স্ফটিক
ইংরেজি
crystal।
সমার্থক শব্দাবলি: কেলাস, স্ফটিক।
কঠিন পদার্থের একটি বিশেষ রূপ। যে সকল কঠিন পদার্থের কণাগুলো কোনো নির্দিষ্ট নিয়মে
সজ্জিত থাকে, তাদেরকে দানাদার পদার্থ বলা হয়
(crystalline)।
এই জাতীয় পদার্থের অণুগুলো একটি সুনির্দিষ্ট ত্রিমাত্রিক রূপ লাভ করে। এই জাতীয়
পদার্থকে সাধারণভাবে স্ফটিক বা কেলাসাকার পদার্থ বলা হয়। পদার্থের বিশেষ ধরনের
আণুবীক্ষণিক বিন্যাসকে বলা হয় স্ফটিক গঠনবিন্যাস (Crystal
structure)।
ছোটো ছোটো স্ফটিককণাগুলো একত্রিত হয়ে কখনো কখনো একই আকারের বড় স্ফটিক তৈরি করে।
স্ফটিক বিভিন্ন রঙের হতে পারে। বিষয়টি নির্ভর করে এর উপাদানের উপর।
স্ফটিকে পানি আছে কি নাই, তার উপর নির্ভর করে স্ফটিককে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই
ভাগ দুটি হলো—
১. অনার্দ্র স্ফটিক : এই জাতীয় স্ফটিকের মূল উপাদানের সাথে কোনো পানির অণু
থাকে না। যেমন― লবণ (NaCl)।
২. সোদক স্ফটিক : এই জাতীয় স্ফটিক তৈরির ক্ষেত্রে স্ফটিকের মূল উপাদানের
সাথে সুনির্দিষ্ট সংখ্যক পানির অণু থাকে। এই পানিকে কেলাস-পানি বলা হয়। মূলত ওই
পাণির অণু না থাকলে স্ফটিক তৈরিই হবে না। এমন কি দেখা যায়, এই জাতীয় কোন স্ফটিক
থেকে পানির অণু সরিয়ে নিলে, স্ফটিকরূপ নষ্ট হয়ে যায়। যেমন—
তুঁতে বা নীল ভিট্রিয়ল
(CuSo4, 5H2O),
ফিটকিরি
(K2SO4,
Al2(SO4),
24H2O),
জিপসাম (Ca2SO4,
2H2O)
ইত্যাদি।
স্ফটিকের ভিতরের কণাগুলোর সজ্জা অনুসারে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়।
যেমন-
একক স্ফটিকাকার | বহু স্ফটিকাকার |
১. একক স্ফটিকাকার (mono
crystalline)
: এই সকল স্ফটিক একই জাতীয় স্ফটিককণা নিয়ে গঠিত হয়।
২. বহু স্ফটিকাকার (Polycrystalline)
: এই সকল স্ফটিক একাধিক ধরনের স্ফটিকাকার কণা মিলিত হয়ে গঠিত হয়। এদেরকে বলা হয়
বহু-স্ফটিকাকার পদার্থ। অধিকাংশ ধাতব পদার্থ, মাটির তৈরি বিভিন্ন উপকরণে এই জাতীয়
কেলাস লক্ষ্য করা যায়।
স্ফটিকের জালিক পদ্ধতি
(lattice systems)
স্ফটিকের ত্রিমাত্রিক
জ্যামিতিক বিন্যাসে কতকগুলো বিন্দু কল্পনা করা হয়। এই বিন্দুগুলোর অবস্থান এবং
দিকনির্দেশনা অনুসারে স্ফটিকের কণাগুলো অবস্থান করে। এই বিন্যাসকে বলা হয় স্ফটিকের
জালিক পদ্ধতি (lattice systems)।
এই পদ্ধতিতে ত্রিমাত্রিক বিন্যাসের বিন্দুগুলোকে যুক্ত করলে স্ফটিকের আকার
তৈরি হয়। এইভাবে যখন কোনো একক স্ফটিক ব্লক তৈরি হয়, তখন তাকে বলা হয় স্ফটিক কোষ (crystal
cell)।
এই কোষের আকার নির্ভর করে, কোষে অবস্থিত পরমাণু বা আয়নের
উপর। এই কোষের বাহুগুলো সমতল হয় বলে, কোষের বাহুগুলো একটি নির্দিষ্ট
