মহাবিশ্ব
[অভিধান: মহাবিশ্ব]

সাধারণভাবে মহাকাশের অন্তর্গত সকল সত্তার সমন্বিত নাম। এর ভিতরে রয়েছে বস্তু ও শক্তির সমাবেশ। এই বিচারে মহাবিশ্বে কোন শূন্যতা নেই।

মানুষের দর্শনেন্দ্রিয়ে যা ধরা পড়ে না, তা দৃষ্টিশূন্যতা সৃষ্টি করে। এ দৃষ্টিশূন্যতার সামনে বা পিছনে যখন কোনো দৃশ্যমান সত্তা থাকে, তখন মানুষ দৃষ্টিশূন্যতার ভিতর দিয়ে ওই দৃশ্যমান সত্তা দেখে। মানুষের রয়েছে দূরে দেখার একটি সর্বোচ্চ ক্ষমতা। দৃষ্টিশূন্যতা এবং দৃষ্টিক্ষমতার সমন্বয়ে বহুদূরে তাকালে- দর্শনেন্দ্রিয়ে এক ধরনের আচ্ছাদনের অনুভব সৃষ্টি হয়। এই অনুভবই হলো আকাশ।

খোলা মাঠে মাথার উপরের দিকে তাকালে যে আচ্ছাদন দেখতে পাওয়া যায়, সেটাকেই এক সময় মানুষ আকাশ নামে চিহ্নিত করেছিল। আদিম কালের মানুষ আকাশের গায়ে চন্দ্র-সূর্য ছাড়াও  দেখতে পেত অসংখ্য তারা, উল্কাপতন, ধূমকেতু। তারপরেও আদিমকালের মানুষ এই অসীম আকাশের ভিতরে সসমী সব কল্পনার ছবি এঁকেছিল। কালক্রমে বিজ্ঞানের সূত্রে সেই সসীম আকাশ অসীম স্তরে পৌঁছে গেছে। মহাকাশ হলো সেই অসীম স্তরের ধারণা।
 
মানব সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে আকাশ সম্পর্কে মানুষের মনে যে কৌতুহলের সৃষ্টি হয়েছিল, তারই সূত্রে মহাকাশ এবং মহাবিশ্বের ধারণার বিকাশ ঘটেছে। প্রাচীনকালের পণ্ডিতরা মহাকাশ গবেষণার কেন্দ্রবিন্দুতে পৃথিবীকে স্থাপন করে, মহাকাশকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে প্রাচীন কাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত গ্রিক, রোমান, মধ্যপ্রাচ্যে, মিশর, চীন, ভারত প্রভৃতি অঞ্চলের বিজ্ঞানীরা নানাভাবে মহাবিশ্বকে দেখার চেষ্টা করেছেন। প্রাচীনকালের মতবাদগুলো এখন আর ততটা মূল্য না পেলেও, গবেষণার ক্রমধারায় এই সকল মতবাদ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

মহাবিশ্ব সম্পর্কে ধারাবাহিক ভাবনার বিকাশ ঘটেছে মূলত গ্রিস ও ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের দ্বারা।
গোড়ার দিকে গ্রিস দার্শনিকরা মনে করতেন, পৃথিবীটা থালার মতো। আর সেই থালাটি আছে কচ্ছপের স্তম্ভের উপরে। এ্যাটলাসের কাঁধে করে পৃথিবীটাকে ধরে রেখেছেন, এ তত্ত্ব গ্রিক পুরাণে আছে। এই সকল তত্ত্ব থেকে বের হয়ে এসে, এ্যারিস্টোটল নতুনভাবে ভাবতে পেরেছিলেন। চন্দ্রগ্রহণের সময় পৃথিবীর ছায়া গোলাকার দেখে, এ্যারিস্টোটেল ধরে নিয়েছিলেন পৃথিবীটা গোলাকার। আর সেটা যে চ্যাপটা নয়, তা তিনি অনুমান করেছিলেন ধ্রুবতারা পর্যবেক্ষণ করে। কারণ, পৃথিবী গোলাকার বলেই উত্তর মেরু থেকে ধ্রুবতারা মাথার উপরে দেখা যায় আর বিষুব অঞ্চল থেকে দিকচক্রবালে দেখা যায়। এছাড়া গভীর সমুদ্র থেকে বন্দরের দিকে জাহাজ আসার সময়, প্রথমে এর মাস্তুল এরপরে পাল দেখা যায়। এই পর্যবেক্ষণ দ্বারাও এ্যারিস্টোটল প্রভাবিত হয়েছিলেন। এ্যারিস্টোটল পৃথিবীকে স্থির বিবেচনা করেছিলেন এবং পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্য চন্দ্র, গ্রহ ও অন্যান্য তারকারা আবর্তিত হচ্ছে এটাও তিনি অনুমান করেছিলেন। তাঁর মতে মহাবিশ্ব একটি নিখুঁত বৃত্তাকার। এ্যারিস্টোটল-এর এই ধারণাকে সম্প্রসারিত করে, বিজ্ঞানী টলেমি একটি মহাকাশীয় মডেল উপস্থাপন করেছিলেন।

টলেমির মহাবিশ্বের নমুনা

টলেমির মহাকাশীয় মডেল
টলেমিএ্যারিস্টোটল-এর মতই, মহাবিশ্বের কেন্দ্র হিসাবে পৃথিবীকে বিবেচনা করেছিলেন। তাঁর মতে পৃথিবীকে ঘিরে ছিল মোট ৮টি গোলক। এই গোলকগুলোর ভিতরে পৃথিবীর নিকটতম গোলকটি ছিল 'চন্দ্রগোলক'। আর দূরের গোলক ছিল স্থির নক্ষত্রসমূহের গোলক। মাঝের গোলকগুলো ছিল সৌর্য এবং অন্যান্য গ্রহের জন্য নির্ধারিত। নিচে এই গোলকগুলোর পরিচয় তুলে ধরা হলো।

০= পৃথিবী

১= চন্দ্রগোলক
২=বুধের গোলক
৩=শুক্রের গোলক
৪. সূর্যের গোলক


 

৫=মঙ্গলের গোলক
৬=বৃহস্পতির গোলক
৭=শনির গোলক
৮= স্থির নক্ষত্রসমূহের গোলক

টলেমি চাঁদের সাথে পৃথিবীর সম্পর্ককে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ঈশ্বর বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর মডেল অনুসারে পুরোহিতরা মনে করেছিলেন যে, স্বরগ নরক রয়েছে বাইরের গোলকের ঊর্ধ্বে। সেই কারণে ধর্মের সাথে তিনি সংঘাত এড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন।

টলেমিএই ধারণার সাথে তৎকালীন কোনো ধর্মের সংঘাত হয় নি। আবার পরবর্তী সময়ে যে সকল বিজ্ঞানীরা মনে করতেন টলেমির এই ধারণা ঠিক নয়, তাঁরা পুরোহিতদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সাহস পান নি। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো বিজ্ঞানী কোপার্নিকাস। সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ঘুরছে এই সত্যকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কিন্তু তার জন্য গ্যালিলিও গ্যালিলাইকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল।