গ্যালিলিও গ্যালিলাই (Galileo
Galilei)
(১৫৬৪-১৬৩২
খ্রিষ্টাব্দে)
ইতালিয়ান গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী,
দার্শনিক, পদার্থবিজ্ঞানী।
১৫৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি ইতালির পিসা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। গ্যালিলিওরা পাঁচ ভাইবোনের
ভিতর বড় ছিলেন। এর ভিতরে দুই জনের মৃত্যু হয়েছিল
শৈশবে। তাঁর পিতা ভিনসেনজো গ্যালিলাই (Vincenzo
Galilei)
লুট নামক ততযন্ত্র-বাদক এবং সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। এই সূত্রে গ্যালিলিও লুট বাদক হিসেবে
খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তাঁর ছোট ভাই মাউকেলাঞ্জেলো এই যন্ত্রে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন।
১৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে গ্যালিলিওর পিতা সপরিবারে ফ্লোরেন্সে চলে আসেন। শৈশবে তিনি ফ্লোরেন্সের নিকটবর্তী ভাল্লোম্ব্রোসার একটি মঠ-বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এরপর তাঁর পিতার ইচ্ছায় তিনি ১৫৮১ খ্রিষ্টাব্দে ডাক্তারি পড়ার জন্য পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এই সময় তিনি পিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গণিত এবং দর্শন পড়ার জন্য মনস্থির করেন।
১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি
ডাক্তারি
পড়া অসমাপ্ত রেখে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ
করেন। এরপর তিনি কয়েক বছর ব্যক্তিগতভাবে ফ্লোরেন্স এবং সিনার কয়েকজন গণিতজ্ঞের কাছে
গণিত ও গতি বিষয়ক পাঠ গ্রহণ করেন।
১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দে
হাইড্রোস্ট্যাটিক-এর উপর একটি ছোট বই রচনা করেন। এই বইটির মাধ্যমে তিনি
বিজ্ঞানীমহলে পরিচিতি লাভ করেন। এই সূত্রে তিনি বোলোগোনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক
হওয়ার আবেদন করে ব্যর্থ হন। এরপর তিনি গণিতের উপর বেশ কিছু উপপাদ্য রচনা করেন। যার
মাধ্যমে ওই সময়ের বিজ্ঞানীদের কাছে প্রশংসা লাভ করেন। ধারণা করা এই সময়ে
ছাদ থেকে
ঝুলন্তবাতির দোলন পর্যবেক্ষণ করে দোলনের সূত্র আবিষ্কার করেন।
এই সূত্র অনুসরণ করে ক্রিস্টিয়ান হাইগেন (Christiaan
Huygens)
দোলক-ঘড়ি আবিষ্কার করেছিলেন। এরপর তিনি থার্মোস্কোপ আবিষ্কার করেন। উল্লেখ্য এই
যন্ত্রটির আধুনিক সংস্করণকে বলা হয় থার্মোমিটার।
১৫৮৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ফ্লোরেন্সের Accademia
delle Arti del Disegno-এতে
যোগদান করেন।
১৫৮৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতবিভাগে যোগদান করেন। এই বছরে তিনি
পিসার হেলান মন্দির থেকে 'স্বর্ণমূদ্রা ও পালক' পরীক্ষা সম্পন্ন করেন। এর দ্বারা
এ্যারিস্টোটল-এর তত্ত্ব বাতিল হয়ে যায়।
উল্লেখ্য,
এ্যারিস্টোটল মনে করতেন উচ্চস্থান থেকে ভারি ও হাল্কা বস্তু একই সাথে ছেড়ে দিলে
ভারি বস্তু দ্রব্যগুণের কারণে আগে মাটিতে পড়বে। গ্যালিলিও এই পরীক্ষায় দেখান যে,
বাধাহীন অবস্থায় উভয় বস্তু একই সময়ে পড়বে। কিন্তু
এ্যারিস্টোটল-এর ভক্তদের কাছে তিনি এই
পরীক্ষার পর অপ্রিয় হয়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকদের
বাধা সত্ত্বেও
বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে
১৫৯২
খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষক হিসেবে নতুন চুক্তি করেন। উল্লেখ্য এর ভিতরে
১৫৯১ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। ফলে সংসারের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয় তাঁকে।
এই সময় তাঁকে আর্থক কষ্টের ভিতর কাটাতে হয়।
১৫৯২
খ্রিষ্টাব্দে তিনি পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন। এখানে তিনি জ্যামিতি,
যন্ত্রকৌশল এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান পড়াতেন। ১৬০৯ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি জানতে পারেন