কোণে মিলিত হয়। এই কোণের পরিমাপ এবং বাহুগুলোর দৈর্ঘ্যের উপর ভিত্তিক করে
স্ফটিকগুলোকে ৭টি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। এই ভাগগুলো হলো—
১. ঘনক স্ফটিক জালিক পদ্ধতি (cubic
crystal system):
এই জাতীয়
স্ফটিক একটি ঘনকের আকারে সৃষ্টি করে। স্ফটিকের জালিক বিন্যাসের বিচারে এটি সবচেয়ে
সরল। এর বাহু সংখ্যা ১২ এবং তল সংখ্যা ৬টি। প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য সমান হয় এবং
কোণগুলো ৯০ ডিগ্রি (সমকোণ) থাকে। এর তিনটি প্রকরণ আছে। এই প্রকরণগুলো হলো—
১.১.
সাধারণ ঘনক (Primitive cubic
বা
simple cubic):
এই জাতীয় স্ফটিক জালিক
বিন্যাসে ৮টি পরমাণু নিয়ে একটি স্ফটিক কোষ গঠিত হয়। অর্থাৎ ৮টি বিন্দুতে
পরমাণুগুলো থাকে। এই পরমাণুগুলো দুটো স্তরে সজ্জিত থাকে। এর উপরের স্তরে ৪টি
এবং নিচের স্তরে চারটি পরমাণু একই তলে থাকে। ফলে স্ফটিকটি একটি বাক্সের
আকার ধারণ করে। এই স্ফটিকের ভিতরভাগ একটি ফাঁকা জায়গার সৃষ্টি করে। |
|
১.২. বস্তুকেন্দ্রিক ঘনক (Body-centered cubic): এই জাতীয় ঘনকে ৯টি পরমাণু তিনটি স্তরে সজ্জিত থাকে। এর প্রথম ও তৃতীয় স্তরে ৪টি করে পরমাণু একটি বাক্সের আকার সৃষ্টি করে। এই বাক্সের প্রতিটি কোণার পরমাণু মধ্যভাগে অপর একটি পরমাণু অবস্থান করে। মধ্যভাগের (বা দ্বিতীয় স্তর) এই পরমাণুটি প্রান্তীয় পরমাণুর কেন্দ্র হিসাবে একটি সুদৃঢ় কেন্দ্র তৈরি করে। এই জাতীয় স্ফটিক হলো— সিজিয়াম ক্লোরাইড (CsCl)। | |
১.৩. পার্শ্বকেন্দ্রিক ঘনক (Face-centered cubic): এই জাতীয় ঘনকে মোট ১৪টি পরমাণু থাকে। এর কেন্দ্রে কোনো পরমাণু থাকে না। কিন্তু প্রতিটি তলের কেন্দ্রে একটি করে পরমাণু থাকে। ফলে প্রতিটি তল একটি পৃথক দৃঢ়তা লাভ করে। যেমন— লবণ (NaCl), হীরক। | |
২. আয়তাকার স্ফটিক জালিক পদ্ধতি (Tetragonal
crystal system):
এই জাতীয় স্ফটিকের বাহু সংখ্যা ৮টি এবং তল সংখ্যা ৬টি হয়। এর ঊর্ধ্ব ও নিম্নতল বর্গাকার হলেও উলম্ব বাহু অপেক্ষাকৃত বড় বা ছোটো হয়। ফলে এটি একটি আয়তাকার বাক্সের মতো মনে হয়। এর প্রতিটি কোণ ৯০ ডিগ্রি থাকে। এর দুটি প্রকরণ আছে। এই প্রকরণ দুটো হলো— |
|
১.১. সাধারণ আয়তাকার স্ফটিক (Primitive cubic): এই জাতীয় স্ফটিক জালিক বিন্যাসে ৮টি পরমাণু নিয়ে একটি স্ফটিক কোষ গঠিত হয়। অর্থাৎ ৮টি বিন্দুতে পরমাণুগুলো থাকে। এই পরমাণুগুলো দুটো স্তরে সজ্জিত থাকে। এর উপরে স্তরে ৪টি এবং নিচের স্তরে চারটি পরমাণু একই তলে থাকে। কিন্তু এর ঊর্ধ্ব ও নিম্নতল অপেক্ষাকৃত লম্বা হওয়ার ফলে, স্ফটিকটি একটি লম্বা বাক্সের আকার ধারণ করে। এই স্ফটিকের ভিতরভাগ একটি ফাঁকা জায়গার সৃষ্টি করে। | |
১.২.
