ওগাঁ সদর উপজেলা
নওগাঁ জেলার সদর উপজেলা। এর উত্তর নওগাঁ জেলার বদলগাছি ও মহাদেবপুর উপজেলা, পূর্বে বগুড়া জেলা, দক্ষিণে নওগাঁ জেলার রাণীনগর উপজেলা। এবং পশ্চিমে নওগাঁ জেলার মান্দা ও মহাদেবপুর উপজেলা।

নওগাঁ সদর উপজেলার ইউনিয়নগুলো হলো: বর্ষাইল, বক্তারপুর, হাপানিয়া, বোয়ালিয়া, চণ্ডিপুর, শিকারপুর, কীর্তিপুর, তিলকপুর, দুবলহাটি, হাঁসাইগাড়ি, বলিহার ও শৈলগাছি।

নওগাঁ জেলা
এবং সদর উপজেলার সদর কার্যালয় নওগাওঁ শহরে অবস্থিত। নওগাঁ শহরটি উপনদী ছোটো যমুনা’-র পশ্চিম তীরে  ২৪ডিগ্রী ৪৯ইঞ্চি উত্তর অক্ষাংশে এবং ৮৮ ডিগ্রী- ৫৭ ইঞ্চি পূর্ব  দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। উপজেলাটি এক প্রান্ত পূর্ব সীমানার প্রায় মধ্য ভাগে অবস্থিত। নওগাঁ শহরের কেন্দ্রস্থল হতে মাত্র চার মাইল পূর্বে বগুড়া জেলার সান্তাহার রেলওয়ে জংশন।

নওগাঁ শব্দর উৎপত্তি হয়েছে ‘নও’ (নতুন -ফরাসী শব্দ ) ও‘ গাঁ’ (গ্রাম ) শব্দ দু’টি হতে। এই শব্দ দু’টির অর্থ হলো নতুন গ্রাম। মূলত আত্রাই নদী তীরবর্তী এলাকায় নদী বন্দর এলাকা ঘিরে যে নতুন গ্রাম গড়ে উঠেছিল, কালক্রমে তা-ই নওগাঁ নামে পরিচিত লাভ করে। কৃষি কাজের জন্য ‌এই অঞ্চল অত্যন্ত উপযোগী ছিল। ফলে এই অঞ্চলের বিভিন্ন অংশে বহু স্থানীয় জমিদার গোষ্ঠী গড়ে উঠে । এ জমিদার গোষ্ঠীর আশ্রয়েই কৃষি কাজ সহযোগী হিসেবে সাঁওতাল গোষ্ঠীর আগমন ঘটতে শুরু করে এ অঞ্চল । সাঁওতাল গোষ্ঠীর মতে এ জেলায় সে সময়ে মাল পাহাড়িয়া, কুর্মি, মহালী ও মুণ্ডারও স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে । কিন্তু বৌদ্ধযুগে এই অঞ্চল চমৎকার শিক্ষা ও সংস্কৃতির চর্চা ছিল, তা নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছিল। এই বিচারে বৌদ্ধযুগের পর, দীর্ঘদিন এই অঞ্চল অবহেলিত জনপদে পরিণত হয়েছিল।

