মহাদেশ
ইংরেজি:
continent

পৃথিবীর বৃহৎ অখণ্ড ও বিশাল স্থলভাগের সাধারণ নাম মহাদেশ। বর্তমানে পৃথিবীর স্বীকৃত মহাদেশের সংখ্যা ৭টি। এই মহাদেশগুলো হলো- এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ,
উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং এ্যান্টার্ক্টিকা। সুদূর অতীতে পৃথিবীর মহাদেশগুলো সংখ্যায় এবং আকারের একই রকম ছিল না।

মহাদেশ সৃষ্টির প্রাক্‌কথন
৪৬০ কোটি খ্রিষ্টাব্দকে বলা হয় পৃথিবীর সৃষ্টিকাল।
পৃথিবী এবং সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ হিসেবে স্থিতি লাভের সময়, পৃথিবী ছিল একটি উত্তপ্ত গ্যাসীয় গোলক। এরপর প্রথম ৭ কোটি বৎসর কেটে গিয়েছিল গ্যাসীয় পৃথিবী থেকে তরল পৃথিবী হয়ে উঠতে। বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর এই দশাকে বলে থাকেন উত্তপ্ত তরল পৃথিবী। এই সময় পৃথিবীর সাথে মঙ্গল গ্রহের আকারের অপর একটি তরলগ্রহের সংঘর্ষ ঘটেছিল। বিজ্ঞানীরা কিছু প্রমাণ সাপেক্ষে অপর তরল গ্রহটির নাম দিয়েছেন থেইয়া। ধারণা করা হয়, ৪৫৩ কোটি ৩০ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে সংঘটিত এই সংঘর্ষের ফলে পৃথিবীর একমাত্র গ্রহ চাঁদের সৃষ্টি হয়েছিল। এই সংঘর্ষের কারণে, পৃথিবীর উপরিভাগের বহুদূর পর্যন্ত প্রচুর তরলকণা ছড়িয়ে পড়েছিল। এই তরলকণা পৃথিবীকে ঘিরে একটি পুরু বলয় তৈরি করেছিল। এছাড়া পৃথিবীর উপরিতলের ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত চুম্বকক্ষেত্রের সৃষ্টি করেছিল। পৃথিবীর কেন্দ্রাঞ্চলে লৌহ-নিকেলের সমাবেশ ঘটার আগ পর্যন্ত এই চুম্বকক্ষেত্র বর্তমান ছিল। চন্দ্র সৃষ্টির এই সময়কে অনেক সময় বলা হয় ক্রিপ্টিয়া যুগ (Cryptic era)

৪৫০-৪৪০ কোটি খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দের ভিতরে পৃথিবীর তাপমাত্রা ছিল প্রায় ৬১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই অবস্থায় তরল পৃথিবীর নানা পদার্থের ক্রিয়া-প্রতিক্রয়ায় সৃষ্টি হয়েছিল, নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ। পরবর্তী সময়ে এ সকল পদার্থ খনিজ ও রূপান্তরিত শিলা গঠনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। এরূপ একটি খনিজ পদার্থ জিরকন (Zircon, ZrSiO4)। মধ্য অস্ট্রেলিয়ার জ্যাক হিলে প্রাপ্ত জিরকনের বয়স ধরা হয়েছে ৪৩৯ কোটি পূর্বাব্দ।

৪৪০-৪১৫ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে পৃথিবী, খনিজ পদার্থ-সহ নানা ধরনের রূপান্তরিরত শিলার প্রাথমিক দশায় ছিল। এই সময়ের ভিতরে পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রায় একই দশায় ছিল।

৪১৫-৪১০ কোটি খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দের ভিতরে তরল পৃথিবী তাপমাত্রা ৬১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে আসা শুরু হয়। ফলে তরল পৃথিবীর তারল্য কমতে থাকে। এই অবস্থায় লোহানিকেলের ভারীকণাগুলো কেন্দ্রে জমা হতে শুরু করে। এই সময় প্রায় ১.২২০ কিলোমিটার (৭৬০ মাইল) ব্যাসের গোলকের উপরিভাগের অংশের যখন ৫৪৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে এসেছিল। ফলে গোলকটির একটি অংশ লোহা নিকেলের তরল সঙ্কর দশায় পৌঁছেছিল। এই সূত্রে প্রায় ২,২৬৬ কিলোমিটার (১,৪০৮ মাইল) ব্যাপী একটি বলয় কেন্দ্রমণ্ডলে ঘিরে একটি ঊর্ধ্ব কেন্দ্রমণ্ডল তৈরি করেছিল। এই সময়ের তরল পৃথিবীর কেন্দ্রাঞ্চলের বাইরের তাপমাত্রা আরও কমে গিয়ে যখন ৯০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছে পৌঁছালো, তখন লোহা ও নিকেলের তারল্য অনেকটাই কমে গিয়েছিল। এর উপরিভাগের এই তাপমাত্রা যখন ৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে এলো,  তখন অক্সিজেন এবং সিলিকন, ম্যাঙ্গানিজ, লোহা, ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম এবং পটাশিয়ামের অক্সাইডসমূহ নিয়ে একটি বিশাল স্তর তৈরি হলো। মূলত ৯০০-৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের এই স্তরটিকে গুরুমণ্ডল (Mantle) বলা হয়।

