নাটোর
বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী বিভাগের একটি জেলা। উত্তরে বগুড়া নওগাঁ জেলা, পূর্বে সিরাজগঞ্জ পাবনা জেলা, দক্ষিণে পাবনা ও কুষ্টিয়া জেলা, পশ্চিমে রাজশাহী জেলা। নাটোর শহর নারদ নদের তীরে অবস্থিত।

স্থানাঙ্ক : ২৪.২৬ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশেএবং ৮৯.৯ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশ।

এর আয়তন ১৮৯৬.০৫ বর্গকিলোমিটার। ২০১০ সালের অনুমিত জনসংখ্যা ১৭৩৪১১১ জন। এই জেলার ৬টি উপজেলা নয়টি। এই উপজেলাগুলো হলো নাটোর সদর, সিংড়া, গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, লালপুর ও বাগাতিপাড়া। থানা মোট ৭টি। থানগুলো হলো নাটোর সদর, সিংড়া, গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, লালপুর, বাগাতিপাড়া ও নলডাঙ্গা। পৌরসভা ৮টি। এগুলো হলো নাটোর (ক-শ্রেণী), সিংড়া (ক-শ্রেণী), গুরুদাসপুর (ক-শ্রেণী), বড়াইগ্রাম (খ-শ্রেণী), বনপাড়া (গ-শ্রেণী), গোপালপুর (গ-শ্রেণী), বাগাতিপাড়া (গ-শ্রেণী), নলডাঙ্গা (গ-শ্রেণী)। এই জেলার ৫২টি ইউনিয়ন রয়েছে। গ্রাম ১৪৩৪টি।

নদনদী: নন্দকুঁজা, বারনই, গোধাই, বড়াল, গুনাই, নাগর নদ, নারদ নদ।
বিল :
এই জেলার সিংড়া উপজেলায় রয়েছে চলনবিলের একটি অংশ

ভূপ্রকৃতি:
এ জেলা পলল ভূমি ভূপ্রাকৃতিক অঞ্চলের অন্তর্গত পাললিক ভুমি। অধিকাংশ মাটির ধরণ হচ্ছে দোআঁশ-এঁটেল দোআঁশ এবং এতে অল্প পরিমাণে জৈব পদার্থ বিদ্যমান ।


দর্শনীয় স্থান:
দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী (উত্তরা গণভবন), নাটোর রাজবাড়ী, চৌগ্রাম জমিদার বাড়ী।

ইতিহাস:
নাটোর মোগল শাসনামলের শেষ সময় থেকে বাংলার ক্ষমতার অন্যতম প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। বিশেষ করে নবাবী আমলে তার ব্যাপক ব্যাপ্তি ঘটে । বাংলার সুবেদার মুর্শিদ কুলী খানের (১৭০১-১৭২৭ শাসনকাল) প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বরেন্দ্রী বাহ্মণ রঘুনন্দন তার ছোটভাই রামজীবনের নামে এতদ্অঞ্চলে জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেন । রাজা রামজীবন রায় নাটোর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। কথিতআছে লস্কর খাঁতার সৈন্য-সামন্তদের জন্য যে স্থান হতে রসদ সংগ্রহ করতেন, কালক্রমে তার নাম হয় লস্করপুর পরগনা।এই পরগনার একটি নিচু জলাভূমির নাম ছিল ছাইভাংগাবিল।

১৭১০ খ্রিষ্টাব্দে রাজা রামজীবন রায় এই স্থানে মাটিভরাট করে তার রাজধানী স্থাপন করেন। কালক্রমে মন্দির, প্রাসাদ, দীঘি, উদ্যান ও মনোরম অট্টালিকা দ্বারা সুসজ্জিত নগরীতে পরিণত হয়। ধীরে ধীরে ছাইভাংগাবিলের উপরে প্রতিষ্ঠিত হয় নাটোর শহর। সুবেদার মুর্শিদ কুলী খানের সুপারিশে মোঘল সম্রাট আলমগীরের নিকট হতে রামজীবন ২২ খানা খেলাত এবং রাজা বাহদুর উপাধী লাভ করেন । নাটোর রাজ্য উন্নতির চরম শিখরে পৌছে রাজা রামজীবনের দত্তক পুত্র রামকান্তের স্ত্রী রাণী ভবানীর রাজত্বকালে।