বর্তমান আত্রাই উপজেলার সাহেবগঞ্জ, রাণীনগরের চকউজীর, মান্দার জোকাহাট-ডাসপাড়া ও কালিকাপুর নীলকুঠি বিখ্যাত ছিল। ১৮৫৯-৬১ খ্রিষ্টাব্দে নীল বিদ্রোহ এই অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৮৫৯-৬১ সালের নীল বিদ্রোহ এই অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছিল এবং সংগ্রামী নীল চাষীদের হাতে নাজেহাল ইংরেজ কুঠিয়ালরা তখনকার মতো নীল চাষ গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। এই বিদ্রোহ রোধ করার জন্য সম্ভবত এখানে একটি নতুন মহকুমা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হয়েছিল। এই সূত্রে ইংরেজরা একটি নতুন প্রশাসনিক এলাকা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। প্রাথমিকভাবে এরা নওগাঁকে নির্বাচন করে মহকুমা সদর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেয়। ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে নওগাঁ ছিল রাজশাহী জেলার বান্দাইখাড়া থানাধীন একটি ছোট নদী বন্দর। ১৮৭৫-৭৭ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে বান্দাইখাড়া থেকে পৃথক করে নওগাঁকে থানায় পরিণত করা হয়। ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দের পর বেঙ্গল সেন্সাস রিপোর্ট অনুযায়ী তখন এর আয়তন ছিল ৬০৩ বর্গমাইল এবং লোকসংখ্যা ২,৬৮,৫৭৯ জন মাত্র। অন্যদিকে ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দের পর নাটোরের সিংড়া থানার অংশ বিশেষ এবং সন্নিহিত অন্যান্য এলাকা থেকে কিছু অংশ নিয়ে ১৬৫ বর্গমাইল আয়তন বিশিষ্ট পাঁচুপুর থানা গঠিত হয়। সে সময় এর লোক সংখ্যা ছিল দাঁড়ায় ৭৯,৪৩১ জন মাত্র। আর আগে থেকেই  মান্দা থানা ছিল। ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে মান্দার আয়তন ২৯৯ বর্গমাইল এবং লোক সংখ্যা ১,০৩,৩০৮ জন ছিল। ওই সময় জেলার সীমানা অনুসারে পাঁচুপুর-নওগাঁ-মান্দা এলাকাটি রাজশাহী জেলার একটি প্রত্যন্ত অঞ্চল ছিল। ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে মান্দা, নওগাঁ এবং পাঁচুপুর থানা নিয়ে নওগাঁকে রাজশাহী জেলার মহকুমা তৈরি হয়। কিন্তু গোড়াতেই নওগাঁ মহকুমার মর্যাদা পা্য় নি।

১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে নর্দান বেঙ্গল রেলপথ চালু হওয়ার আগে, ভাগীরথী-পদ্মা নৌপথই ছিল রাজধানী কলকাতার সঙ্গে জেলা সদর রাজশাহীর যোগাযোগের প্রধান অবলম্বন। ঐ পথে সহজে যাতে নতুন মহকুমা সদরে পৌঁছা যায়, সেজন্য রাজশাহীর অপেক্ষাকৃত নিকটবর্তী স্থান মান্দা থানার এলেঙ্গা গ্রামে প্রথমে মহকুমা অফিস স্থাপন করা হয়। গ্রামটি এখন প্রসাদপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত। সেকালে মান্দা অঞ্চলে ডাকাতদের তৎপরতা বৃদ্ধি ও সেখানে মহকুমা সদর কার্যালয় স্থাপনের অন্যতম কারণ হতে পারে। বর্তমান মান্দা থানা ও ডাকবাংলার পার্শ্ববর্তী একটি স্থানকে লোকে ডাকিনীতলা বলে। সাধু ব্যবহারে একে দক্ষিণতলা বলা হয়। কথিত আছে যে, পূর্বে ডাকাতি করতে যাবার সময় ডাকাতরা সেখানে মহিমাময়ী দক্ষিণী মা দুর্গার উদ্দেশ্যে ছাগবলি দিত। ‘দক্ষিণী’ শব্দটি ‘দাক্ষায়নী’ (সতী)-র অপভ্রংশ হতে পারে। তখন থানা সদর মাইল ছয় পশ্চিমে ঠাকুরমান্দাতে ছিল।