৪১০-৪০০ কোটি খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দের ভিতরে পৃথিবীর আদিম আগ্নেয় শিলা, রূপান্তরিত শিলার সমন্বয়ে মহাদেশীয় উপকরণ আদি ক্র্যাটনসমূহ তৈরি হয়েছিল। একই সাথে বিপুল মেঘরাশি থেকে সৃষ্ট মহাবর্ষণের ফলে জন্ম নিয়েছিল আদি মহা-মহাসমুদ্র। আর সেই মহা-মহাসমুদ্রে তৈরি হয়েছিল জীবের আদিম উপকরণসমূহ। এই সময়ের ভিতরে তরল পৃথিবীর তাপমাত্রা ৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে এসেছিল। ফলে গুরুমণ্ডলের উপরিভাগে গলিত পাথরের স্তর তৈরি হয়েছিল। এই অংশটির উপাদানের তারল্য কমে গিয়ে কঠিন ও তরলের মধ্যবর্তী স্তরের দশায় পৌঁছেছিলে। অত্যন্ত নমনীয় চটচটে পদার্থ সমৃদ্ধ এই অঞ্চলের উপর থেকে অশ্মমণ্ডলের কঠিন শিলা স্তর সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত প্রায় ২০০ কিলোমিটার পুরু অশ্মমণ্ডল গড়ে উঠেছিল উত্তপ্ত কঠিন শিলা বা পাথর দিয়ে। এরই ক্রমধারায় সবার উপরে পৃথিবীর উপরিতল গঠিত হয়েছিল। এই উপরতলকেই বর্তমানে বলা হয় ভূত্বক।

পৃথিবীর আদিম খনিজ পদার্থ ও প্রস্তরের সমন্বয়ে ভূত্বকে বেশ দৃঢ়তা এসেছিল বটে, কিন্তু তার সকল জায়গায় সমান মজবুত ছিল না। ফলে এই আবরণ ভেদ করে বায়বীয় এবং গলিত পদার্থ বেরিয়ে আসতো। এটা ছিল হেডিন কালের একটি সাধারণ দৃশ্য। এর ফলে পৃথিবীর উপরিতলে সৃষ্টি হয়েছিল অসংখ্য আগ্নেয় স্তূপ। আর সমতল অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল লাভা এবং পাথুরের ভস্মরাশি। এই প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়েই ভূত্বক বিভাজিত হয়ে অসংখ্য ভূখণ্ড তৈরি হয়েছিল। এই সকল ভূখণ্ডের সীমানা ছিল গলিত পাথর বা ম্যাগ্‌মা। এই ফুটন্ত ম্যাগমাই উত্তপ্ত কঠিন ভূখণ্ডের নিচের দিকে জমাটবেধে আদিম   আগ্নেয় শিলা (Igneous rock) তৈরি করেছিল। এই কারণে এই শিলাকে বলা হয় পৃথিবীর আদিম শিলা। মূলত আদিম পৃথিবীর উপরি তলের কঠিন আবরণের ভিত্তি তৈরি হয়েছিল এই  আগ্নেয় শিলা দিয়ে। কিন্তু এই শিলার উপরের বিশাল বস্তুরাশির চাপ এবং সেই সাথে ছিল উচ্চ তাপমাত্রা। ফলে আগ্নেয় শিলা উপরিভাগে রাসায়নিক এবং ভৌত পরিবর্তন ঘটে এবং ধীরে ধীরে তা  রূপান্তরিত শিলা (Metamorphic rock) পরিণত হয়েছিল। ধারণা করা হয় রূপান্তরিত শিলা তৈরি ঘটনা ঘটেছিল ১৫০০ বার উচ্চ চাপে এবং ১৫০ থেকে ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। আগ্নেয়শিলা এবং রূপান্তরিত শিলার সমন্বয়ে ৪০০ কোটি খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে পৃথিবীর উপরিভাগ ঢাকা পড়ে গিয়েছিল।