১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে ক্যাপ্টেন রেনেল এর ম্যাপ অনুযায়ী রাণী ভবানীর জমিদারীর পরিমাণ ছিল ১২৯৯৯ বর্গমাইল । শাসন ব্যবস্থার সুবিধার জন্য সুবেদার মুর্শিদ কুলী খান বাংলাকে ১৩টি চাকলায় বিভক্ত করেন । এর মধ্যে রাণী ভবানীর জমিদারী ছিল ৮ চাকলা বিস্তৃত। এই বিশাল জমিদারীর বাৎসরিক আয় ছিল দেড় কোটি টাকার অধিক । বর্তমান বাংলাদেশের
রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, যশোর এবং পশ্চিমবঙ্গের মালদা, মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম জেলাব্যাপী বিস্তৃত ছিল তার রাজত্ব । এছাড়া ময়মনসিংহ জেলার পুখুরিয়া পরগণা এবং ঢাকা জেলার রাণীবাড়ী অঞ্চলটিও তার জমিদারীর অন্তর্গত ছিল । এ বিশাল জমিদারীর অধিশ্বরী হওয়ার জন্যই বোধহয় তাকে মহারাণী উপাধী দেয়া হয় এবং তাকে অর্ধ-বঙ্গেশ্বরী হিসাবে অভিহিত করা হতো ।

রাণী ভবানীর শাসনামল পর্যন্ত নাটোর শহরের দক্ষিণ পাশ দিয়ে প্রবাহিত হতো স্রোতস্বিনী নারদ নদ। পরবর্তীকালে নদের গতিমুখ বন্ধ হয়ে গেলে সমগ্র শহর এক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে নিপতিত হয়। এই শহরে পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থার একমাত্র সংযোগস্থল ছিল নারদ নদ। কালক্রমে এই নদ অচল হয়ে পড়লে শহরের পরিবেশ ক্রমাগত দূষিত হয়ে পড়ে । ইংরেজ শাসকরা সেজন্য জেলাসদর নাটোর থেকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে । প্রিংগল ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে এপ্রিল জেলাসদর হিসাবে পদ্মানদীর তীরবর্তী রামপুর-বোয়ালিয়ার নাম উল্লেখ করে প্রস্তাবনা পেশ করেন। ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে নাটোর থেকে জেলা সদর রামপুর-বোয়ালিয়াতে স্থানান্তরিত হয়। জেলা সদর স্থানান্তরের পর ইংরেজ সরকার মহকুমা প্রশাসনের পরিকাঠামো তৈরি করে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী নাটোরকে রাজশাহী জেলারা মহকুমা করা হয়। উল্লেখ্য সেন বংশের রাজা বিজয় সেন-এর সময়, তাঁর রাজ্যের রাজধানী বর্তমান রাজশাহী শহর থেকে মাত্র ৯ কিমি দূরে অবস্থিত ছিল। মধ্যযুগে বর্তমান রাজশাহী পরিচিত ছিল রামপুর-বোয়ালিয়া নামে । এর সূত্র ধরে এখনও রাজশাহী শহরের একটি থানার নাম বোয়ালিয়া।

১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর বঙ্গের বিশাল অংশ নিয়ে গঠিত হয়েছিল একটি বিভাগ তৈরি করা হয়।  সে সময় এই বিভাগের সদর দফতর ছিল মুর্শিদাবাদ। ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহী জেলা গঠন করা হয় এবং সেই সূত্রে রাজশাহী ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিণত হয়। তখন মুর্শিদাবাদ বিভাগ গঠিত হয়েছিল ৮টি জেলা নিয়ে। এই জেলাগুলো ছিল মুর্শিদাবাদ, মালদাহ, জলপাইগুড়ি, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনা ও রাজশাহী। এই

১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ সরকারের এক ঘোষণাবলে রাণী ভবানীর দত্তকপুত্র রামকৃষ্ণ এর হাত থেকে কোম্পানী পুলিশ ও জেলখানা নিজ হাতে তুলে নেয়। এই সময় কোম্পানী নিজহাতে জেলখানার দায়িত্ব নিয়ে প্রতি জেলায় জেলখানা স্থাপন করে। ইংরেজদের কর্তৃক পরিচালিত প্রথম জেলখানা নাটোরে প্রতিষ্ঠিত হয় ।

 ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে নাটোর পুনরায় জেলাসদরের মর্যাদা লাভ করে ।


সূত্র :
http://www.natore.gov.bd/node/97008