে করা যায়।

সমতল থেকে কিছুটা উঁচু চত্বরভূমিটিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়।

১. পূর্ব দিকের লালমাই টিলা এলাকা: লালমাই টিলা এলাকা কুমিল্লা শহরের পশ্চিম পার্শ্বে উত্তর-দক্ষিণে লম্বায় ১৫ কি.মি. এবং চওড়ায় ১ থেকে ৩ কি.মি.। এ টিলা সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে সর্বোচ্চ ৪৫ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত, যা পশ্চিম পার্শ্বে কিছুটা খাড়া।

২. মধ্যভাগের  মধুপুর গড়:
 মধুপুর গড় এলাকা বৃহত্তর ঢাকা, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলার প্রায় ৪১৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত। এভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গড়ে ৮ হতে ১৫ মিটার উঁচু এবং সর্বোচ্চ উচ্চতা ৩০ মিটার। এ চত্বরভূমি পূর্বদিকে কিছুটা ঢালু এবং পশ্চিম পার্শ্বে চ্যুতি নিয়ন্ত্রিত।

৩. পশ্চিম দিকের বরেন্দ্রভূমি: বৃহত্তর রাজশাহী, রংপুর, বগুড়া ও দিনাজপুর জেলার প্রায় ৯৩২০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত। এ চত্বরভূমি রাজশাহী এলাকায় ৩০ হতে ৪০ মিটার উঁচু এবং অন্যান্য এলাকায় ২০ হতে ৩৫ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। এ চত্বরভূমি পশ্চিমপার্শ্বে চ্যুতি নিয়ন্ত্রিত। নিচু জলাভূমির মধ্যে সুনামগঞ্জের মাটিয়ান হাওড়, মৌলভীবাজারের হাউল হাওড়, বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার চান্দা-বাঘিয়া বিল, খুলনার কোলামৌজা ও তেরখাদা বিল এলাকা এবং বৃহত্তর পাবনা-রাজশাহী এলাকার চলন বিল উল্লেখযোগ্য। গরান জলাভূমির মধ্যে রয়েছে বৃহত্তর বরিশাল, পটুয়াখালী ও বৃহত্তর খুলনা জেলার সুন্দরবন এলাকা এবং চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালি-চকোরিয়া গরান জলাভূমি।

উল্লিখিত ঢালের ব্যতিক্রম বৃহত্তর চট্ট্রগাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা। টেকনাফ হতে রামগড় পর্যন্ত উত্তর- দক্ষিণ হতে সামান্য উত্তর-পশ্চিম দিকে ঊর্ধ্বভাঁজ সমন্বয়ে গঠিত যার উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ৮০ মিটার থেকে সর্বোচ্চ ১২৪৩ মিটার পর্যন্ত।১৯ এ পাহাড়ি অঞ্চল ভারতের ত্রিপুরার মধ্য দিয়ে ক্রমশ উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে প্রসারিত। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের নিকট চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়া সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ৩৫১ মিটার উঁচু এবং সিলেটের হারারগজ পাহাড়ের চূড়া ৩৩৫ মিটার উঁচু। এছাড়া রয়েছে বৃহত্তর সিলেটের জাফলং হতে শেরপুর জেলার উত্তরাংশে যমুনা নদীর পূর্ব পাড় পর্যন্ত সীমান্ত এলাকায় পূর্ব-পশ্চিমে প্রলম্বিত বিচ্ছিন্ন টিলাসমূহ। এ টিলাগুলোর মধ্যে সিলেটের জাফলং এলাকায় টিলার সর্বোচ্চ উচ্চতা ৬১ মিটার। কক্সবাজার হতে টেকনাফ পর্যন্ত পাহাড়ি এলাকার পাদদেশে পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত অবস্থিত। এটি লম্বায় প্রায় ১৫০ কি. মি. এবং চওড়ায় ১ হতে ৪ কিঃ মিঃ পর্যন্ত বিস্তৃত।

দেখুন : বাংলাদেশের প্লাবনভূমি


সূত্র:
ভূগঠন বিদ্যা। বিধানচন্দ্র মন্ডল ও আসম উবাইদ উল্লাহ।
কোয়াটারনারি এবং বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক ক্রম বিকাশ/ মোঃ হোসেন মনসুর।
Geological Survey of Bangladesh বকর, এম এ
Holcene Sea-Level Changes Along the Maiskhali & Cox’s Bazar./Hossain Mansoor
Tectonics of Bengal Basin/Sikder, A.M