অক্সিজেন
বানান বিশ্লেষণ: অ+ক্+স্+ই+জ্+এ+ন্+অ
উচ্চারণ:
ɔk.si.ɟen (অক্.সি.জেন্)
শব্দ-উৎস:
oxyz { ইন্দো-ইউরোপিয়ান ক্রিয়ামূল ak- তীক্ষ্ণ হওয়া, উত্থিত হওয়া> গ্রিক oxys (তীক্ষণ, অম্ল)>প্রাচীন ফরাসি oxys
+
gen {
গ্রিক genes (জন্ম, উৎপন্ন)> প্রাচীন ফরাসি gène= Oxygène । ফরাসি রসায়নবিদ নামকরণ করেন γόνος (-gοnos)= I produce (আমি উৎপন্ন করি)> ইংরেজি Oxygen> বাংলা অক্সিজেন
পদ: বিশেষ্য অর্থ: এক প্রকার বায়বীয়, অধাতব, বর্ণহীন, গন্ধহীন, স্বাদহীন, অদাহ্য, দ্বিযোজী মৌলিক পদার্থ
সমার্থক শব্দাবলি: অক্সিজেন, অম্লজান দহনবায়ু, প্রাণবায়ু।
 
প্রতীক O
রাসায়নিক সংকেত
O2
পারমাণবিক সংখ্যা ৮
যোজ্যতা ২
পারমাণবিক ভর ১৫.৯৯৯৪
গলনাঙ্ক : -২১৮.৭৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
স্ফুটনাঙ্ক : -১৮২.৯৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ইলেক্ট্রোন বিন্যাস 1s2 2s2 2p4
 

সুইডিশ বিজ্ঞানী কার্ল উইলহেম শীলে
(Karl Wilhelm Scheele) ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে এই গ্যাসটি আবিষ্কারক করেন।  তিনি এই গ্যাসের নামকরণ করেছিলেন আগ্নেয়বায়ু (Fire-air) । কারণ তিনি তাঁর পরীক্ষা থেকে প্রাথমিকভাবে জানতে পরেছিলেন যে, এই গ্যাসটি আগুন জ্বালাতে সহায়তা করে। পর এই গ্যাসটি সম্পর্কে তিনি Treatise on Air and Fire নামক একটি গবেষণাপত্র তৈরি করেন এবং ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দে তা প্রকাশ করার তাঁর প্রকাশককে দেন। কিন্তু ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশক এই গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেন নি। ইতিমধ্যে ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ১লা আগষ্ট ইংরেজ ধর্মযাজক যোসেফ্ প্রিস্টলে (Josheph Priestley) এই গ্যাসটি স্বতন্ত্রভাবে আবিষ্কার করেন। তিনি এর নামকরণ করেছিলেন dephlogisticated air । প্রিস্টলে এই গ্যাসটি সম্পর্কে ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন এবং তা ওই বৎসরেই প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধটির নাম ছিল এই গ্যাসটি সম্পর্কে ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন এবং তা ওই বৎসরেই প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধটির নাম ছিল An Account of Further Discoveries in Air । ফলে প্রাথমিকভাবে এই গ্যাসের আবিষ্কারক হিসাবে প্রিস্টলে-কে কৃতিত্ব দেওয়া হয়।