মহকুমা সদর বেশ কিছুকাল এলেঙ্গা গ্রামেই ছিল। এদিকে ১৮৭৪-৭৫ সালে নর্দান বেঙ্গল রেলপথের কাজ শুরু হয়ে যায়। রেলপথ স্থাপন সুনিশ্চিত জেনে মহকুমার প্রান্তসীমায় অবস্থিতি সত্ত্বেও যোগাযোগ সুবিধার দিকে লক্ষ্য রেখে রেলপথের নিকটবর্তী বন্দর নওগাঁয় তা স্থানান্তর করা হয়। নওগাঁ মহকুমা কার্যালয়ের পুরানো কাগজপত্রে যে রাবার সীলের ছাপ লক্ষ্য করা গেছে তা সবই ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দের। ফলে কেউ কেউ ভুল করে ঐ বছরকে মহকুমার প্রতিষ্ঠাকাল ভেবে থাকেন। তবে এমন হতে পারে যে, ঐ বছরই মহকুমা সদর এলেঙ্গা থেকে নওগাঁয় স্থানান্তরিত হয়েছিল কোন নিশ্চিত হতে নেই।

নওগাঁয় মহকুমা সদর স্থাপন বা স্থানান্তরের পেছনে যোগাযোগ সুবিধা ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক স্বার্থ নিহিত ছিল বলে জানা যায়। নওগাঁর প্রাক্তন মহকুমা প্রশাসক (১৯৩১-’৩৩) ও বাংলা সাহিত্যের বরেণ্য লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় -এর মতে, ‘নওগাঁ মহকুমা সৃষ্টির মূলে গাঁজার চাষ।’ তৎকালীন জেলা সীমানা অনুসারে যমুনা নদী বালুভরার নিকট থেকে শুরু করে নওগাঁ শহরের মধ্য দিয়ে প্রায় পনেরো মাইল দক্ষিণ অবধি বগুড়া ও রাজশাহী জেলার মাঝে সীমারেখা এঁকে প্রবাহিত হবার পরে পুরোপুরি রাজশাহী জেলায় প্রবেশ করতো। অর্থাৎ যমুনার পূর্বতীরবর্তী পার-নওগাঁ, সুলতানপুরসহ দক্ষিণে রঘুরামপুরের (এখন সাহাগোলা) সন্নিহিত পশ্চিম এলাকা পর্যন্ত বগুড়া জেলার অন্তর্গত। বালুভরা এবং বদলগাছির সংলগ্ন কয়েকটি পশ্চিম তীরবর্তী গ্রাম বদলগাছি থানার মধ্যে থাকলেও ঐ থানা প্রধানত যমুনার পূর্বতীরে বিস্তৃত ছিল। বদলগাছি থানা তখন বগুড়া জেলার অধীনে ছিল। পূর্বে বগুড়া জেলার বদলগাছি এবং পশ্চিমে দিনাজপুর জেলার মহাদেবপুর থানার মধ্যবর্তী একটি সঙ্কীর্ণ গলি হয়ে নওগাঁ থানার সীমানা সম্ভবত চাকরাইলেরও উত্তর অবধি প্রসারিত ছিল। ১৯১৩-১৪ খ্রিষ্টাব্দে -এর জরিপ মানচিত্র অনুসারে বর্তমানে বদলগাছি থানার অন্তর্গত চাকরাইল নওগাঁ থানার অধীনে ছিল।

নওগাঁ পৌর এলাকা বর্তমানে যথেষ্ট সম্প্রসারিত হলেও শহরের কেন্দ্র এবং তৎসন্নিহিত খাস-নওগাঁ, হাট-নওগাঁ, পার-নওগাঁ, আরজী-নওগাঁ, চক ইলাম, চকদেব, চক এনায়েত, চকমুক্তার ও গঞ্জ নওগাঁই সাধারণভাবে নওগাঁ শহর হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ক্যাডাস্ট্রিয়াল সার্ভে রেকর্ডে নওগাঁগঞ্জ নামে একটি পৃথক মৌজা ছিল। তবে এখন তা বিলুপ্ত। চল্লিশ বছর পূর্বেও বাঙ্গাবাড়ি দূর্গাপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত ছিল।