হেডিন কালের শেষের দিকে আগ্নেয়শিলা ও রূপান্তরিত শিলার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য ভাসমান ভেলা। এই ভেলাগুলোর কোনো কোনটি একটি সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এরপর কাছাকাছি ভূখণ্ডের মাঝখানের ফাঁকা জায়গা ম্যাগ্‌মা দিয়ে পূর্ণ হয়ে সংযোজিত বড় ভূখণ্ডের সৃষ্টি করেছিল। এদের ভিত্তি ছিল শত কিলোমিটার পর্যন্ত। কোনো কোনোটির ভিত্তি গুরুমণ্ডল ছুঁয়ে গিয়েছিল। এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূখণ্ডগুলো সুদৃঢ় ভিত্তির উপর সংযোজিত হয়ে যে বৃহত্তর ভূখণ্ড তৈরি করেছিল, ভূতত্ত্বের ভাষায় এগুলোকে বলা হয়
ক্র্যাটন (Craton)। মূলত ক্র্যাটন তৈরির প্রক্রিয়া ঘটেছিল পরবর্তী আর্কিয়ান কাল পর্যন্ত। মূলত এর দ্বারা মহাদেশীয় পাত সৃষ্টির সম্ভবনা প্রকট হয়ে উঠছিল।

৪১০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে চাঁদ এবং পৃথিবীতে বহু মহাকাশীয় বস্তু উল্কাপিণ্ড হেনেছিল। এদের কোনো কোনোটির ব্যাস ছিল প্রায় ৫০০ কিলোমিটার। এই আঘাতসমূহের ফলে আঘাত করেছিল। হয়তো পৃথিবীকে এদের কিছু আঘাত সহ্য করতে হয়েছিল সে সময়। এর ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছিল ব্যাপকভাবে। পৃথিবীর বিভিন্ন সঞ্চিত জলরাশি বাষ্পীভূত হয়ে পৃথিবীর আকাশকে ঢেকে ফেলেছিল। এই মেঘে ছিল নানাবিধ গ্যাসীয় উপকরণ। বিশেষ করে পাথরের বাস্পও এর সাথে যুক্ত হয়েছিল। এই সময় সমগ্র পৃথিবীতে সূর্যের আলো প্রবেশের পথ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। এই মেঘ সৃষ্টির অল্প কিছুদনের মধ্যে পাথর এবং ভারিবস্তুর কণাগুলো বৃষ্টি ভূপৃষ্ঠে ঝরে পরেছিল। কিন্তু যথার্থ গ্যাসীয় মেঘ থেকে অবিরাম বর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল প্রায় ২ হাজার বছর ধরে। এই ভারি বর্ষণে ফলে ভূভাগে সৃষ্টি অজস্র নদী। প্রবল জলস্রোতে ভূভাগের বিভিন্ন অংশ ভেঙে বা ধুয়ে গিয়ে ছোটো বড় অজস্র সাগরের সৃষ্টি করেছিল।

৪০০ কোটি থেকে ৩৬০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পৃথিবীর তাপমাত্রা ছিল বর্তমান পৃথিবীর তাপমাত্রার প্রায় তিনগুণ। এই সময় ব্যাপক অগ্ন্যুৎপাত, এই তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছিল। অতিরিক্ত তাপমাত্রার ফলে ভূ-গোলকের উপরিতলের ম্যাগমা অপেক্ষাকৃত কম ঘন ছিল এবং ভূত্বক বেশ পাতলাও ছিল। অন্যদিকে মহাসাগরের তলদেশ অপেক্ষাকৃত বেশি শীতল থাকায়, সাগরতলের তরল ম্যাগমা দ্রুত শীতল হয়ে আগ্নেয়শিলাস্তরের পুরুত্ব বৃদ্ধি করেছিল।