আবার ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসী বিজ্ঞানী পি. বায়েন
(P. Bayen) এই গ্যাসটিকে পৃথকভাবে শনাক্ত করতে সক্ষম হন, কিন্তু পরে তিনি অন্য গবেষণায় ব্যস্ত হয়ে পড়লে, এই গ্যাসটি সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানান নি। ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ফরাসী বিজ্ঞানী— ল্যাভয়সিয়ে (Antoine-Laurent Lavoisier) এই গ্যাসটি স্বতন্ত্র পরীক্ষার মাধ্যমে আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। কিন্তু তিনি স্বতন্ত্র গ্যাস আবিষ্কারের বিষয়টি তখনও প্রকাশ করেন নি। ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে প্রিস্টলে এই গ্যাসটি সম্পর্কে একটি ল্যাভয়সিয়-কে একটি পত্র লেখেন। এই চিঠি পড়ে ল্যাভয়সিয় তাঁর আবিষ্কৃত গ্যাসটির গুরুত্ব বুঝতে পারেন। পরে ল্যাভয়সিয় এই গ্যাসটি নিয়ে বিস্তর গবেষণা করে নাম দেন 'অক্সিজেন'। তিনি দুটি গ্রিক শব্দের সমন্বয়ে এই নামটি প্রস্তাব করেছিলেন। এই শব্দ দুটি হলো গ্রিক oxys (তীক্ষ্ণ, অম্ল)+ γόνος (-gοnos) I produce (আমি উৎপন্ন করি)। বিজ্ঞানী ল্যাভয়সিয়ে মনে করেছিলেন, অক্সিজেন সকল এ্যাসিডের একটি সাধারণ উপাদান। পরবর্তীকালে এই ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হলেও, অক্সিজেন নামটি রয়েই গছে। বায়ুমণ্ডলে এই গ্যাস মৌলিক ও যৌগিক উভয় রূপেই পাওয়া যায়। প্রাচীন ভারতীয় পণ্ডিতেরা মনে করতেন যে, এই বাষ্পের যোগেই অম্লরস জন্মে। একারণেই এর নাম অম্লজান (অম্ল হতে জান (জন্ম) যাহার/বহুব্রীহি সমাস)। যদিও এইরূপ ধারণা ঠিক নয়, কিন্তু নামটি এখনো প্রচলিত আছে।

এই গ্যাসটির ৩টি আইসোটোপ পাওয়া যায়। এর
16O আইসোটোপটি প্রকৃতিতে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়। মোট অক্সিজেনের মধ্যে এর পরিমাণ ৯৯.৭৫৯%। এই আইসোটোপে নিউট্রোন থাকে ৮টি। 17O আইসোটোপটির পরিমাণ ০.০৩৭%। এতে নিউট্রোন থাকে ৯টি। 18O আইসোটোপটির পরিমাণ ০.২০১%। এতে নিউট্রোন থাকে ১০টি।

এই গ্যাসটি স্বাভাবিক বায়ুমণ্ডলীয় চাপে এর গলনাঙ্ক ৫৪.৩৯ কেলভিন (-২১৮.৭৬ ডিগ্রী সেণ্টিগ্রেড, -৩৬১.৭৭ ডিগ্রী ফারেনহাইট) এবং স্ফুটনাংক ৯০.১৮ কেলভিন (-১৮২.৯৭ ডিগ্রী সেণ্টিগ্রেড, -২৯৭.৩৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট)  তরল ও কঠিন অক্সিজেনের রঙ নীলাভ। কঠিন অক্সিজেনের গঠনের দিক থেকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন-
ক. কঠিন দশা-১ : এর তাপগ্রহণের সীমা ৪৩.৭৬-৫৪.৩৯।
খ.  কঠিন দশা-২ : এর তাপগ্রহণের সীমা ২৩.৬৬-৫৪.৩৯।
গ.  কঠিন দশা-৩ : এর তাপগ্রহণের সীমা ২৩.৬৬।

এই গ্যাসটি পানিতে সামান্য পরিমাণ দ্রবীভূত হয়। ২০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড (৬৮ ডিগ্রী ফারেনহাইট) তাপে এক বায়ুমণ্ডলীয় চাপে— এক কিউবিক মিটার পানিতে অক্সিজেনের দ্রবীভূত হওয়ার পরিমাণ প্রায় ৪৫ গ্রাম। অক্সিজেন পানিতে দ্রবীভূত থাকে বলেই জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীরা শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া চালিয়ে বাঁচতে পারে। যে সমস্ত রশ্মির তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ১৯৩ ন্যানো মিটার থেকে কম (যেমন: অতি বেগুনি রশ্মি)— এইরূপ রশ্মির আঘাতে অক্সিজেনের অণু ভেঙে 'ওজোন' নামক অপর একটি গ্যাসের সৃষ্টি হয়।

