হেডিন কাল (৪৬০-৪০০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)
৪৬০-৪৫০ কোটি খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দ:
পৃথিবী
সৃষ্টি এবং সৌরজগতের
গ্রহ হিসেবে স্থিতি লাভের সময়, পৃথিবী ছিল একটি উত্তপ্ত গ্যাসীয় গোলক। এরপর
প্রথম ৭ কোটি বৎসর কেটে গিয়েছিল গ্যাসীয় পৃথিবী থেকে তরল পৃথিবী হয়ে উঠতে।
বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর এই দশাকে বলে থাকেন উত্তপ্ত তরল পৃথিবী।
এই তরল পৃথিবীর যে
সকল গ্যাসীয় উপকরণ শীতল হলো না, সে সকল উপকরণ দিয়েই তৈরি হলো পৃথিবীর প্রথম
বায়ুমণ্ডল। শুধু তাই নয়, তরল পৃথিবীতে আটকে পড়া গ্যাসীয় অংশ বুদ্বুদ হয়ে
বায়ুমণ্ডলকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল ধীরে ধীরে।
কক্ষপথের ভাগ বাঁটোয়ার নিয়ে
মঙ্গল
গ্রহের আকারের অন্য একটি গ্রহের সাথে পৃথিবীর
দ্বন্দ্ব
ভিতরে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে
উঠেছিল। বিজ্ঞানীরা কিছু
প্রমাণ সাপেক্ষে অপর তরল গ্রহটির নাম দিয়েছেন
থেইয়া। ধারণা করা
হয় ৪৫৩ কোটি ৩০ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে উভয় গ্রহের মধ্যে দৈহিক সংঘর্ষ
সংঘটিত হয়েছিল। প্রথম দিকে এই
ছিটকে পড়া রাশি রাশি তরল কণা পৃথিবীকে ঘিরে একটি পুরু বলয় তৈরি করেছিল। ছিটকে
পড়া প্রধান বা বড় অংশটুকু বেশিদূর যেতে পারলো না। নব্য পৃথিবীর আকর্ষণে বাঁধা
পড়ে গিয়ে বিচ্যুত তরল অংশ, এবং তরল বলয় মিলেমিশে পৃথিবীর উপগ্রহে পরিণত হলো।
এটা হলো পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ
চাঁদের সৃষ্টি হয়েছিল।
এই সময় পৃথিবীর উপরিতলের ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত
চুম্বকক্ষেত্রের সৃষ্টি করেছিল। পৃথিবীর কেন্দ্রাঞ্চলে
লৌহ-নিকেলের
সমাবেশ ঘটার আগ পর্যন্ত এই চুম্বকক্ষেত্র বর্তমান ছিল। চন্দ্র
সৃষ্টির এই সময়কে অনেক সময় বলা হয় ক্রিপ্টিয়া যুগ (Cryptic
era) ।
ভূত্বকের প্রকৃতি অনুসারে এর উপাদানগুলোকে শিলা হিসাবে শনাক্ত করা হয়। গঠন প্রকৃতি অনুসারে প্রকৃতি শিলাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। এইভাগ তিনটি হলো— আগ্নেয়শিলা, রূপান্তরিক শিলা এবং পাললিক শিলা। তবে ভূত্বকের সকল জায়গায় একই রকম উপাদান পাওয়া যায় না।
ভূত্বকের গড় দৈর্ঘ্য ৩৫ কিলোমিটার। স্থল ও জলভাগের বিশাল ব্যাপ্তীর বিচারে
ভূত্বককে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগ দুটি হলো- মহাসাগরীয় ভূত্বক ও মহাদেশীয়
ভূত্বক।
এই তাপমাত্রা যখন ৬৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে এসেছিল, তখন তরল
পৃথিবীর উপরিতলে দুধের সরের মতো, পাথরের সরের আবরণে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। তখন
পৃথিবীর উপরিতলে কোনো পানি ছিল না, কোনো পর্বতও তখনো তৈরি হয় নি। বিশাল আকারের
সেই সমতলীয় পৃথিবীর পাথুরে চাদরের কোথাও কোথাও, ভূত্বকের নিচে জমে উঠা বাতাসের
চাপে, বেলুনের মতো ফুলে উঠতো।
মূলত ভূত্বকের নিচের এই তরল শিলাকেই বলা হয় ম্যাগমা।
অনেক সময় সেই বেলুন ফেটে গিয়ে বেরিয়ে পড়তো তরল ম্যাগমা। আবার সে
ম্যাগমার উপরিতল পাথুরে চাদরে অংশ হয়ে উঠতো।
পৃথিবীর উপরিতলের ঘটমান রাশি রাশি পাথুরে বুদ্বদ ফেটে বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়েছিল
নানা ধরণের গ্যাসীয় উপকরণ। এই উপকরণের ভিতরে ছিল- জলীয় বাস্প,
হাইড্রোক্লোরিক এ্যাসিড,
কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কার্বন