জলে বা ডাঙায় পৃথিবীর উপরিতলের সবখানের ভূত্বকের নিচের ম্যাগমা থেকে উৎপন্ন বায়বীয় অংশ প্রবল গ্যাসীয় চাপের সৃষ্টি করেছিল। ফলে ভূত্বকের কোনো অংশ ফুলে উঠেছিল এবং এই সূত্রে ভূত্বকের কোনো কোনো অংশ থেকে অগ্ন্যুৎপাতের সৃষ্টি করেছিল। ভূত্বকের ফুলে ওঠা অংশের তলদেশের ম্যাগমা থেকে প্রবল বেগ বেড়িয়ে যাওয়ার সময় ফাঁকা জায়গা পূরণ করেছিল নিচের পাতলা ম্যাগমা। পরে এই ম্যাগমা শীতল হয়ে ভূত্বকের পুরুত্ব আরও বৃদ্ধি করেছিল। এর ফলে ভূত্বকে সৃষ্টি হয়েছিল উঁচু-নিচু কিন্তু সুদৃঢ় ভূখণ্ড। এই প্রক্রিয়া সমগ্র পৃথিবীর ভূত্বক জুড়ে ছিল বহু বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূখণ্ড সৃষ্টিতে সহায়তা করেছিল। এই প্রক্রিয়ার ভিতরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আগ্নেয়-দ্বীপে বার বার প্লাবিত ম্যাগমা এবং অগ্ন্যুৎপাতঘটিত ছাই ভস্মের অধঃক্ষেপের কারণে, জোড়া লেগে বড় ভূখণ্ড তৈরি করেছিল। এই সূত্রেই আর্কিয়ান কালের শুরুর দিকে ৪০০ থেকে ৩৭০ কোটি পূর্বাব্দের ভিতরে বহু প্রাক্-মহাদেশীয় ক্র্যাটন সৃষ্টি হয়েছিল। তবে ৪০০-৩৮৫ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে বড় ধরনের মহাদেশীয় ক্র্যাটন তৈরি হওয়াটা সম্ভব ছিল না। কারণ, এই সময়ে ভূত্বকের নিচের ম্যাগমা ছিল অনেক বেশি তরল। তাই আদি ক্র্যাটনগুলো দ্রুত সঞ্চালিত হতো। অনেক সময় পরস্পরের ধাক্কাধাক্কিতে এদের প্রান্তদেশ ভেঙে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হতো। কিন্তু অনেক ক্র্যাটন বা মহাদেশীয় ঢাল-ভূখণ্ডের ভিত্তি এই সময়ের ভিতরে তৈরি হয়েছিল।

ধারণ করা হয় ৪০৩ কোটি ১০ লক্ষ বৎসরের ভিতরে বিশালাকারের কানাডিয়ান ঢাল-ভূখণ্ডের একটি ক্যাটনের ভিত্তি তৈরি হয়েছিল। একে বলা হয় মহাক্র্যাটন। এই মহাক্র্যাটন থেকে ৩৯৬ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে কানাডিয়ান ঢাল-ভূখণ্ড (Canadian Shield) তৈরির প্রাথমিক প্রক্রিয়া শেষ হয়েছিল এবং ৩৯৩ কোটি পূর্বাব্দের ভিতরে এই ঢাল-ভূখণ্ডটি সুস্থির দশায় পৌঁছেছিল।

৩৯৫ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে পৃথিবী অনেকটা শীতল হয়ে পড়েছিল। এতদিনের উত্তপ্ত পৃথিবীর গ্যাসীয় অংশ আকাশে ঘন মেঘের সৃষ্টি করেছিল। একে বলা যায় অন্তঃহীন মেঘ। এই মেঘ পৃথিবীকে এতটা নিবিড়ভাবে ঢেকে ফেলেছিল যে, সে মেঘকে ভেদ করে সূর্যের আলো ভূপৃষ্ঠে এসে পৌঁছাত না। এরপর এলো মহাবর্ষণ, সেই সূত্রে এলো মহাপ্লাবন। জলের চাপ এবং  ভূত্বেকর বিশাল কঠিন অংশের চাপ সহ্য করতে না পেরে, পৃথিবীর ভূত্বকের বিশাল অংশ গভীরভাবে বসে গেল। আর গভীর খাদের শূন্যতা পূরণ করে দিল বৃষ্টিজাত শীতল তরল পদার্থ। আর অন্যান্য বন্ধুর ভূমির উপর দিয়ে জলপ্রবাহ অপেক্ষাকৃত নিচু ভূমির দিকে সঞ্চালিত হলো। ঝরে পড়া জলপ্রবাহ সৃষ্টি করলো অসংখ্য নালা। এই নালাগুলো হলো আমাদের শরীরের শিরা-উপশিরা বা গাছের শাখা-প্রশাখার মতো। এই সব নালার দ্বারা ভূত্বকে জলের সঞ্চার ঘটালো। ক্রমে জমে ওঠা জলরাশি দিয়ে তৈরি হয়েছিল পৃথিবীর আদি সমুদ্র। ডাঙার উপর দিয়ে প্রবাহিত জলধারায় মিশলো নানা ধরেনর ধরনের খনিজ উপাদান। ফলে বিশেষ করে নানা ধরনের লবণ সমাহারে মহাসাগরে জল হয়ে গেল লবণসমৃদ্ধ। এই ভাবে সৃষ্টি হয়েছিল আদি সমুদ্র। এর ভিতরে ৩৯২-৩৮৫ কোটি খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দের দিকে প্রচুর এবং ভারি উল্কাখণ্ডের পতন ঘটেছিল। আবার প্রবল বৃষ্টিও ছিল। এর ফলে অগভীর এবং ভাসমান স্থলভূমিতে ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল।