যে, নেদারল্যান্ডে দূরে জিনিস কাছে দেখার যন্ত্র আবিষ্কার হয়েছে। এরপর তিনি নিজের
চেষ্টা শক্তিশালী টেলিস্কোপ তৈরি করেন এবং এই যন্ত্রের ব্যাপক উন্নতি করেন। এই
যন্ত্রটি পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদর্শনের পর, বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি খ্যাতি লাভ
করেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর বেতন প্রায় দ্বিগুণ করে দেয়। এই বছরেই তিনি
দূরের বস্তু প্রায় ২০গুণ বর্ধিত আকারে দেখার মতো টেলিস্কোপ তৈরি করেন এবং এই বছরের
চন্দ্রগ্রহণ পর্যবেক্ষণ করেন। এই সময়ের ভিতরে তিনি কাইনেটিক মোশান এবং জ্যোতির্বজ্ঞানের কিছু
মৌলিক সূত্র অনুধাবন করতে সক্ষম হন।
১৬১০ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে তিনি
বৃহস্পতি
গ্রহের চারটি উপগ্রহ আবিষ্কার করেন। এই
উপগ্রহগুলো হলো−
আইও (Io),
ইউরোপা (Europa),
গ্যানিমেডে (Ganymede)
এবং ক্যালিস্টো (Callisto)।
এই উপগ্রহগুলোকে বলা হয় গ্যালিলিও উপগ্রহসমূহ (Galilean
satellites)। তাঁর
আকাশ পর্যবেক্ষণের ফলাফল নিয়ে এই বছরে প্রকাশিত হয় The Starry Messenger
(Latin: Sidereus Nuncius)
গ্রন্থটি। গ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন তুসকেনির ডিউক Cosimo II de
Medici (1590-1621) এর
নামে। এই কারণে তিনি এই ডিউকের কাছে পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া ডিউক তাঁকে গণিত ও
দর্শনের শিক্ষক হিসেবে তুসকানির শিক্ষালয়ে নিয়োগ দেন। ফলে তিনি
পাদুয়া
বিশ্ববিদ্যালয়ে ত্যাগ করে,
তুসকানিতে চলে আসেন।
পাদুয়া ত্যাগ করার আগেই তিনি
শনি গ্রহের অস্পষ্টতা লক্ষ্য। পরে অবশ্য জানতে পারেন
যে, এর বলয়ের জন্য এমনটা ঘটে থাকে।
গ্যালিলিওর সবচেয়ে আলোচিত অধ্যায় হলো সূর্যকেন্দ্রিক সৌরজগতের ধারণা। যদিও ইউরোপ ও
আরবের কিছু বিজ্ঞানী টলেমির সৌরজগতের মডেলের ত্রুটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন।
কিন্তু ১৫৪৩ খ্রিষ্টাব্দে নিকোলাস কোপার্নিকাস তাঁর
De revolutionibus orbium
coelestium (On the Revolutions of the Heavenly
Spheres) গ্রন্থে
উল্লেখ করেন যে, সূর্য সৌরজগতের কেন্দ্রে অবস্থিত এবং পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে
আবর্তিত হচ্ছে। তবে এই গ্রন্থ গির্জার গ্রন্থাগারে চাপা পড়েছিল। জিওনার্দো ব্রুনো
এই গ্রন্থটি পাঠ করে কোপার্নিকাসের তত্ত্বকে প্রচার করেন। এই কারণে তিনি গির্জার
রোসানলে পড়েন এবং ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল।
কোপার্নিকাস এবং ব্রুনোর ব্যাখ্যা সত্য হলেও তা ছিল ধারণা। গ্যালিলিও তাঁর নব
আবিষ্কৃত দূরবীক্ষণযন্ত্র এবং গণিতের সাহায্যে এঁদের ধারণাকে প্রামাণ্য করে তোলেন।
পৃথিবী যে সূর্যের গ্রহ এবং তা সূর্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়, এটা প্রমাণ করার
জন্য তিনি দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণা করেন। এই বিষয়ে ১৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর
Dialogue Concerning the Two Chief
World Systems গ্রন্থটি
প্রকাশিত হয়। এরপর ভ্যাটিকানের তৎকালীন পোপ ক্ষুব্ধ হন এবং তিনি গ্যালিলিওকে এসব
বিষয়ে কথা না বলার নির্দেশ দেন। গ্যালিলিও এই আদেশ অমান্য করলে, তিনি ইতালির সম্রাট
কাউলান বেলারমিনকে জানান। সম্রাট গ্যালিলিওকে এই প্রচারণার বিপদের কথা বুঝান। শেষ
পর্যন্ত গ্যালিলিও এই সত্যকে প্রত্যাহার করেন। কিন্তু এই পোপের মৃত্যুর পরে নতুন
পোপের আদেশে তাঁকে গৃহবন্দী করা হয়। প্রায় নয় বৎসর গৃহবন্দী থাকার পর, ১৬৪২
খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।
তিনি মারিনা গাম্বা (Marina
Gamba) কে বিবাহ করেন। এঁদের
তিনটি
সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। এঁরা হলেন দুই কন্যা ভার্জিনিয়া (জন্ম ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দ),
লিভিয়া (জন্ম ১৬০১ খ্রিষ্টাব্দ) এবং পুত্র ভিনসেনজো (১৬০৬ খ্রিষ্টাব্দ)।
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ তালিকা