মনো-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ইত্যাদি।
পরবর্তী সময়ে এদের ভিতর রাসায়নিক বিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল মিথেন,
এ্যামোনিয়া
এবং হাইড্রোজেন সায়ানাইড জাতীয় যৌগিক
পদার্থ। উল্লেখ্য এই সময়
বাতাসে মুক্ত অক্সিজেনের
পরিমাণ খুবই কম ছিল।
ম্যাগমার
উপরের অবস্থিত ভূত্বকের চাপ, অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা এবং সেই সাথে ম্যাগমার
প্রবাহের সূত্রে এর ভিতরে অজৈব উপাদানগুলোতে নানা ধরণে বস্তুগত সমন্বয় এবং
বিন্যাস সক্রিয় ছিল। এই সময় নানা ধরনের স্ফটিক, মণিকা ইত্যাদি আদি রূপ লাভ
করেছিল। উল্লেখ্য, ম্যাগমাতে জলীয় অংশ এবং বা কার্বন-ডাই
অক্সাইডের মতো বায়বীয় অংশ থাকে। যখন ম্যাগমা ক্রমান্বয়ে শীতল হতে থাকে, তখন এর
অজৈব উপকরণগুলো সঙ্কুচিত হতে থাকে। এর ফলে বায়বীয় অংশ, বুদ্বুদাকারে উপরে দিকে
উঠে আসে এবং এক সময় বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রক্রিয়ায় তরল শিলা দ্রুত
তাপমাত্রা হারায়। একই সাথে এসব বায়বীয় পদার্থ মণিকার প্রকৃতি পাল্টাতে সাহায্য
করে।
ম্যাগমার গাঠনিক
উপকরণ:
ম্যাগমার অন্যতম উপকরণ হলো
সিলিকন এবং অক্সিজেন। এই দুটি মৌলিক পদার্থ রসায়নিক বিক্রিয়ায়
সিলিকন ডাই অক্সাইড
(SO2)
গঠন করে। এর সাথে এ্যালুমিনিয়াম,
ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, লৌহ, ম্যাগনেশিয়ামের আয়ন। আয়নিত দশায় থাকার
কারণে এরা সহজেই স্থান বদল করতে পেরেছিল এবং অন্য অায়নের সাথে মিলিত হয়ে নতুন
যৌগিক পদার্থ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলে। মূলত আয়নিত দশায় উচ্চতর ধনাত্মক আধান
হিসেবে ছিল সিলিকন (Si4+),
এ্যালুমিনিয়াম (Al3+)
এবং লৌহ (Fe3+)।
অন্য দিকে ঋণাত্মক আয়ন হিসেবে থাকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ছিল অক্সিজেন
(O2−)।
উত্তপ্ত ম্যাগমায় এই আয়নগুলো থেকে তৈরি হয়েছিল
(SiO4)4−,
(AlO4)5−
এবং (FeO6)9−।
এছাড়া সামান্য পরিমাণ ঋণাত্মক আয়নযুক্ত মৌলিক পদার্থ হিসেবে ছিলে ফ্লোরিন,
ক্লোরিন। আয়োনিত দশায় অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছিল
হাইড্রোক্সাইড (OH)−,
যা পরবর্তী দশায় পানি সৃষ্টি করেছিল।
অন্যান্য
পদার্থের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছিল হাইড্রোক্লোরিক এ্যাসিড.
কার্বন-ডাই অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাজিড ইত্যাদি গ্যাসীয় পদার্থ। এর ভিতরে
জলীয় বাস্পের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫০ ভাগ, আর কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছিল ২০ ভাগ।
ম্যাগমার এ সকল উপকরণের মধ্যে শক্তিশালী আয়ন হিসেবে ছিল সিলিকা
(SiO4)4−।
ম্যাগমার উচ্চতর তাপদশাতে এই আয়নটি সুস্থির দশায় ছিল। পরবর্তী সাময়ে আয়োনিত
সিলিকার সাথে নিকটবর্তী সিলিকেটগুলো- অক্সিজেনের সাথে অংশভাগীয় তৈরি হয়েছিল
Si-O-Si
সেতুবন্ধ। এরূপ সরল সিলিকেট যৌগ ছিল
(Si2O7)6−
আয়ন।
একইভাবে
অন্যান্য পদার্থ যুক্ত হয় বৃহত্তর জটিল আয়োনিক সিলিকাদলের
সৃষ্টি হয়েছিল। এ্যালুমিনিয়ামযুক্ত সিলেকেটের
(AlO4)5− আসক্তি
তীব্রতর থাকায় সিলিকেট আয়নের সাথে যুক্ত হয় এ্যালুমিনিয়ামসমৃদ্ধ সিলিকেট আয়নের
সৃষ্টি হয়েছিল। অধিকাংশ বড় ধরণের আয়নদলে সিলিকন এবং এ্যালমুনিয়াম একই সাথে
যুক্ত থাকতে পারে।
ম্যাগমার ধরন:
গাঠনিক উপকরণের বিচারে ম্যাগমাকে প্রধান চারটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগে
প্রাধান্য পায় সিলিকন ডাই অক্সাইড। এর সাধারণ নাম সিলিকা। এর পাশাপাশি
প্রাধান্য পায় ম্যাগনেশিয়াম ও লৌহের অক্সাইডসমূহ। এসকল উপাদনের ভিত্তিতে
ম্যাগমাকে যে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়, তা হলো-
সিলিসিক ম্যাগমা (Silicic magma): এই জাতীয় ম্যাগমাতে সিলিকা থাকে প্রায় ৭০ ভাগ। এর সাথে ২% ম্যাগনেশিয়াম এবং লৌহ মিশ্রিত থাকে। তাপামাত্রার পরিমাণ সর্বোচ্চ ৯০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অগ্ন্যুৎপাতের সময় এই ম্যাগমার উদ্গীরণ গতি উচ্চ। এই কারণে এই ম্যাগ্মা সজোরে নির্গত হয়।
মাধ্যমিক ম্যাগমা (Intermediate magma): এই জাতীয় ম্যাগমাতে প্রায় ৫৫ ভাগ সিলিকা থাকে। এই জাতীয় ম্যাগ্মাতে SiO2 -এর পরিমাণ থাকে প্রায় ৬০ থেকে ৫৫ ভাগ, এছাড়া ম্যাগনেশিয়াম এবং লৌহের পরিমাণ থাকে ৩%। তাপামাত্রার পরিমাণ সর্বোচ্চ ১০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অগ্ন্যুৎপাদের সময় এই ম্যাগমার উদ্গীরণ গতি মধ্যম। এই কারণে এই ম্যাগ্মা সজোরে নির্গত হয়।
ম্যাফিক ম্যাগমা (Mafic magma): ম্যাগনেশিয়াম (Magnesium) থেকে Ma এবং লৌহ (feric) থেকে Ma ধ্বনি থেকে ইংরেজি Mafic (ম্যাফিক) শব্দ গঠিত হয়েছে। এই জাতীয় ম্যাগ্মাতে সিলিকা থাকে প্রায় ৫০%, আর ম্যাগনেশিয়াম এবং লৌহের পরিমাণ থাকে প্রায় ১০ ভাগ। এদের তাপামাত্রার পরিমাণ সর্বোচ্চ ১৩০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে থাকে। অগ্ন্যুৎপাদের সময় এই ম্যাগমার উদ্গীরণ গতি বেশ মন্থর। এই কারণে এই ম্যাগ্মা ধীরে ধীরে আগ্নেয়গিরি থেকে বেরিয়ে আসে। কিন্তু এই জাতীয় ম্যাগমার ভিতরে যখন সিলিকার পরিমাণ থাকে প্রায় ৪৫% হয় এবং ম্যাগনেশিয়াম এবং লৌহের পরিমাণ ৩২-৩০ ভাগে দাঁড়ায়, তখন তাকে বলা হয় আল্ট্রাম্যাফিক ম্যাগমা। এই জাতীয় তাপমাত্রার পরিমাণ সর্বোচ্চ ১৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অগ্ন্যুৎপাদের সময় এই ম্যাগমার উদ্গীরণ গতি বেশ মন্থর।
কোয়ার্টজ সাথে এ্যালুমিনিয়াম যুক্ত হয়ে তৈরি হয়েছিল ফেল্ডস্পার। পৃথিবীর আদিম ভূত্বকের ফেল্ডস্পার ছিল শুধু উত্তপ্ত, গলিত যৌগিক পদার্থ মাত্র। এই যৌগিক পদার্থের সাথে পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, বেরিয়াম যুক্ত হয়ে নানা ধরনের ফেল্ডস্পারের উদ্ভব হয়েছিল। এই চারটি মৌলিক পদার্থ যুক্ত সূত্রে উৎপন্ন হয়েছিল ৪ শ্রেণির ফেল্ডস্পার।
এ সকল ফেল্ডস্পারের সংমিশ্রণে আবার তৈরি হয়, ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ফেল্ডস্পার গ্রুপ। যেমন-
এরপরে নানা ধরনের কোয়ার্টজ এবং ফেল্ডস্পারের সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছিল নানা ধরনের গ্রানাইট। ফেল্ডস্পার, কোয়ার্টজ এবং প্ল্যাজিওক্ল্যাজ। এই জাতীয় উপকরণের দ্বারা গঠিত শিলাতে থাকে দানাদার বস্তুকণা। মিহি দানাদার কেলাসকে বলা হয় রায়োলাইট, সূক্ষ্ণ দানাদার কেলাসগুলোকে বলা হয় এ্যাপলাইট আর স্থূলদানাদার কেলাসগুলোকে বলা হয় গ্রানাইট। গ্রানাইটে থাকে ৮০-১০০% কোয়ার্টজ, ক্ষার ফেল্ডস্পার এবং প্ল্যাজিওক্ল্যাজ। এছাড়া থাকতে পারে ০-২০% অন্যান্য খনিজ উপাদান। এর গাঠনিক উপাদানের কারণে নানা বর্ণের হতে পারে। তবে সাধারণত সাদা, গোলাপি বা ধূসর বর্ণের গ্রানাইট দেখা যায়। গ্রানাইট শিলাকে প্রাথমিকভাবে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। এই ভাগ তিনটি হলো-