৩৮৫ কোটি খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দের দিকে ভূত্বকে রূপান্তরিত শিলা সৃষ্টির প্রক্রিয়া সচল হয়ে উঠেছিল। এই সময় গ্রিনল্যান্ডের ফসফেটসমৃদ্ধ খনিজ পদার্থের সৃষ্টি হয়েছিল। এছাড়া ক্ষুদ্র ক্র্যাটনগুলো যুক্ত হয়ে মহাকাশীয় ক্র্যাটন এবং মহাকাশীয় ঢাল-ভূখণ্ড ( Shield ) তৈরির প্রক্রিয়া চলছিল। ৩৮২ -৩৮০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে সৃষ্টি হয়েছিল বৃহত্তর রাশিয়া ইউক্রেইন ঢাল-ভূখণ্ড (Ukrainian Shield ) এবং ভোরোনেঝ মাসিফ (Voronezh Massif ) অঞ্চল। এর ভিতরে ইউক্রেইন ঢাল-ভূখণ্ডের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ১০০০ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ছিল ২৫০ কিলোমিটার। পক্ষান্তরে ভোরোনেঝ মাসিফ দৈর্ঘ্য ৮০০ কিলোমিটার এবং প্রস্থে ৩০০-৪০০ কিলোমিটার। ৩৮০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ফিকে এগুলো মিলিত হয়ে প্রথম মহাদেশীয় ক্র্যাটনের উদ্ভব হয়েছিল। এই সময় গ্রানাইড ব্লকও তৈরি হয়েছিল। এছাড়া ইউক্রেইন ঢাল-ভূখণ্ড এবং ভোরোনেঝ মাসিফ সংযুক্ত অবস্থায় পূর্ব ইউরোপীয় ক্র্যাটনের আদি রূপ লাভ করেছিল। এই নতুন রূপ লাভের সূত্রে ইউক্রেইন ঢাল-ভূখণ্ড এবং ভোরোনেঝ মাসিফের প্রাচীন পাথরগুলো ভূত্বকের আরো গভীরে প্রবেশ করে। ৩৭০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পশ্চিম গ্রিনল্যাণ্ডের আদি পাললিক শিলা উৎপন্ন হয়।   

৩৭০  কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দে দিকে কাপ্‌ভালা ক্র্যাটনের উদ্ভব হয়েছিল। এর আয়তন ছিল প্রায় ১২ লক্ষ বর্গকিলোমিটার। বর্তমানে এই ক্র্যাটন দক্ষিণ আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। ৩৬০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে পিলবারা ক্র্যাটনটি আদি দশা নিয়ে এর সাথে যুক্ত হয়ে যায়। উল্লেখ্য, পিলবারা ক্র্যাটন পূর্ণতা লাভ করেছিল ৩৬০ থেকে ২৭০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে। উল্লেখ্য পিলবারা ক্র্যাটন এখন পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার অংশ। উভয় ক্র্যাটনের মিলিত হয়ে তৈরি হয় পৃথিবীর প্রথম ভাল্বারা মহা-মহাদেশ

পৃথিবীর আদি মহা-মহাদেশ ভাল্বারা। খুব বেশি দিন এই মহামহাদেশ টিকে থাকতে পারে নি। পৃথিবীর মহাকাশীয় পাতগুলো সচল ছিল। এদের ধাক্কাধাক্কিতে সে মহামহাদেশ ভেঙে গেছে। আবার এই সময়ে বা পরবর্তী সময়ে আদি মহাসমুদ্রের বিভিন্ন অংশে ছোটো ছোটো ভূখণ্ড জেগে উঠছিল। তাদের সাথে যুক্ত-বিষুক্ত হয়ে ভূখণ্ডের মহাদেশীয় দশার বারবার পরিবর্তন ঘটেছে। আকারের বিচারে এগুলোর কোনো কোনোটির নাম দেওয়া হয়েছে, ক্ষুদ্রমহাদেশ, মহাদেশ ও মহা-মহাদেশ। নিচে এদের কালানুক্রমিক সূচি দেওয়া হলো।