পৃথিবীর ক্রমবিবর্তন
 

বিজ্ঞানের মতে অনন্ত আকাশ এবং এর অন্তর্গত সকল উপকরণ নিয়ে মহাবিশ্ব (univers) গঠিত। বর্তমান কালের মহাবিশ্বকে আমরা যেভাবে পাই, আদিতে তা এরূপ ছিল না। মহাবিশ্বের সৃষ্টি নিয়ে আদিতে বিভিন্ন মহলে নানাবিধ মতবাদ প্রচলিত ছিল। কালক্রমে তা অসংখ্যবার বাতিল বা সংশোধিত হয়েছে। সৃষ্টিতত্ত্বের ক্রমবিবর্তনের ধারার মতোই এই বিষয়ের ধারণারও ক্রমবিবর্তিত হয়েছে। এই সূত্রে আমরা অধিকগ্রহণযোগ্য যে তত্ত্বটি পাই, তার নাম বিগব্যাং   (Big-bang) তত্ত্ব। ১৯২৭ সালে বেলজিয়ামের একজন বিজ্ঞানী জর্জ লেমিটর (Georges Lemaître) এই তত্ত্ব প্রথম প্রকাশ করেন। এই তত্ত্ব অনুসারে ১৫০০ কোটি বৎসর আগে, মহাবিশ্বের সকল বস্তু আন্তঃআকর্ষণে একটি বৃহ পরমাণুতে (Supper Atom) পরিণত হয়। জর্জ লেমিটর এই পরমাণুটির নাম দিয়েছিলেন আদিম পরমাণু (primæval-atom)এই পরমাণুটি পরে বিস্ফোরিত হয়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে এই মতবাদকে সমর্থন ও ব্যাখ্যা করেন এডুইন পাওয়েল হাবল (Edwin Powell Hubble)হাবল পর্যবেক্ষণ দ্বারা প্রমাণ পান যে মহাকাশের গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর থেকে ক্রমন্বয়ে নির্দিষ্ট গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে। তাঁর মতে, আদিতে মহাবিস্ফোরণের ফলে গ্যালাক্সিগুলো সৃষ্টি হয়েছিল এবং এগুলোর দূরে সরে যাওয়ার আচরণ বিগব্যাং-কেই সমর্থন করে। এই ভাবে বিস্ফোরণের ফলে যে বিকিরণ সৃষ্টি হওয়ার কথা, তার অস্তিত্ব প্রথম দিকে প্রমাণ করা যায় নাই। ফলে, বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়। ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে Arno Penzias এবং Robert Wilson নামক দুজন বিজ্ঞানী বিকিরণের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। ফলে বিগব্যাং -এর ধারণা আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। মহাবিশ্ব সৃষ্টির ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত এই তত্ত্বকেই সত্য বলে বিবেচনা করা হয়। সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা গেছে, বিগ ব্যাং-এর ঘটনাটি ঘটেছিল প্রায় ১৩.৭৯৮± ০.০৩৭০০ কোটি বৎসর আগে। বর্তমানে মোটাদাগে বলা হয় এই ঘটনা ঘটেছিল ১৩৭৫ কোটি বৎসর আগে।

স্টিফেন ডব্লু, হকিং তাঁর A Brief history of time গ্রন্থে বলেছেন At the big bang itself the universe is thought to have had zero size, and so to have been infinitely hot. hot. But as the universe expanded, the temperature of the radiation decreased. One second after the big bang, it would have fallen to about ten thousand million degrees. This is about a thousand times the temperature at the center of the sun, but temperatures as high as this are reached in H-bomb explosions. [মনে করা হয়,বিগব্যাং-এর সময় মহাবিশ্বের আয়তন ছিল শূন্য এবং উত্তাপ ছিল অসীম। কিন্তু মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হওয়ার সময় বিকিরণের তাপমাত্রা কমে গিয়েছিল। বিগব্যাগ-এর  ১ সেকেন্ড পর, তাপমাত্রা প্রায় ১০০০ কোটি ডিগ্রিতে নেমে এসেছিল। এটা ছিল সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রার ১০০ গুণ বেশি, কিন্তু হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরণের সময় তাপমাত্রা যেরূপ উচ্চ থাকে সেরূপ ছিল ] ।

স্টিফেন ডব্লু, হকিং [A Brief history of time অনুসারে] মনে করেছেন, বিগ ব্যাং-এর ১০০ সেকেন্ড পরে তাপমাত্রা ১০০ কোটি ডিগ্রিতে নেমে এসেছিল। এই অবস্থায় বস্তুপুঞ্জে বিরাজমান ইলেক্ট্রন, প্রোটন নিউট্রন মিলিত হয়ে পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি করেছিল  হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, লিথিয়াম, বেরিলিয়াম পরমাণু