বস্তুকেন্দ্রিক ঘনক (Body-centered
cubic): এই জাতীয়
স্ফটিকে ৯টি পরমাণু তিনটি স্তরে সজ্জিত থাকে। এর প্রথম ও তৃতীয় স্তরে ৪টি করে
পরমাণু একটি বাক্সের আকার সৃষ্টি করে। এই বাক্সের প্রতিটি কোণার পরমাণু
মধ্যভাগে অপর একটি পরমাণু অবস্থান করে। মধ্যভাগের (বা দ্বিতীয় স্তর) এই
পরমাণুটি প্রান্তীয় পরমাণুর কেন্দ্র হিসাবে একটি সুদৃঢ় কেন্দ্র তৈরি করে।
কিন্তু এর ঊর্ধ্ব ও নিম্নতলে অপেক্ষাকৃত লম্বা হওয়ার ফলে, স্ফটিকটি একটি
লম্বা বাক্সের আকার ধারণ করে। এই জাতীয় স্ফটিক হলো- সিজিয়াম ক্লোরাইড (CsCl)। |
|
৩.
অর্থোরম্বিক স্ফটিক পদ্ধতি
(orthorhombic crystal system): এই পদ্ধতির স্ফটিকের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর কোনো বাহুই পরস্পরের সমান নয়। এই পদ্ধতির পরমাণুর সংখ্যা এবং পরমাণুর অবস্থান অনুসারে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। এই ভাগগুলো হলো- |
|
৩.১.
সাধারণ অর্থোরম্বিক
(Primitive orthorhombic):
এই জাতীয় স্ফটিক জালিক বিন্যাসে ৮টি পরমাণু নিয়ে একটি স্ফটিক কোষ গঠিত হয়। এর বাহুগুলো পরস্পর অসমান হয়। |
|
৩.২.
ভিত্তি-কেন্দ্রিক অর্থোরম্বিক (base-centered
orthorhombic):
এই জাতীয় স্ফটিক জালিক বিন্যাসে ১০টি পরমাণু থাকে। এর উপরিতল ও নিম্নতলের কেন্দ্রে দুটি পরমাণু থাকে। এবং যথারীতি এই পদ্ধতির স্ফটিকের বাহুগুলো সমান হয় না। |
|
৩.৩. বস্তুকেন্দ্রিক অর্থোরম্বিক (Body-centered orthorhombic): এই জাতীয় ঘনকে ৯টি পরমাণু তিনটি স্তরে সজ্জিত থাকে। এর একটি তলের কেন্দ্রে ১টি পরমাণু থাকে। এবং যথারীতি এই পদ্ধতির স্ফটিকের বাহুগুলো সমান হয় না। | |
৩.৪. পার্শ্বকেন্দ্রিক অর্থোরম্বিক (Face-centered orthorhombic): এই জাতীয় স্ফটিকে মোট ১৪টি পরমাণু থাকে। এর প্রতিতলের কেন্দ্রে ৬টি পরমাণু থাকে। এবং যথারীতি এই পদ্ধতির স্ফটিকের বাহুগুলো সমান হয় না। | |
৪.
