নওগাঁ জেলা
 

বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী বিভাগের একটি জেলা।
স্থানাঙ্ক : ২৪০৭/ -২৪৪৩/  উত্তর অক্ষাংশ ৮৮১৭/
-৮৮৫৮/দ্রাঘিমাংশ।
অবস্থান: উত্তরে ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর, দক্ষিণে বাংলাদেশের নাটোর
রাজশাহী, পূর্বে জয়পুরহাটবগুড়া জেলা এবং পশ্চিমে ভারতের  পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও বাংলাদেশের চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলা।

 

এর আয়তন ৩,৪৩৫.৬৭ বর্গকিলোমিটার (১,৩২৬.৫২ বর্গমাইল) । এই জেলার ১১টি উপজেলা নয়টি। এই উপজেলাগুলো হলো পত্নীতলা, ধামইরহাট, মহাদেবপুর, পোরশা, সাপাহার, বদলগাছী, মান্দা, নিয়ামতপুর, আত্রাই, রাণীনগর ও নওগাঁ সদর। এই জেলার ইউনিয়ন ৯৯টি, পৌরসভা ৩টি এবং গ্রাম ২৮৫৪টি।

২০০১ খ্রিষ্টাব্দের আদম শুমারী অনুযায়ী  ২৩,৮৫,৯০০ জন ( পুরুষ-১২,৩০,০০০ জন এবং মহিলা-১১,৫৫,৯০০জন)।

নদ-নদী : ছোট যমুনা, আত্রাই,
পুনর্ভবা

 

ভূপ্রকৃতি : সমগ্র নওগাঁ জেলার ভূপ্রকতিকে তিনট ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই ভাগ তিনটি হলো

জলবায়ু:
তুলনামূলকভাবে এই জেলায় কম হয়। জেলার নীতপুর, সাপাহারে বৃষ্টি হয় সবচেয়ে কম এবং রাণীনগর, আত্রাই,নওগাঁয় সবচেয়ে বেশি। ফলে বরিন্দ অঞ্চলে অনাবৃষ্টি প্রধান সমস্যা, আর ভর অঞ্চলে প্রধান সমস্যা বন্যা। ভূমির গঠন ও বৃষ্টিপাতের তারতম্য অনুসারে খরা মৌসুমে নওগাঁ জেলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মাটি যেমন রূক্ষ হয়, আবার শীতের সময় তীব্র শীত অনুভূত হয়। গ্রীষ্মের সময় এই অঞ্চলের বাতাস বেশ উষ্ণ হয়ে উঠে। বিল বা ভর অঞ্চলের মাটি প্রায় সারা বছরই স্যাঁতসেতে এবং সেই কারণে কিছুটা অস্বাস্থ্যকরও বটে।

শীত ও গ্রীষ্মে এই জেলার তাপমাত্রায় যথেষ্ট হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে। সাধারণভাবে নওগাঁর আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। এই জেলায় ঝড়ের তাণ্ডব খুব বেশি পরিলক্ষিত হয় না। শীতকালে ঘন কুয়াশা পড়ে এবং চৈত্র বৈশাখে ধূলি ঝড়ি হয়।

 

মুক্তিযুদ্ধে নওগাঁ
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই মার্চ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান -এর ঐতিহাসিক ভাষণের পরপরই নওগাঁয় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গড়ে ওঠে। এই সময় নওগাঁ কে,ডি,সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের কার্যালয় স্থাপিত হয়। সে সময় নওগাঁ ছিল ইপিআর ৭নং উইং এর হেড কোয়ার্টার।

১৮ই মার্চ পর্যন্ত এর কমান্ডিং অফিসার ছিল পাঞ্জাবি মেজর আকরাম বেগ। এই সেনাদলে ২জন ক্যাপ্টেনের একজন নাভেদ আফজাল ছিলেন পাঞ্জাবি, অন্যজন ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন ছিলেন বাঙালি।

 

২৩শে মার্চ নওগাঁয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর অধ্যাপক খন্দকার মকবুল হোসেন রচিত ‘রক্ত শপথ’ নামে একটি নটক মঞ্চস্থ হয়। এ নাটকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ভবিষ্যৎ রূপরেখা সম্পর্কে আভাস দেয়া হয়েছিল। নাটকটি প্রযোজনা করেছিলেন মো: আব্দুল জলিল, নির্দেশনায় ছিলেন মমিন-উল-হক ভুটি। মঞ্চস্থ হয় নওগাঁ বি.এম.সি. কলেজ প্রাঙ্গনে। পরবর্তীকালে এ নাটকটি ভারতের বালুরঘাট, মালদহ ও শিলিগুড়ির বিভিন্ন স্থানে মঞ্চস্থ হয়। ভারতের মাটিতে এটি যৌথভাব মঞ্চস্থ করে বাংলাদেশের শরণার্থী শিল্পী-সাহিত্যিক গোষ্ঠী ও বাংলাদেশ শিল্পী-সাহিত্যিক সংঘ।

 

২৫শে মার্চের আগেই মেজর আকরাম বেগের জায়গায় বাঙালি মেজর নজমুল হক নওগাঁয় ইপিআর এর কমান্ডিং অফিসার হিসেবে বদলি হয়ে আসেন। এই সময় মেজর বেগ তাঁকে বাঙালি অফসারের কাছে চার্জ বুঝিয়ে দিতে গড়িমসি করেন। এরপর মেজর নজমুল হক তৎকালীন আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা মো: আব্দুল জলিলের সাথে পরামর্শে বাঙালি ইপিআরদের সহায়তায় ২৪শে মার্চ মেজর আকরাম বেগ ও ক্যাপ্টেন নাভেদ আফজালকে গ্রেফতার করেন। এর পাশাপাশি তিনি নওগাঁ মহকুমা অবাঙালি প্রশাসক নিসারুল হামিদকেও গ্রেফতার করেন। ফলে ২৪শে মার্চে নওগাঁ বাংলাদেশের মুক্ত এলাকায় পরিণত হয়। উল্লেখ্য সে সময় নওগাঁ ছিল রাজশাহী জেলার একটি মহকুমা।


মুক্ত নওগাঁ-এ সে সময় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ নওগাঁর প্রশাসনিক দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি। এই দায়িত্ব গ্রহণকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আওয়ামী লীগের বয়তুল্লাহ এম এন এ (ইনি বাংলাদেশর প্রথম ডেপুটি স্পিকার ছিলেন, ৯ মার্চ ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।), মো: আব্দুল জলিল, মোজাফফর ন্যাপের এম, এ, রকীব, ভাষানী ন্যাপের মযহারুল হক এ্যাডভোকেট, এ,কে,এম, মোরশেদ এবং আরও কয়েক জন স্থানীয় নেতা।

২৫শে মার্চ রাজধানী ঢাকা সহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা শুরু হলেও নওগাঁ এর বাইরে ছিল। ২৬শে মার্চে নওগাঁর সকল থানায় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ পাকবাহিনীর গণহত্যার খবর পৌঁছে দেয়। সেই দিনই নওগাঁ সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার শপথ নেয়। ২৬শে মার্চের পর থেকে সান্তাহারে বিহারি ও বাঙ্গালীদের ভিতর রায়ট হয়। এই সময় বহু বিহারি নিহত।

২০শে এপ্রিল  নওগাঁ দখলের জন্য নাটোর থেকে রওনা হয়ে পাকহানাদার বাহিনী অগ্রসর হয়। এরা বিহারিদের সহায়তায় সান্তাহার দখল করে এবং নিহত বিহারীদের স্মরণে সান্তাহার নাম পরিবর্তন করে ‘শহীদ নগর’ নামকরণ করে।

২১শে এপ্রিল সকালের দিকে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নওগাঁর দিকে অগ্রসর হলে, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ নওগাঁ ত্যাগ করে। এ সময় ভারতের সীমান্ত এলাকায় অবস্থান নেয়। ফলে ২১শে এপ্রিল দুপুর ১২টায় বিনা বাধায় হানাদার বহিনী নওগাঁয় প্রবেশ করে এর নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করে।

২২শে এপ্রিল পাকবাহিনীর অপর একটি কনভয় ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত অবস্থায় রাজশাহী থেকে সড়ক পথে নওগাঁয় প্রবেশ করে। এবং তাদের নির্দেশমতো ঐ দিন রাতে পাকিস্থান রক্ষার লক্ষ্যে স্থানীয় জামায়াত ইসলামের নেতা ও মুসলিম লীগ নেতাদের সমন্বয়ে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়।