১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত একটি ক্ষুদ্র পুস্তিকাসূত্রে জানা যায় যে, নওগাঁ শহরের প্রাচীন অধিবাসী তরফদারগণ  সুদূর আজমীর (মতান্তরে বাগদাদ) থেকে এসে এখানে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে মুর্শিদাবাদের নবাব সরকার হতে তাঁর ‘তরফদার’ খেতাব পান।

১৭৬৪ খ্রিষ্টাব্দে জেমস রেনেল বাংলায় ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিকৃত এলাকাসমূহের জরিপ কাজ আরম্ভ করেন। মেজর রেনেল ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের প্রথম ভূচিত্রাবলী প্রকাশ করেন। রেনেলের মানচিত্রে একটি নদী বন্দর হিসেবে নওগাঁর সুষ্পষ্ট উল্লেখ আছে। রাজস্ব বিভাগের পুরাতন দলিলপত্রানুসারে ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে নওগাঁয় ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি ফ্যাক্টরি ছিল। ফ্যাক্টরিটি কুমারখালি কুঠির তত্ত্ববাবধানে পরিচালিত হতো।

১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দে নওগাঁ ছিল দুবলহাটী থানার অধীন। ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দের এর পূর্বেই কোন এক সময় থানা সদর বান্দাইখাড়াতে স্থানান্তরিত হয়। এই সময় নওগাঁর সংলগ্ন, যমুনা নদীর পূর্ব তীরবর্তী সুলতানপুর তখন বগুড়া জেলার অধীন ছিল। সুলতানপুর দুপচাঁচিয়ার আনন্দনাথ চৌধুরীর এবং দুবলহাটির জমিদারীর অন্তর্গত ছিল। সে সময় চাউলের ব্যবসায় এবং ইংরেজ বণিকদের রেশম কেনাবেচার জন্যে সুলতানপুর বাজারের যথেষ্ট প্রসিদ্ধি ছিল। কিন্তু ঐ বাজারে খাজনা ভাগাভাগি নিয়ে দুই জমিদারের বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। এরপর দুবলহাটির রাজা নিজ এলাকা নওগাঁয় পাল্টা বাজার বসান। এই পাল্টা বাজারটি প্রথমে নওগাঁর ডালপট্টি এলাকায় বসতো। বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক পর্যন্ত তা সেখানেই ছিল বলে জানা যায়। দুবলহাটীর জমিদারের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই নতুন বাজারের বিকাশে তৎকালে উদীয়মান প্রভাবশালী ব্যবসায়ী তিনকড়ি সাহা, বলাই সাহা, মহেশ সাহা এবং পার-নওগাঁর মাতম বানিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

রাজা ব্যক্তিগত প্রভাবে নওগাঁর বাজার দ্রুত জমে ওঠে। এর ফলে সুলতানপুর তৃতীয় শ্রেণীর একটি গ্রাম্য বাজারে পরিণত হয়। অচিরে নওগাঁ বাজার রাজশাহী জেলার উত্তরাঞ্চল ও বগুড়া জেলার পশ্চিমাঞ্চলের পণ্য আমদানীর একটি প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। সে সময় বদলগাছি ও আদমদীঘির উৎপাদিত চালের প্রধানতম বাজার তখন নওগাঁ।

নওগাঁ শহরে অর্থনৈতিক কেন্দ্র হয়ে উঠার কিছু পরে, সুদূর রাজস্থানের বিকানির থেকে কয়েকজন ভাগ্যান্বেষী মাড়োয়ারী নওগাঁ শহরে এসে ব্যবসায় শুরু করেন। নওগাঁর কাজী পরিবারের অবস্থা তখন তুঙ্গে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত নওগাঁর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন মাড়োয়ারীগণ এবং কাজী পরিবার। প্রবাদ ছিল যে নওগাঁ শহরের বারো আনা মাড়োয়ারীদের আর কাজীদের, বাকি চার আনা অন্যদের।