বায়ুমণ্ডলে এই গ্যাস মৌলিক ও যৌগিক উভয় রূপেই পাওয়া যায়। মৌলিক পদার্থ রূপে এই গ্যাস বায়ুতে এবং পানিতে সামান্য পরিমাণ মিশ্রিত রয়েছে। সাধারণভাবে বায়ুমণ্ডলে ৪ ভাগ নাইট্রোজেনের সাথে ১ ভাগ মৌলিক অক্সিজেন মিশ্রিত অবস্থায় আছে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে এর পরিমাণ প্রায় ২১ ভাগ। যৌগরূপে পানি, বালি প্রভৃতিতে প্রচুর পরিমাণ অক্সিজেন রয়েছে। ভূত্বকের কঠিন স্তরের এটি একটি অন্যতম প্রধান উপাদান।

প্রকৃতিতে সবুজ বৃক্ষরাজি সালোক-সংশ্লেষণ পদ্ধতিতে প্রচুর পরিমাণ মৌলিক অক্সিজেন উৎপন্ন করে। পরীক্ষাগারে কৃত্রিম উপায়ে এই মৌলিক অক্সিজেন প্রস্তুত করা যায়। এর মধ্যে কয়েকটি পদ্ধতি হলো—

ক. অক্সিজেনবহুল যৌগসমূহের বিয়োজনের সাহায্যে।
খ.  পানির বিশ্লেষণ করে। পানিকে তড়িত বিশ্লেষণ করে হাইড্রোজেনের সাথে অক্সিজেন উৎপন্ন করা যায়।
গ. বায়ু থেকে অক্সিজেন পৃথকীকরণ।

তীব্র-তপ্ত স্বর্ণ, রৌপ্য, প্লাটিনাম ও প্যালেডিয়াম ধাতু অক্সিজেন শোষণ করে। আবার উক্ত ধাতুকে শীতল করলে অক্সিজেন মুক্ত হয়। অক্সিজেন নিজে জ্বলে না, কিন্তু অন্যকে জ্বলতে সাহায্য করে। জ্বলন্ত দ্রব্যের সংস্পর্শে এসে অক্সিজেনের রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনগুলি নিম্নরূপ।
১. ধাতুর বা অধাতুর সাথে যুক্ত হয়ে অক্সাইড উৎপন্ন হয়।
২. এ্যালকালির পটাসিয়াম পাইরোগ্যালেট দ্রবণ বা এ্যামোনিয়াযুক্ত কিউপ্রাস ক্লোরাইড দ্রবণ অক্সিজেন শোষণ করে। অনেক সময় আর্দ্র ফসফরাসও অক্সিজেন শোষণ করে।
শ্বাস গ্রহণকালে বায়ুর সাথে অক্সিজেন ফুসফুসে প্রবেশ করে। কোষের অভ্যন্তরস্থ রক্তের সংস্পর্শে এসে ও রক্তের হিমোগ্লোলাবিনের সাথে বিক্রিয়া করে অক্সি-হিমোগ্লোবিন উৎপন্ন করে। শরীরের বিভিন্ন অংশের জৈব-কোষের সংস্পর্শে জারণ ক্রিয়ায় তাপ উৎপন্ন হয় এবং এই তাপ প্রাণীদেহের উষ্ণতা বজায় রাখে। এর ফলে শরীরের শক্তি উৎপন্নের পাশাপাশি কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন করে।
অক্সিজেনের ব্যবহার
জীবনধারণের অক্সিজেন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। চিকিৎসার ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট দূরীকরণের জন্য এই গ্যাস ব্যবহার করা হয়। অক্সি-হাইড্রোজেন শিখা (২৮০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা) ও অক্সি-এ্যাসিটিলিন শিখা (৩২০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা) দ্বারা ধাতু কাটা বা ঝালাই কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়।

 

বিভিন্ন প্রকারের এ্যাসিড বা অক্সাইড প্রস্তুতের জন্য এই গ্যাস ব্যবহৃত হয়। রকেটের জ্বালানী, অক্সিজেন হেলমেটে ও লৌহ ইস্পাত শিল্পে প্রচুর পরিমাণে  এই গ্যাস ব্যবহৃত হয়।