রম্বোহেড্রাল স্ফটিক পদ্ধতি (Rhombohedral
crystal system): এই পদ্ধতির স্ফটিকের প্রধান বৈশিষ্ট্য, এদের কোণগুলো ৯০ ডিগ্রির কম হয়। এদের বাহুগুলোর দৈর্ঘ্য সমান হয়। ফলে স্ফটিকটি রম্বসের আকার ধারণ করে। এই পদ্ধতিতে পরমাণুর সংখ্যা থাকে ৮টি। |
|
৫.
ট্রাইক্লিনিক স্ফটিক পদ্ধতি
(triclinic crystal system): এই পদ্ধতির স্ফটিকের প্রধান বৈশিষ্ট্য, এদের কোণগুলো ৯০ ডিগ্রির কম হয়। তবে বাহুগুলো সমান হয় না। এই পদ্ধতিতে পরমাণুর সংখ্যা থাকে ৮টি। |
|
৬. মনোক্লিনিক
স্ফটিক পদ্ধতি (monoclinic
crystal system): এই পদ্ধতির স্ফটিকের প্রধান বৈশিষ্ট্য, এদের একটি কোণ ৯০ ডিগ্রির কম হয়। অন্য দুটি কোণ ৯০ ডিগ্রির সমান হয়। এই পদ্ধতিতে পরমাণুর সংখ্যা থাকে ৮ বা ৯টি হয়। পরমাণুর সংখ্যার উপর ভিত্তি করে এই জাতীয় স্ফটিক দুই প্রকার হয়ে থাকে। এই প্রকার দুটি হলো- |
|
৬.১.
সাধারণ মনোক্লিনিক
(Primitive monoclinic):
এই পদ্ধতির স্ফটিকের প্রধান বৈশিষ্ট্য, এদের একটি কোণ ৯০ ডিগ্রির কম হয়। অন্য দুটি কোণ ৯০ ডিগ্রির সমান হয়। এই পদ্ধতিতে পরমাণুর সংখ্যা থাকে ৮টি হয়। |
|
৬.২.
ভিত্তি-কেন্দ্রিক মনোক্লিনিক
(base-centered monoclinic):
এই পদ্ধতির স্ফটিকের প্রধান বৈশিষ্ট্য, এদের একটি কোণ ৯০ ডিগ্রির কম হয়। অন্য দুটি কোণ ৯০ ডিগ্রির সমান হয়। এই পদ্ধতিতে পরমাণুর সংখ্যা থাকে ১০টি। এর উপরের ও নিচের তলের কেন্দ্রে দুটি পরমাণু থাকে। |
|
৭.
হেক্সাগোনাল স্ফটিক পদ্ধতি
(hexagonal crystal system): এই পদ্ধতির স্ফটিকের প্রধান বৈশিষ্ট্য, এদের কোণগুলো ৯০ ডিগ্রির কম হয়। এর মোট ১৪ পরামাণু ১৪টি বিন্দুতে স্থাপিত থাকে। ছয়টি পরমাণু নিয়ে একটি ষড়ভুজ তৈরি হয় এবং তার কেন্দ্রীয় বিন্দুতে একটি পরমাণু থাকে। এই রকম দুটি সেটের পরমাণুগুলো পরস্পরের সাথে যুক্ত থাকলে, এর এক সেটের কেন্দ্রীয় পরমাণুর সাথে অপর সেটের কেন্দ্রীয় পরমাণুর সাথে যুক্ত থাকে না। এর বাহুগুলো পরস্পর সমান হয়। এই পদ্ধতির রত্ন হলো– বৈদূর্য। |