নওগাঁ মহকুমা সদর হবার পরেও বেশ কিছুকাল মুন্সেফকোর্ট বান্দাইখাড়াতে ছিল বলে জানা যায়। সম্ভবত সে কারণেও থানা নওগাঁয় স্থানান্তরিত হলেও সেখানে একটি পুলিশ আউটপোস্ট থেকে যায়। পরে পার্শ্ববর্তী নন্দনালী গ্রামে স্বতন্ত্র থানা হয়।

নওগাঁতে মহকুমা সদর প্রতিষ্ঠিত হবার সময়কালে এখানে সরকারি কোন পাকা ভবন ছিলনা। প্রথম দিকে, এমনকি থানা এবং হাজত খানা পর্যন্ত ছিল বেড়া ও টিনের চালা ঘরে। নওগাঁ শহরের প্রথম পাকা ভবন নির্মাণ করেন চগনলাল আগরওয়াল। তারপর বজরঙ্গ লাল আগরওয়াল এর পিতা লাদুরাম মাড়োয়ারী পাকা ভবন নির্মাণ করেন। তার সমকালে অথবা কিছু পরে নওগাঁ বাজারকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য ‘ভবানী ভাণ্ডার’ নির্মিত হয়। দুবলহাটীর জমিদার ঘনদানাথ চৌধুরী এটি নির্মাণ করান বলে অনেকের অভিমত। জমিদারের নিজস্ব উদ্যোগে ভবানী ভাণ্ডারে বিরাট দোকান খোলা হয়। এটি ছিল বিশাল আকারের মুদি দোকান। প্রবাত আছে, সেখানে নামি এক কথায় মাটির পাতিল আর কলাপাতা ছাড়া সবই নাকি পাওয়া যেত। ভবানী ভাণ্ডারের আগে বা সমকালে কাজীদের পাকা ভবন নির্মিত হয়।

১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে নওগাঁর তৎকালীন সাব-ডেপুটি কালেক্টর ও গাঁজা মহালের সুপারভাইজার বাবু কৃষ্ণধন বাগচির উদ্যোগে শহরে একটি এন্ট্রেন্স স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়।  ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে দুবলহাটির জমিদারের উদ্যোগে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯৬-৯৭ খ্রিষ্টাব্দে নওগাঁ মহকুমার সীমানা ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। ঐ সময় দিনাজপুর জেলা থেকে মহাদেবপুর থানাকে এবং বগুড়া জেলা থেকে বদলগাছি থানাকে রাজশাহী জেলার নওগাঁ মহকুমার সাথে যুক্ত করা হয়। বগুড়া জেলার আদমদিঘি এবং নবাবগঞ্জ থানার অনেক এলাকাও নওগাঁ মহকুমার অন্তর্ভূক্ত হয়। সুলতানপুরসহ যমুনার পূর্বতীরের বিস্তৃত এলাকায় নওগাঁর সীমানা প্রসারিত হয়। উল্লেখ্য বদলগাছি থানা ১৮২১ খ্রিষ্টাব্দে বগুড়া জেলা গঠনের পূর্বে দিনাজপুর জেলার অন্তর্ভূক্ত ছিল।

বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগেই নওগাঁ মহকুমার থানাগুলোর সীমানা পুনর্বিন্যস্ত হয় এবং নতুন কয়েকটি থানা গঠিত হয়। ১৯১১-১২ খ্রিষ্টাব্দে সম্ভবত পাঁচুপুর ও নওগাঁর অংশবিশেষ নিয়ে রাণীনগর নামে একটি নতুন থানা হয়। তারপরে মান্দা থানা সদর ঠাকুরমান্দা থেকে সরিয়ে এনে আত্রাই নদীর পশ্চিম তীরে দোসতি গ্রামের বর্তমান জায়গায় স্থাপন করা হয়। মান্দার পশিচমাঞ্চল নিয়ে নিয়ামতপুর থানা গঠিত হয়। একিভাবে তৎকালীন দিনাজপুর জেলার পত্নীতলা থানার উত্তর পূর্বাঞ্চল নিয়ে নতুন ধামইরহাট থানা স্থাপিত হয়। নওগাঁ মহকুমা গঠনের আগে থেকেই আত্রাই একটি নদী বন্দর ছিল।

১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর দিল্লীতে সম্রাট পঞ্চম জর্জের অভিষেক উপলক্ষ্যে যে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় হয়েছিল, তার উদ্বৃত্ত অর্থে ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে নওগাঁ করোনেশন হল সোসাইটির জন্ম। তবে সোসাইটির বর্তমান থিয়েটার হলটির নির্মাণ কাজ সম্ভবত ১৯২০-২১ খ্রিষ্টাব্দে সম্পন্ন হয়। তখনও শহরের মর্গ বা লাশকাটা ঘরটি ছিল থিয়েটার হলের সামান্য উত্তরে (বর্তমান সমবায় ব্যাংক ভবনের নিকটে)। তার মাত্র সামান্য দূরে ভাগাড় ও মল ফেলার স্থান ছিল। সে সময় শ্মশান ছিল বর্তমান কালিতলা ক্লাব ভবনের পেছনে ‘ভুপেন বসাক নির্মিত মন্দিরের নিকটে। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়েও চকদেব পাড়ায় এম এ রকীব সাহেবের বাসভবনের পশ্চাৎভাগে, এখানকার গোরস্থানসহ বিস্তৃত এলাকা জুড়ে কেবল উলুখড়ের মাঠ ছিল।

আধুনিক নওগাঁ শহরের শুভযাত্রা শুরু হয়, ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে নওগাঁ গাঁজা উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠার পর থেকে। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে ক্যামেল পার্ক নির্মাণের দ্বারা নওগাঁর সৌন্দর্য বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এপর ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে যমুনা নদীর উপর লিটন সেতু নির্মিত হলে, নওগাঁর সাথে বাইরের যোগাযোগ সুপ্রসস্থ হয়।

১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে পাট ব্যবসায়ে আত্রাই বেশ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। সেখানকার পাট ব্যবসায়ী আহসান মোল্লা প্রভূত অর্থ ও প্রতিপত্তির অধিকারী হন। তাঁরই প্রভাবে পাঁচুপুর থানা সদর আত্রাই ঘাটে স্থানান্তরিত হয়, নামও বদলে যায়। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে মধ্যে গাঁজা সোসাইটির বেশকিছু বড় বড় ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হয়।

১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে উকিলপাড়ায় বলিহারের জমিদার নির্মিত বলিহার প্যালেস, তার প্রায় সমকালে নির্মিত গাঁজা সোসাইটির মসজিদ প্রভৃতি এখনো শহরটির সব চেয়ে দর্শনীয় ভবন। আর নওগাঁ জেলা ঘোষণার পরে, প্রাথমিকভাবে গাঁজা সোসাইটির ঐসব ‘বড় বড় ইমারত’গুলোই হয়েছিল নতুন জেলা প্রশাসনের প্রধান অবলম্বন।

পাঁচুপুর থানার পূর্বাঞ্চলের অধিবাসীদের দীর্ঘ দিনের দাবী অনুসারে এর কিছু এলাকা বগুড়া জেলার সঙ্গে যুক্ত করে সম্ভবত ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে নন্দীগ্রাম পৃথক থানা হয়।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকভারত বিভাজনের পরে তাজ সিনেমা হল, বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ডিগ্রী কলেজ, ভকেশনাল স্কুল, আধুনিক হাসপাতাল, আনসার হল, স্টেডিয়াম, সি.ও. অফিস ইত্যাদির নির্মাণ সম্পন্ন হয়। একই ধারায় সাবেক বি,এম,সি কলেজ, ডিগ্রী কলেজ, কে,ডি স্কুল, মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয় প্রভৃতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নওগাঁ শহর সম্প্রসারিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তীকালে নব-নির্মিত কালেক্টরেট ভবন ও জজকোর্টসহ নতুন নতুন সরকারি বেসরকারি প্রাসাদোপম অট্রালিকা, আধুনিক বিপণীকেন্দ্র, বাস টার্মিনাল, কল-কারখানা, বিদ্যায়তন, চিকিৎসাকেন্দ্র সব মিলিয়ে নওগাঁ হয়ে উঠেছে কর্মচঞ্চল ও শ্রীমতি এক নতুন নগর জনপদ।

১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে পুনরায় নওগাঁ মহকুমার উল্লেখযোগ্য বিস্তৃতি ঘটে। এই সময় ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের র‌্যাডক্লিফ রোয়েদাদ অনুসারে দিনাজপুর জেলার পোরশা, পত্নীতলা ও ধামুরহাট থানা বগুড়া জেলার অন্তর্ভূক্ত হয়। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে পোরশা রাজশাহী জেলার নবাবগঞ্জ মহকুমার এবং পত্নীতলা ও ধামুরহাট নওগাঁ মহকুমার সঙ্গে যুক্ত হয়।

১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠিত নওগাঁ পৌরসভা গঠিত হয়।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নওগাকে জেলায় পরিণত করার দাবি উত্থাপিত হয়। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে মহকুমাগুলো জেলায় উন্নীত হয়। এবং প্রতি জেলায় একজন ‘জেলা গভর্ণর ’ নিযুক্ত হন। কিন্তু এই ব্যবস্থা কার্যকর হবার পূর্বেই ঐ বছর পনের আগষ্ট তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে শহীদ হন। ফলে নওগাঁ মহকুমাই থেকে যায়। ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবী অনুসারে পোরশা থানাকে নওগাঁ মহকুমার অন্তর্ভূক্ত করা হয়। এবং একই বছর ২রা জুলাই এর উত্তর ভাগের ছয়টি ইউনিয়ন নিয়ে নতুন সাপাহার থানা গঠিত হয়। এই পর্যায় নওগাঁ-কে জেলার করার দাবী উত্থাপিত হতে থাকে। নওগাঁর বিভিন্ন স্তরের লোক নিয়ে জেলা বাস্তবায়ন কমিটি গঠিত হয়। এই পর্যায়ে সরকার নওগাঁ জেলা গঠনের দাবীটি নীতিগতভাবে মেনে নেন। এই সময় নওগাঁ পৌরসভাকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত করা হয়।

নওগাঁকে জেলাতে উন্নীত করার লক্ষ্যে ১৯৮০-৮১ খ্রিষ্টাব্দের ভিতর জেলা প্রশাসনের সভাকক্ষসহ টিনের ছাউনিযুক্ত অফিসসমূহের নির্মাণ কাজও সম্পূর্ণ হয়ে যায়। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা মাত্র বাকি। এমন সময় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হন। ফলে নওগাঁকে জেলা করার কার্যক্রমটি আবারও পিছিয়ে যায়। ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে সামরিক ক্ষমতা হাতে নেবার পরে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ নীতি ঘোষণা করেন। তাতে প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে সাবেক থানা সার্কেলগুলো সর্বাধিক গুরুত্ব লাভ করে। সেগুলো প্রথমে মান উন্নীত থানায় ও পরে উপজেলায় রূপান্তরিত হয়। এরপর সরকার মহকুমাগুলোকে জেলায় উন্নীত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৮৩-র শেষভাগ হতে ৮৪-র প্রথম ভাগের মধ্যে যথেষ্ট দ্রুততার সঙ্গে সাবেক মহকুমাগুলো জেলায় রূপান্তরিত হয়। ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দের পহেলা মার্চ বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন মহিলা বিষয়ক মন্ত্রী ড. শাফিয়া খাতুন আনুষ্ঠানিকভাবে নওগাঁ জেলা উদ্বোধন করেন। ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে নওগাঁ পৌরসভাকে প্রথম শ্রেণীতে উন্নীত করা হয়।