মূলত বিগ ব্যাং-এর পরে সৃষ্ট প্রোটন ও নিউট্রনের অধিকাংশই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল প্রতিরূপ প্রোটন ও নিউট্রনের সাথে সংঘর্ষ করে। এই কণাগুলোর এক চতুর্থাংশ হাইড্রোজেন ও অন্যান্য পদার্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, লিথিয়াম, বেরিলিয়াম ইত্যাদি পরমাণু তৈরি হওয়ার পর প্রায় দশ লক্ষ বৎসর আর কোনো নতুন মৌলিক পদার্থ তৈরি হয় নি। এই সময় শুধু মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হয়েছে।

ধারণা করা হয় বিগব্যাং-এর ৩ সেকেণ্ড থেকে ১০০,০০০ বৎসরের মধ্যে সৃষ্ট কণাগুলো শীতল হয়ে উঠে এই অবস্থায় বস্তুপুঞ্জে বিরাজমান ইলেক্ট্রন, প্রোটন নিউট্রন মিলিত হয়ে তৈরি হয় হাইড্রোজেন হিলিয়াম পরমাণু এ ছাড়া এই দুটি পদার্থের সাথে ছিল প্রচুর ইলেক্ট্রন প্লাজমা।  সব মিলিয়ে যে বিপুল বস্তুকণার সমাবেশ ঘটেছিল, সেগুলো প্রচণ্ড গতিতে বিগ ব্যাং-এর কেন্দ্র থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল এই সময় এই সকল কণিকাও ছিল অত্যন্ত উত্তপ্ত ক্রমে ক্রমে এগুলো শীতল হতে থাকলো এবং এদের ভিতরের আন্তঃআকর্ষণের কারণে- কাছাকাছি চলে এসেছিল ফলে বিপুল পরিমাণ বস্তুপুঞ্জ পৃথক পৃথক দল গঠন করতে সক্ষম হয়েছিল এই পৃথক দল গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পত্তন ঘটেছিল গ্যালাক্সি আমাদের সৌরজগতও এরূপ একটি গ্যালাক্সির ভিতরে অবস্থান করছে এই গ্যালাক্সির নাম ছায়াপথএটি একটি কুণ্ডলিত গ্যালাক্সি (Sb বা SBb কুণ্ডলিত গ্যালাক্সি)। পৃথিবী থেকে রাতের আকাশে এই গ্যালাক্সিকে আলোর ফিতার মতো মনে হয়। কুণ্ডলিত এই গ্যালাক্সির মূল বাহু রয়েছে, পাঁচটি। এই বাহুগুলির নাম হলো- পার্সিয়ুস (Perseus), নোর্মা ও সিগনাস (Norma and Cygnus), স্কুটাম-ক্রুক্স (Scutum-Crux), ক্যারিনা এবং ধনু (Carina and Sagittarius) এবং ওরিয়ন (Orion)। উল্লেখ্য এই ওরিয়ন বাহুর একটি প্রান্তে রয়েছে আমাদের সৌরজগত । ছায়াপথ ১৩০ কিমি/সে থেকে ১০০০কিমি/সে গতিতে নিজ অক্ষের উপর ঘুরছে।

এই গ্যালাক্সি'র কেন্দ্র থেকে প্রায় ২৫০০০ আলোকবর্ষ দূরে অরিওন (Orion) নামক বাহুতে, প্রায় ৫০০ কোটি বৎসর আগে বিশাল আকারের একটি মহাকাশীয় মেঘ জমাট বেঁধেছিল। ৪৭০ কোটি বৎসর আগে, এই মেঘের কাছে বিস্ফোরিত হয় একটি অতি নবতারা ৪৭০ কোটি বৎসর আগে, এই মেঘের কাছে বিস্ফোরিত হয় একটি অতি নবতারা । সে বিস্ফোরণের থাকায় ওই মেঘ সঙ্কুচিত হয়ে নাক্ষিত্রিক কেন্দ্রের সৃষ্টি করে। এই কেন্দ্র ঘূর্ণায়মান দশায় নাক্ষত্রিক ভ্রূণের সৃষ্টি করে। সেই নাক্ষত্রিক ভ্রূণ থেকে প্রায় ৪৬০ কোটি বৎসর আগে জন্মগ্রহণ করেছিল সূর্য। এই সময় নবীন সূর্য থেকে নিস্ক্রান্ত বস্তুপুঞ্জ, সূর্যকে ঘিরে ফেলেছিল। এর ফলে সূর্য একটি মহাকশীয় বলয়ে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। কালক্রমে এই বলয়ের বস্তুপুঞ্জ ছিটকে পড়ে ছোটো ছোটো মহাকাশীয় গোলকে পরিণত হয় এবং তা সূর্যকে প্রদক্ষিণ করা শুরু করে। এই সূত্রে ধারাবাহিক ঘটনাসূত্রে তৈরি হয়েছিল সৌরজগতের গ্রহ-উপগ্রহ। ধারণা করা হয়, পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার জন্য সুস্থির কোনো কক্ষপথ লাভ করে নি। প্রথম দিকের গ্রহগুলো ছিল উত্তপ্ত গ্যাসীয় গোলকের মতো। পরস্পরের ভিতর ধাক্কাধাক্কি করে কয়েকটি গোলক টিকে গিয়েছিল। এই গোলকগুলো সূর্যকে প্রদক্ষিণের একটি সুনির্দিষ্ট কক্ষপথও লাভ করেছিল। মূলত পৃথিবী গ্রহ হিসেব সুস্থির হয়েছিল প্রায় ৪৫০ কোটি বৎসর আগে।