সাধারণত গ্রানাইটকে আগ্নেয়শিলা হিসেবেই বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এই শিলার রূপান্তরে মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল নাইস জাতীয় শিলা। মূলত জমাটা বাঁধা গ্রানাইট-এর সূত্রে সৃষ্ট নাইস স্তূপাকারে সঞ্চিত হয়েছিল কঠিন ভূত্বকের গভীরে। ধারণা করা হয়, কানাডার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে যে সকল এ্যাকাস্টা নাইস পাওয়া যায়, সেগুলোর সৃষ্টি হয়েছিল ৪০০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে। এই নাইস উত্তর-পশ্চিম কানাডার ভিত্তিভূমিতে ছোটো ছোটো ব্লক তৈরি করেছিল। শুধু এই অঞ্চলই এই জাতীয় আদিম কঠিন শিলা সারা পৃথিবীতে ব্লক হিসেবে পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে- শিলার বিশাল স্তূপের সৃষ্টি করেছিল।
প্রায় ২০ থেকে ৬০ ভাগ কোয়ার্ট্জ
এবং ৩৫ ভাগ
ফেল্ডস্পার নিয়ে ভূত্বকের গভীরে তৈরি হয়েছিল
বিশালাকার
ব্যাথোলিথ। এদের আয়তন ছিল প্রায় ১০০ বর্গ
কিলোমিটার। এই ব্যাথোলিথের স্তরে জমা হয়েছিল প্রাথমিক কোয়ার্ট্জ,
ফেল্ডস্পার আর আদিম গ্রানাইট। মূলত
ব্যাথোলিথই তরল ম্যাগমার উপরে ভূত্বকের শক্ত ভিত
তৈরি করেছিল। উল্লেখ্য, ভূত্বকের নিচে এই
ব্যাথোলিথই স্তর সৃষ্টির প্রক্রিয়া এখনো সচল
রয়েছে। এই ব্যাথোলিথ থেকে উদ্ভব হয়েছিল গ্রানাইট।
ভূত্বকের গভীরে
ব্যাথোলিথই স্তর সৃষ্টির সময়, এর ভিতরের বায়বীয়
উপাদান উপরের দিকে চাপের সৃষ্টি করেছিল। ফলে
ভূত্বকের বিভিন্ন স্থানে টসটসে ফোসকার সৃষ্টি হয়েছিল।
যখনই এই ফোসকা ফেটে গিয়ে গ্যাসীয় অংশ বেরিয়ে যেতো, তখন এর ভিতরে ফাঁকা জায়গা
তৈরি হতো। আর সে ফাঁকা জায়গা পূরণ হয়ে যেতো নিচের
তরল ম্যাগমা
দিয়ে। পরে এই ম্যাগমা আবার
শীতল হয়ে কঠিন পদার্থের
সৃষ্টি করতো। এই প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে
কঠিন ভূত্বকের পুরুত্ব
ক্রমে ক্রমে বেড়েই চলেছিল।
সে সময়ে ভূত্বকে
তখন কোনো সমতল ভূমি
ছিল বা। আদিম ভূত্বক সৃষ্টির এই প্রক্রিয়া সমগ্র
পৃথিবীর উপরিতলে
ঘটে চলেছিল। এই প্রক্রিয়ার ভিতরে
কোনো কোনো স্থান থেকে উৎসরিত গলিত লাভা, জমাট বেঁধে ছোট
ছোট উচ্চভূমি তৈরি করেছিল। এইভাবে আদমি ভূত্বকে অবিরত
ম্যাগমার স্রোতে
প্লাবিত হয়েছে।
আর এর সাথে মিশেছিল প্রচুর অগ্ন্যুৎপাতঘটিত ছাই
ভস্মের অধঃক্ষেপ।
ম্যাগমার
উপরের অবস্থিত ভূত্বকের চাপ, অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা এবং সেই সাথে ম্যাগমার
প্রবাহের সূত্রে এর ভিতরে অজৈব উপাদানগুলোতে নানা ধরণে বস্তুগত সমন্বয় এবং
বিন্যাস অবিরাম সচল ছিল । এই সময় নানা ধরনের
স্ফটিক,
মণিক
ইত্যাদি আদি রূপ লাভ করে। ম্যাগমাতে জলীয় অংশ এবং বা কার্বন-ডাই
অক্সাইডের মতো বায়বীয় অংশ থাকে। যখন ম্যাগমা ক্রমান্বয়ে শীতল হতে থাকে, তখন এর
অজৈব উপকরণগুলো সঙ্কুচিত হতে থাকে। এর ফলে বায়বীয় অংশ, বুদ্বুদাকারে উপরে দিকে
উঠে আসে এবং এক সময় বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রক্রিয়ায় তরল শিলা দ্রুত
তাপমাত্রা হারায়। একই সাথে এসব বায়বীয় পদার্থ
মণিকের
প্রকৃতি পাল্টাতে সাহায্য করে।
পৃথিবীর
আদিম খনিজ পদার্থ ও প্রস্তরের সমন্বয়ে ভূত্বকে বেশ দৃঢ়তা এসেছিল
বটে, কিন্তু তার সকল জায়গায়
সমান মজবুত ছিল না। ফলে এই
আবরণ ভেদ করে বায়বীয় এবং গলিত পদার্থ বেরিয়ে আসতো। এটা ছিল হেডিন কালের একটি
সাধারণ দৃশ্য। এর ফলে পৃথিবীর উপরিতলে সৃষ্টি হয়েছিল অসংখ্য আগ্নেয় স্তূপ। আর
