ক্র্যাটন
Craton
ভূবিজ্ঞানে ক্র্যাটন একটি পারিভাষিক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

গ্রিক
κράτος kratos ' সবল' থেকে ইংরেজি Craton শব্দটি গৃহীত হয়েছে। এর বাংলা অর্থ সুস্থিত ভিত্তিপ্রস্তর। পৃথিবীর মহাদেশীয় ভিত্তি হিসেবে ক্র্যাটনকে সুস্থির ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

পৃথিবীর গুরুমণ্ডলের (
Mantle )-এর উপরিভাগে রয়েছে কঠিন ও তরলের মধ্যবর্তী দশায় রয়েছে নমনীয় চটচটে পদার্থ সমৃদ্ধ অঞ্চল (এ্যাস্থোনোস্ফিয়ার )। এর উপরে রয়েছে প্রায় ২০০ কিলোমিটার পুরু অশ্মমণ্ডল (lithosphere) । আর এরও উপরে রয়েছে ভূত্বক ( crust )। পৃথিবীর ভিতরের উত্তপ্ত গলিত অংশে ভিতরে ভূত্বকের ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করে চলেছে অশ্মমণ্ডল। অশ্মমণ্ডলের পাথুরে অংশ গোলাকার পৃথিবীর উপরে বড় বড় খণ্ডে বিভক্ত। এই বড় বড় খণ্ডগুলোকে বলা হয় পাত। এই পাতগুলো পৃথিবীর গুরুমণ্ডলের তরল অংশের উপর ভাসমান ভেলার মতো রয়েছে। এই পাতগুলোর উপর কঠিন পাথরের স্তর জমে সুদৃঢ় ভিত্তি তৈরি হয়েছে। এর বিস্তার গুরুমণ্ডল পর্যন্ত। এই পাথুরে ভিত্তি হলো ক্র্যাটনের ভিত্তি। ক্র্যাটনের অধিকাংশই ভূত্বকের ভিতরে প্রথিত অবস্থায় থাকে। এর উপর প্রাক্-ক্যাম্ব্রিয়ান মহাকালের আগ্নেয় শিলা এবং রূপান্তরিত শিলার স্তূপ জমে বিশালাকারের ভূখণ্ড তৈরি করে। ক্র্যাটনের এই দশাকে বলা হয় স্থায়ী ভূখণ্ড-ঢাল। এই কারণে অনেক সময় মহাদেশীয় পাতের বিচারে এই জাতীয় ক্র্যাটনকে ভূখণ্ড-ঢাল (shield) ) বলা হয়। আবার এই ভূখণ্ড-ঢালের উপর নানা পদার্থের অধঃক্ষেপ পরে পরে, ভূখণ্ড ঢালের বন্ধুর উপরতলে সমতলীয় ভাব চলে আসে। ক্র্যাটনের উপরিতলের এই স্তরকে বলা হয় সমতলীয় স্তর। মূলত আমার পৃথিবী যে অংশটকু দেখে থাকি তার বেশিরভাগ অংশ হলো- ক্র্যাটনের উপরিতলের সমতলীয় অংশ।

প্রাক্-ক্যাম্ব্রিয়ান ক্র্যাটনের মূল উপাদান ছিল গ্রানাইড-গ্রিনস্টোন। আর এর সাথে অন্য উপকরণ হিসেবে যুক্ত হয়েছে নানা ধরনের অধঃক্ষেপ।