সূর্য তৈরির সময় যে মহাজাগতিক গ্যাসীয় অংশ সূর্যকে ঘিরে ছিল। বিজ্ঞানীরা তার নাম দিয়েছেনaccretion disk প্রতি সেকেণ্ডে প্রায় ২১৭ কিলোমিটার গতিতে ছায়াপথের কেন্দ্রীয় একটি অংশকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। এছাড়া সূর্য নিজ অক্ষের উপর প্রায় ৭১৭৪ কিলোমিটার/ঘন্টা গতিতে ঘুরছে। আদি সূর্যকে ঘিরে থাকা উত্তপ্ত গ্যাসীয় অংশ, বিশাল বিশাল আগুনে গোলার মতো মহাশূন্যে ছুটে যেতে লাগলো। কিন্তু এদের ছুটে যাওয়ার পথে প্রথম বাধা দিল সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি। ছিটকে যাওয়া আগুনে গোলাগুলোকে নিজ কেন্দ্রের দিকে টেনে আনতে চাইলো। কিছু কিছু নিজের কাছে টেনে নিতে সক্ষম হলেও, সবগুলোকে আনতে পারলো না। যেগুলোকে টেনে আনতে সক্ষম হলো না, কিন্তু সূর্যের আকর্ষণকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে মহাকাশে ছুটে পালাতে পারলো না। শেষ পর্যন্ত ফলে বিষয়টা হলো- দড়ি বাঁধা গোলক ঘোরানোর মতো।  অর্থা যদি কেউ একটি ভারি বলের সাথে দড়ি বেঁধে ঘুরানোর চেষ্টা করে, তা হলে বলটি তার চারপাশে শূন্যের ভিতর দিয়ে ঘুরতে থাকবে। কারণ, বল তার ভরবেগ নিয়ে বাইরের দিকে ছুটে যেতে চাইবে, কিন্তু দড়ি তাকে কেন্দ্রের দিকে টানবে। ফলে বলটি আপোষ করে কেন্দ্রের চারপাশে ঘুরতে থাকবে। এক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটতে থাকলো। আগুনে গোলাগুলো বাইরের দিকে ছুটে যেতে ইচ্ছা করলেও সূর্যের মহাকর্ষীয় অদৃশ্য দড়ি তাদেরকে টেনে ধরে রাখলো। কিন্তু খেলার দড়ির মতো এই আকর্ষণের দড়ি কঠিন পদার্থের তৈরি নয়। তাই আর্কষণের নমনীয় টানে এই আগুনে গোলকগুলো কখনো সূর্য থেকে দূরে চলে যেতে থাকলো, কখনো বা বেশ কাছে চলে এলো। ফলে তৈরি হলো উপবৃত্তকার কক্ষপথ। কিন্তু সূর্যের আকর্ষণ অগ্রাহ্য করে তা কখনোই মহাশূন্যে হারিয়ে গেলো না বা সূর্যের আকর্ষণে ভিতরে ঢুকে গেলো না। এই থেকে সৃষ্টি হলো আদি গ্রহগুলো।


আদিতে এই গ্যাসীয় গ্রহগুলো ক্রমে শীতল হতে থাকে। কিন্তু এদের কক্ষপথগুলো যথাযথ অবস্থানে না থাকার কারণে গ্রহগুলোর ভিতর সংঘর্ষ ঘটে। ফলে নূতন করে করে গ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহাণু সৃষ্টি হতে লাগলো। বিজ্ঞানীদের মতে- এরূপ দুটি গ্রহের সংঘর্ষে তৈরি হয়েছিল পৃথিবী এবং এর একমাত্র উপগ্রহ পৃথিবী। ধারণা করা হয় ৪৬০ থেকে ৪৫০ কোটি বৎসর পূর্বে আমাদের
সৌরজগত একটি সুস্থির অবস্থায় আসতে সক্ষম হয়েছিল

 

সৃষ্টির আদিতে পৃথিবী একটি গ্যাসীয় অগ্নিগোলক ছিল। বিজ্ঞানীরা সেই আদি পৃথিবী থেকে বর্তমান সময়ের পৃথিবীকে নানা ধরনের বৈশিষ্ট্যে ভাগ করেছেন। এর প্রথম ভাগটি হলো- ক্যাম্ব্রীয়-পূর্ব মহাকাল (Precambrian Supereon)
আধুনিককালে ক্যাম্ব্রীয়-পূর্ব মহাকাল-কে ততটা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা না করে, নতুনভাবে পৃথিবীর ক্রমবিবর্তনের কাল-বিভাজন করে নামকরণ করেছেন। এই কালকে বলা হয় হেডিন
               পৃথিবীর ক্রমবিবর্তনের ধারা:
পৃথিবীর কালপঞ্জী