সমতল অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল লাভা এবং পাথুরের ভস্মরাশি।
এই প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়েই
ভূত্বক বিভাজিত হয়ে অসংখ্য ভূখণ্ড তৈরি হয়েছিল। এই সকল ভূখণ্ডের সীমানা ছিল
গলিত পাথর বা ম্যাগ্মা।
এই ফুটন্ত ম্যাগমাই উত্তপ্ত কঠিন ভূখণ্ডের নিচের দিকে জমাটবেধে আদিম
আগ্নেয় শিলা (Igneous
rock)
তৈরি করেছিল। এই কারণে এই শিলাকে বলা হয় পৃথিবীর আদিম শিলা।
মূলত আদিম পৃথিবীর উপরি তলের কঠিন আবরণের ভিত্তি তৈরি হয়েছিল এই
আগ্নেয়
শিলা
দিয়ে। কিন্তু এই
শিলার
উপরের ছিল বিশাল বস্তুরাশির চাপ এবং সেই সাথে ছিল উচ্চ তাপমাত্রা। ফলে
আগ্নেয় শিলার
উপরিভাগে রাসায়নিক এবং ভৌত পরিবর্তন ঘটে চলেছিল এবং ধীরে ধীরে তা
রূপান্তরিত
শিলায়
(Metamorphic rock)
পরিণত হয়েছিল। ধারণা করা হয় রূপান্তরিত শিলা তৈরি ঘটনা
ঘটেছিল ১৫০০ বার উচ্চ চাপে
এবং ১৫০ থেকে ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। আগ্নেয়শিলা
এবং রূপান্তরিত শিলার
সমন্বয়ে ৪০০ কোটি খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে পৃথিবীর উপরিভাগ ঢাকা পড়ে গিয়েছিল।
হেডিন কালের শেষের দিকে আগ্নেয়শিলা ও রূপান্তরিত
শিলার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য ভাসমান ভেলা। এই ভেলাগুলোর
কোনো কোনটি একটি সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এরপর কাছাকাছি ভূখণ্ডের
মাঝখানের ফাঁকা জায়গা ম্যাগ্মা দিয়ে পূর্ণ হয়ে বা
সংযোজিত হয়ে বড় বড় ভূখণ্ডের সৃষ্টি করেছিল। এদের ভিত্তি ছিল শত কিলোমিটার
পর্যন্ত। কোনো কোনোটির ভিত্তি
গুরুমণ্ডল ছুঁয়ে গিয়েছিল।
এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূখণ্ডগুলো সুদৃঢ় ভিত্তির উপর সংযোজিত হয়ে যে বৃহত্তর
ভূখণ্ড তৈরি করেছিল, ভূতত্ত্বের ভাষায় এগুলোকে বলা হয়
ক্র্যাটন
(Craton)।
মূলত
ক্র্যাটন
তৈরির প্রক্রিয়ার পূর্ণাঙ্গ রূপ পেয়েচিল পরবর্তী
আর্কিয়ান কালে।
আরও পরে ক্র্যাটন থেকে মহাদেশীয় পাত সৃষ্টির হয়েছিল।
জড় থেকে জীবনের
প্রকাশ
এই যুগের শুরুর দিকে মহাসাগর-সাগরগুলোর
তরল পদার্থের সিংহভাগ দখল করে নিয়েছিল
নানা যৌগিক পদার্থ মিশ্রিত
জলরাশি।
পৃথিবীর আদিম সমুদ্রের জলে নানা ধরনের দ্রবাদি মিশে গিয়ে এক ধরনের
জটিল দ্রবণ তৈরি করেছিল। এই সময়
অতি-বেগুনি রশ্মি, পৃথিবীর বাইরে থেকে আসা নানা ধরনের মহাজাগতিক রশ্মি, পার্থিব
মেঘে থেকে সৃষ্ট মহাবজ্রপাত এবং তৎকালীন সমুদ্রজলের চাপ ও তাপের
প্রভাবে সাগরজলের রাসায়নিক উপকরণগুলোতে নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটে চলেছিল অবিরাম।
হেডিন কালের শেষভাগে পৃথিবীর আদিম মহাসমুদ্রে এসে যে সকল যৌগিক
বা যৌগমূলক পদার্থের সৃষ্টি হয়েছিল, তার সবগুলো জীবজগতের আদি উপকরণ হিসেবে বিবেচনা
করা হয় না। প্রকৃতপক্ষে সে সময়ে জীবদেহগঠনের সহায়ক যে সকল অণু তৈরি হয়েছিল, তাদেরকে
বলা হয়
জৈব-অণু (biomolecule)।
সাধারণভাবে দেখা যায় এ সকল
জৈব-অণুতে ২৫টিরও বেশি মৌলিক পদার্থ থাকে। তবে এর ভিতরে ছয়টি
মৌলিক পদার্থকে জৈবঅণুর সাধারণ উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ সকল মৌলিক পদার্থের
ইংরেজি বানানের আদ্যাক্ষর নিয়ে যে শব্দসংক্ষেপ করা হয়েছে- তা হলো
CHNOPS (Carbon,
Hydrogen, Nitrogen,
Oxygen, Phosphorus, and
Sulfur)।
জৈবঅণুর সবচেয়ে সরল
জৈবযৌগ তৈরি হয়
হাইড্রোজেন ও
কার্বন দিয়ে এবং জৈবযৌগের প্রথম সদস্য হলো
মিথেন। উল্লেখ্য, চার হাত বিশিষ্ট