২৪শে এপ্রিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বালুরঘাট, বাঙালিপুর, টিয়রপাড়া ও মধুপুরে ক্যাম্প স্থাপন করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের প্রস্তুতি চালু হয়। জুন মাসের দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য মালদা জেলার গৌড়বাগানে পাঠানো হয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা পর্যায়ক্রমে মুক্তিযোদ্ধাদের শিলিগুড়ি ও পানিঘাটায় আর্মস প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়। উল্লেখ্য ১১টি সামরিক সেক্টরে ভিতরে নওগাঁ ছিল ৭নং সেক্টরের অধীনে। মেজর নূরুজ্জামান ছিলেন এ সেক্টরের অধিনায়ক। তাঁর অধীনে ছিলেন মেজর নজমুল হক, ক্যাপ্টেন গিয়াস সহ আরও অনেকে।

মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মোকলসুর রহমান রাজার নেতৃত্ব মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় দল নওগাঁয় প্রবেশ করে। ১৯শে মে ধামইরহাট থানায় এরা প্রথম আক্রমণ চালায়। এরপর জুন মাসের প্রথম দিকে ধামইরহাট থানায় আবার আক্রমণ চালায়। এই দুটি যুদ্ধে ১জন পাক অফিসার সহ তাদের বেশ কয়েক জন নিহত হয়। এই সমব ১জন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন এবং ২জন আহত হন। শেষের অভিযানে মুক্তিযোদ্ধারা ১টি জিপ সহ প্রচুর সামরিক সরঞ্জাম হস্তগত করেন।

১৩ই জুন নওগাঁর মুক্তিযোদ্ধারা চকের ব্রিজ, আত্রাই থানার সাহাগোলা রেল ব্রিজ ও বগুড়া জেলার আদমদিঘী রেল ব্রিজ ডিনামাইড দিয়ে উড়িয়ে দেয়। ফলে পাকহানাদার বাহিনীর রেল চলাচলে অনেক অসুবিধার সৃষ্টি হয়। এছাড়া পত্নীতলা থানায় ক্যাম্প স্থাপনের উদ্দেশ্যে যাত্রাকারী একদল পাকসৈনিকের উপর নওগাঁর মুক্তিযোদ্ধারা হামলা চলিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র অধিকার করে। এ হামলায় নেতৃত্ব দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর নাজমুল। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধের জন্য, পাক-সৈন্যরা নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা ও নির্যাতন চালায়।

১০ই জুলাই মধইল নামক স্থানে মকাই চৌধুরীর নেতৃত্ব পাক বাহিনীর উপর হামলা চলিয়ে মুক্তি যোদ্ধারা ৬জনকে হত্যা করে।

১৬ই জুলাই পাক বাহিনীর নদী পথে রানীনগর থানার তিলাবুদু গ্রামে প্রবেশের চেষ্টা করে। এই সময় ওহিদুর রহমান ও আলমগীর কবিরের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী এদের উপর আক্রমণ চালিয়ে ২টি নৌকা ডুবে যায়। এই সময় ৪জন পাকসৈনিকের মৃত্যু হয়।

১৪ই আগষ্ট পাকিস্থানের স্বাধীনতা দিবসে মহাদেবপুর থানার হাপানিয়া মহাসড়কে মুক্তিবাহিনীর পেতে রাখা একটি শক্তিশালী বোমার আঘাতে ১টি জিপ ধ্বংস হলে ৫ হানাদার সৈন্য নিহত হয়। এর প্রতিশোধ নিতে ১৫ আগষ্ট পাক বাহিনী আশেপাশের গ্রামে গণহত্যা চালায়।

১৯শে সেপ্টেম্বর আত্রাই থানার বান্দাইখাড়া গ্রামে পাক বাহিনী ১৯টি নৌকযোগে হামলা চালায়। এই সংবাদ পেয়ে ওহিদুর রহমান ও আলমগীর কবিরের নেতৃত্বে মুক্তি বাহিনী তারানগর ঘাউল্যা নামক স্থানে পাক বাহিনীর নৌকাতে হামলা চালায়। প্রচণ্ড যুদ্ধে পাক বাহিনীর ৯টি নৌকাই ডুবে যায় এবং এই সাথে অসংখ্য রাজাকার ও পাকসেনার সলিল সমাধি হয়।

 

দর্শনীয় স্থান


সূত্র :
http://www.rajshahi.gov.bd