৪০০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের আগে কোনো তেমন উল্লেখযোগ্য ক্র্যাটনের সন্ধান পাওয়া যায় না। কারণ এই সময়ে কোনো ক্র্যাটন তৈরি হওয়া সম্ভব ছিল না। ৪০০ থেকে ৩৯৫ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দের ভিতরে পৃথিবীর তাপমাত্রা ছিল বর্তমান পৃথিবীর তাপমাত্রার প্রায় তিনগুণ। এই সময় ব্যাপক অগ্ন্যুৎপাত এই তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছিল। অতিরিক্ত তাপমাত্রার ফলে ভূ-গোলকের উপরিতলের ম্যাগমা অপেক্ষাকৃত কম ঘন ছিল এবং ভূত্বক বেশ পাতলা ছিল।  এর ফলে সাগরতলে তরল ম্যাগমা দ্রুত শীতল হয়ে আগ্নেয়শিলাস্তরের পুরুত্ব বৃদ্ধি করেছিল। কিন্তু পৃথিবীর উপরিতলের আবরণের নিচের ম্যাগমা থেকে উৎপন্ন গ্যাস, প্রবল চাপের সৃষ্টি করেছিল। ফলে ভূত্বকের কোনো কোনো অংশ ফুলে উঠেছিল, আবার কোনো কোনো অংশ থেকে অগ্ন্যুৎপাতের সৃষ্টি করেছিল। ভূত্বকের কোনো অংশ ফুলে উঠা অংশের তলদেশের ম্যাগমা থাকে প্রবল বেগ বেড়িয়ে যাবার কারণে, সৃষ্ট ফাঁকা জায়গা পূরণ করেছিল নিচের পাতলা ম্যাগমা। পরে এই ম্যাগমা শীতল হয়ে ভূত্বকের পুরুত্ব বৃদ্ধি করেছে। এর ফলে ভূত্বকে সৃষ্টি হয়েছিল উঁচু-নিচু কিন্তু সুদৃঢ় ভূখণ্ড। এই প্রক্রিয়া সমগ্র পৃথিবীর ভূত্বক জুড়ে সৃষ্টি হয়েছিল বহু বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূখণ্ড। এ ছাড়া, এই প্রক্রিয়ার ভিতরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আগ্নেয়-দ্বীপে বার বার প্লাবিত ম্যাগমা দ্বারা। একই সাথে অগ্ন্যুৎপাতঘটিত ছাই ভস্মের অধঃক্ষেপের কারণে ক্ষুদ্র ভূখণ্ডগুলো অনেক সময় জোড়া লেগে বড় ভূখণ্ড তৈরি হয়েছিল। এর ফলে ভূখণ্ডগুলোর অনুভূমিক বিস্তার ঘটেছিল যেমন, তেমনি পুরুত্বও বৃদ্ধি পেয়েছিল অনেক বেশি। এরই ভিতরে তৈরি হয়েছিল নানা আকারের প্রাক্-ক্র্যাটন। কিন্তু এই প্রাক্-ক্র্যাটনগুলোও সুস্থির দশায় ছিল না। পৃথিবীর আহ্নিক গতির কারণে এগুলোর মধ্যে ঘটতো ঠোকাঠুকি। এর ফলে অনেক দুর্বল ক্র্যাটন ভেঙে যেতো, কিম্বা গায়ে গায়ে লেগে বড় ধরনের ক্র্যাটনের সৃষ্টি হতো।

৩৯৫ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে পৃথিবী অনেকটা শীতল হয়ে পড়েছিল। এতদিনের উত্তপ্ত পৃথিবীর গ্যাসীয় অংশ আকাশে ঘন মেঘের সৃষ্টি করেছিল। ফলে এক সময় প্রবল বর্ষণের সূচনা হলো। দীর্ঘদিন ধরে ঢানা বৃষ্টিপাতের ফলে পৃথিবীর উপরিতলের তাপমাত্রা কমে গিয়েছিল। ফলে ম্যাগমার ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছিল। ৩৯২-৩৮৫ কোটি পূর্বাব্দের খ্রিষ্টাব্দের দিকে প্রচুর এবং ভারি উল্কাখণ্ডের পতন ঘটেছিল। এরফলে তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে অবিরাম বৃষ্টি সে তামাত্রাকে প্রশমিতও করেছিল।

এর ভিতর দিয়ে ৩৮৫ কোটি খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে তৈরি হয়েছিল বহু সুস্থির ক্র্যাটন। সেগুলো সুস্থির দশায় রইলো, কিন্তু স্বাধীন অস্তিত্ব হারালো। কারণ অন্যান্য ক্র্যাটনের সাথে যুক্ত হয়ে এগুলো সৃষ্টি করলো মহাকাশীয় ঢাল-ভূখণ্ড। এতসব ঘটনার ভিতর দিয়ে বর্তমান সময়ে আমার সামান্য কিছু ক্র্যাটনের কথাই জানতে পারি। এগুলোর কোনো স্বাধীন অস্তিত্ব নেই। এরা সবাই মহাদেশীয় ভূখণ্ডের ভিত্তি একক হিসেবে মহাদেশের অধীন।

একালের পৃথিবীর মহাদেশীয় অবস্থান অনুসারে যদি ক্র্যাটনগুলোকে সাজানো যায়, তাহলে দেখা যায়, এসকল ক্র্যাটন সকল সময় একই জায়গায় ছিল না। পরিচয়ের সুবিধার জন্য যদি একালের মহাদেশীয় বা উপমহাদেশীয় অবস্থানের বিচারে উল্লেখ করা যায়, তাহলে- ক্র্যাটনগুলোকে আমরা নিম্নোক্ত ভাগে ভাগ করে- এদের উৎপত্তির সময় বিবেচনা করতে পারি। যেমন-

সূত্র:

https://wikivisually.com/wiki/List_of_shields_and_cratons