কার্বন, যখন এক হাত বিশিষ্ট
হাইড্রোজেনের সাথে মিলিত হয়ে মিথেনের উদ্ভব হয়। এই কারণে, মিথেনের রাসায়নিক
প্রতীক হয়
(CH4)।
কার্বনের সাথে
হাইড্রোজেনের বন্ধুত্ব হতে পারে নানা ধরনের এবং বন্ধুত্বের প্রকৃতি অনুসারে
এদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও হয় নানা ধরনের। সাধারণভাবে হাইড্রোজেন ও কার্বনের
বন্ধুত্বের দ্বারা সৃষ্ট অণুগুলিকে
হাইড্রোকার্বন বলা হয়। আবার কোনো
হাইড্রোকার্বনের সাথে যখন অন্য কোনো মৌলিক বা যৌগমূলক যুক্ত হয়, তখন নবাগত এই
অতিথির সূত্রে নতুন অণু তৈরি হয়। এক্ষেত্রেও অতিথির প্রকৃতি অনুসারে
হাইড্রোকার্বনগুলো নতুন শ্রেণিগত রূপ পায়।
আদিম মহাসমুদ্রের জলের অনুকুল পরিবেশে এই
জৈব-অণুগুলোর ভিতরে অন্য পদার্থের সাথে আসক্তি বৃদ্ধি পেয়েছিল নানা ভাবে। ফলে
তৈরি হয়েছিল নানা ধরনের যৌগিক পদার্থ। এর ভিতরে কিছু অণু তৈরি হয়েছিল কার্বন
ভিত্তিক। কার্বনের সাথে বিশেষ কিছু অন্য পদার্থের মিলনে তৈরি হয়েছিল, নানা ধরনের
জৈব
কার্যকরীমূলক। এর ফলে জৈব-অণুগুলো নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য লাভ করেছিল। জৈব-অণুর
ক্ষেত্রে মোট ছয়টি
কার্যকরীমূলক বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
অক্সিজেন,
নাইট্রোজেন,
ফসফরাস এবং
সালফাইটের সাথে কার্বনের বন্ধন সৃষ্টির বিবেচনায় একে ৫টি ভাগে ভাগ করা হয়। এই
ভাগগুলো হলো-
১. অক্সিজেন, হাইড্রোজেন ও কার্বন বন্ধন: এই শ্রেণির কার্যকরীমূলকের ভিত্তি হলো অক্সিজেন ও কার্বনের বন্ধন। কার্বনের সাথে অক্সিজেনের বন্ধন তিনভাবে সংঘটিত হয়েছিল। এ সকল কার্যকরীমূলককে এদের প্রকৃতি অনুসারে তিনভাগে ভাগ করা হয়।
১.কার্বোনিল (Carbonyl): এই শ্রেণির কার্যকরীমূলক এককভাবে অক্সিজেনের সাথে মিলিত হয়। এক্ষেত্রে অক্সিজেন দুটি বাহু কারবনের দুটি বাহুকে অধিকার। রসায়নবিজ্ঞানে এর প্রতীক ব্যবহার করা হয় C=O।
২. হাইড্রোক্সিল (Hydroxyl): এই শ্রেণির কার্যকরীমূলকে অক্সিজেনের সাথে থাকে হাইড্রোজেন। মূলত একটি অক্সিজেন ও একটি হাইড্রোজেন মিলিত হয়ে −OH মূলক সৃষ্টি করে। এই মূলকই কার্বনের সাথে মিলিত হয়ে জৈবযৌগের সৃষ্টি করে।
৩.
কার্বোক্সিল (Carboxyl):
এই শ্রেণির কার্যকরীমূলকে থাকে কার্বন, অক্সিজেন ও
হাইড্রোজেন। এতে একই কার্বনের সাথে কার্বনিল ও হাইড্রোক্সিল যুক্ত হয়।
এর সাধারণ সংকেত HO−C=O।
সাধারণভাবে এই সংকেত প্রকাশ করা হয় (-COOH)
হিসেবে।
৪. কার্বোহাইড্রেড: সাধারণত একটি কার্বনের সাথে দুটি হাইড্রোজেন এবং একটি অক্সিজেন অণু যুক্ত হয়ে কার্বোহাইড্রেড তৈরি হয়। এই বিচারে এর সাধারণ রাসায়নিক সূত্র হলো- Cm(H2O)n ।
স্বাদের উপর ভিত্তি করে কার্বোহাইড্রেডকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগ দুটি হলো-
- মিষ্টি: এই জাতীয় কার্বোহাইড্রেডের সাধারণ নাম চিনি। সাধারণ চিনি ছাড়া এই জাতীয় কার্বোহাইড্রেডের ভিতরে রয়েছে গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ, সুকরোজ ইত্যাদি
- মিষ্টিহীন: এই জাতীয় কার্বোহাইড্রেডে স্বাদের বিচারে মিষ্টি নয়। এদের ভিতরে রয়েছে স্টার্চ, সেলুলোজ, গ্লাকোজেন ইত্যাদি।
আণবিক গঠনের বিচারে কার্বোহাইড্রেডকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। এগুলো হলো-
- মোনোস্যাকারাইড: একটি কার্বন শৃঙ্খলের দ্বারা এই কার্বোহাইড্রেড তৈরি হয়। এই জাতীয় কার্বোহাইড্রেডকে আর্দ্র বিশ্লেষণ করা যায় না। এ্ই জাতীয় কার্বোহাইড্রেডে ৩ থেকে ১০টি কার্বন থাকতে পারে। এক্ষেত্রে কার্বনের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে মনোস্যাকারাইডকে ভাগ করা হয়। যেমন-
- ট্রায়োজ: তিনটি কার্বন থাকে। যেমন- গ্লিসার্যাল্ডিহাইড, ডাইঅক্সি এ্যাসিটটোন ইত্যাদি।
- টেট্রোজ: চারটি কার্বন থাকে। যেমন- ডি এরিথ্রোজ, ডি-থ্রেওজ ইত্যাদি।
- পেন্টোজ: পাঁচটি কার্বন থাকে। যেমন- রাইবোজ, ডিঅক্সিরাইবোজ, রাইবুলোজ ইত্যাদি।
- হেক্সোজ: ছয়টি কার্বন থাকে। যেমন- গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ, ম্যানোজ, সুক্রোজ ইত্যাদি।
- হেপ্টোজ: সাতটি কার্বন থাকে। যেমন-সেডোহেপ্টুলোজ, মান্নোহেপ্টোলোজ ইত্যাদি।
- অক্টোজ: আটটি কার্বন থাকে। যেমন- মেথিল্থোইলিনোকোসামাইড
- ওলিস্যাকারাইড: এই জাতীয় কার্বোহাইড্রেডকে আর্দ্র বিশ্লেষণ করলে মনোস্যাকারাইড অণু পাওয়া যায়। যেমন- সুক্রোজ, মল্টোজ, র্যাফিনোজ ইত্যাদি। আর্দ্র বিশ্লেষণের ফলে যে সকল কার্বোহাইড্রেড পাওয়া যায়, তার সংখ্যার উপর ওলিস্যাকারাইডকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগ দুটি হলো-
- ডাইস্যাকারাইড: আর্দ্র বিশ্লেষণের দ্বারা দুটি মনোস্যাকারাইড অণু পাওয়া যায়। যেমন-সুক্রোজ, মল্টোজ।
- ট্রাইস্যাকারাইড: আর্দ্র বিশ্লেষণের দ্বারা তিনটি মনোস্যাকারাইড অণু পাওয়া যায়। যেমন-র্যাফিনেজ।
- পলিস্যাকারাইড: দুইয়ের অধিক মনোস্যাকারাইড অণু নিয়ে গঠিত কার্বোহাইড্রেডকে পলিস্যাকারাইড বলা হয়।
এত ধরনের কার্বোহাইড্রেডের মধ্যে পেন্টোজ-এর যেমন- রাইবোজ ও ডিঅক্সিরাইবোজ আদি জীবকণিকা সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছিল। তাই এই দুটি উপকরণ সম্পর্কে সংক্ষেপে জেনে নেওয়ার চেষ্টা করবো।
রাইবোজ (Ribose): এটি একটি মোনোস্যাকারাইড জাতীয় কার্বোহাইড্রেড। এতে পাঁটি কার্বন থাকায়, একে 'পেন্টোজ' শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর আণবিক সঙ্কেত C5H10O5। Phoebus Levene নামক একজন রাশিয়ান বায়োকেমিষ্ট ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে একটি ইস্ট থেকে পাঁচ কার্বন বিশিষ্ট একটি শর্করা অনু নিষ্কাষণ করেন এবং এর নাম দেন রাইবোজ।
এতে একটি অ্যালডিহাইড গ্রুপ (-CHO) থাকায় একে এ্যাল্ডোপেন্টোজ বলা হয়। এর গলনাঙ্ক ৯৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গাঢ় হাইড্রোক্লোরিক এ্যাসিডের সাথে বিক্রিয়া করে ফারফিউরাল এ্যাসিড উৎপন্ন করে।
- ডিঅক্সিরাইবোজ (Deoxyribose): এটি একটি মোনোস্যাকারাইড জাতীয় কার্বোহাইড্রেড। এতে পাঁটি কার্বন থাকায়, একে 'পেন্টোজ' শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর আণবিক সঙ্কেত- C5H10O4।
Phoebus Levene নামক একজন রাশিয়ান বায়োকেমিষ্ট ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে একটি প্রাণীর থাইমাস গ্লান্ডের নিউক্লিয়াস থেকে পাঁচ কার্বন বিশিষ্ট একটি কার্বোহাইড্রেড অণুর সন্ধান পান। কিন্তু এই অণুতে রাইবোজ অণুর চেয়ে একটা অক্সিজেন অণু কম ছিল। তাই তিনি এই দ্বিতীয় অণুটির নাম দিয়েছিলেন ডিঅক্সিরাইবোজ। উল্লেখ্য ডিঅক্সি শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল 'অক্সিজেন নাই' অর্থে।
এর রং সাদা এবং কঠিন। এর গলনাঙ্ক ৯১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। গাঢ় হাইড্রোক্লোরিক এ্যাসিডের সাথে বিক্রিয়া করে লেভুলিনিক এ্যাসিড উৎপন্ন করে।
২. নাইট্রোজেন,
হাইড্রোজেন ও কার্বন বন্ধন: এই
শ্রেণির কার্যকরীমূলকে থাকে নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেন নিয়ে গঠিত পদার্থ। এ্যামোনিয়া
(Ammonia, NH3)-এর
হাইড্রোজেন জৈব-মূলক দ্বারা প্রতিস্থাপিত হলে- এ্যামিন তৈরি হয়।
কিন্তু -NH2
মূলকটি α
কার্বনের সাথে যুক্ত হওয়ার সূত্রে যে জৈবঅণু সৃষ্টি করে, কার্যকরী মূলকের বিচারে
তাকে বলা হয়
এ্যামিনো (Amino)।
ক্রমবির্তনের
ধারায় আদিম সাগর জলে তৈরি হয়েছিল
এ্যামিনো এ্যাসিড। এ্যামিনো
এ্যাসিড মূলত একটি শ্রেণিগত নাম। এই এ্যাসিডে
α
কার্বনের সাথে থাকে এ্যামিনো মূলক -NH2
এবং (-COOH) মূলক। এটি হচ্ছে
এ্যামিনো এ্যাসিডের মূল কাঠামো। এই মূল কাঠামোর সাথে অতিরিক্ত কোনো একক পরমাণু বা
যৌগমূলক যুক্ত হয়ে এ্যামিনো এ্যাসিড পূর্ণরূপ পায়। অতিরিক্ত পার্শ্ব শিকল এই
উপাদানকে রসায়ন বিজ্ঞানে একে
R বর্ণ দ্বারা প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সব মিলে
এর গাঠনিক রূপটি পাশের চিত্রের মতো।
এ্যামিনো এ্যাসিডের কার্বোক্সিল কার্যকরী মূলকের কার্বনকে বলা হয় ১ কার্বন। এর সাথে
যুক্ত পরবর্তী কার্বনটিকে বলা হয় আলফা-কার্বন। এই আলফা কার্বনের সাথেই থাকে
এ্যামিনো মূলক। এরপর এই কার্বনের সাথে অন্য কার্বন যুক্ত হলে, তাকে বলা হয় বিটা
কার্বন। এরূপ কার্বনের সাথে কার্বন জুড়ে যখন জৈবঅণুটি দীর্ঘ হয়, তখন কার্বনের নাম
হয় যথাক্রমে গামা, ডেল্টা ইত্যাদি। পাশের চিত্রে এর একটি নমুনা দেখানো হলো। এই
জাতীয় এ্যামিনো এ্যাসিডের নামকরণও করা হয়, গ্রিক বর্ণানুসারে। যেমন- আলফা এ্যামিনো
এ্যাসিড, বিটা এ্যামিনো এ্যাসিড ইত্যাদি।
উল্লেখ্য, এক সময় মনে করা হতো
যে,
এ্যামিনো এ্যাসিডের মতো জটিল
অণু রসায়নাগারে তৈরি করা অসম্ভব। কিন্তু ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে শিকাগো
বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট ছাত্র স্ট্যানলি মিলার এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। আদি
সমুদ্রে নানা ধরনের এ্যামিনো এ্যাসিড তৈরি হয়েছিল প্রাকৃতিক নিয়মে। স্ট্যানলি মাত্র
এক ধরনের
এ্যামিনো এ্যাসিড তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আদি সাগরজলে কত ধরনের এ্যামনো
এ্যাসিড তৈরি হয়েছিল, তা জানা সম্ভব নয়। এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা প্রায় ৫০০ ধরনের
এ্যামিনো এ্যাসিডকে তালিকাভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।
৩. নাইট্রোজেন
ঘটিত ক্ষার: কার্বন,
হাইড্রোজনে ও নাইট্রোজেন নিয়ে এই জাতীয় নানা ধরনের ক্ষার তৈরি হয়েছিল। জীবজগতের
সাথে সম্পর্কিত নাইট্রোজন ভিত্তিক ক্ষারের দুটি বিশেষ প্রকরণকে বিশেষভাবে উল্লেখ
করা হয়। এই প্রকরণ দুটি হলো
পিউরিন: এর ভিত্তি ২টি বলয় দ্বারা গঠিত হয়েছিল। এই শ্রেণিতে দুটি ক্ষার পাওয়া যায়। ক্ষার দুটি হলো- এ্যাডেনিন (C5H5N5) ও গুয়ানিন (C5H5N5O)।
পাইরিমিডিন: এর ভিত্তি ১টি বলয় দ্বারা গঠিত হয়েছিল। এই শ্রেণিতে ৩টি ক্ষার পাওয়া যায়। ক্ষার ৩টি হলো- সাইটোসিন (C4H5N3O), থাইমিন (C5H6N2O2) ও ইউরাসিল (C4H4N2O2)।
আদিম জীবকণিকা সৃষ্টির এসব উপকরণ তৈরি হতে হতে, হেডিন কাল শেষ দশায় চলে এসেছিল।
পরবর্তী আর্কিয়ন কালের প্রথম ভাগে ইয়ো-আর্কিয়ান যুগে
(৪০০-৩৬০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) জড় পৃথিবীর পরিবর্তনের সূত্রে
আদিম জীবকণিকা সৃষ্টির পূর্ব-সময়ে
এসব উপকরণ মিলে তৈরি হয়েছিল বড় বড় জৈব অণুর। আর এসব অণু তৈরি বিষয় নিয়েও আলোচনা
করবো 'ইয়ো-আর্কিয়ান
যুগ' অধ্যায়ে।
সূত্র :