অল ইন্ডিয়া রেডিও/আকাশবাণী
ভারতের জাতীয় বেতার সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান।

১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুলাই, ব্রিটিশ ভারতে বোম্বাই প্রেসিডেন্সি রেডিও ক্লাব এবং অন্যান্য রেডিও ক্লাবের সমন্বয়ে প্রথম ভারতে বেতার সম্প্রচার শুরু হয়।

প্রথম বেতারকেন্দ্র, বোম্বাই
১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে জুলাই (শুক্রবার, ৭ শ্রাবণ ১৩৩৩), ব্যক্তিগত পর্যায়ে বেতার সম্প্রচারের চুক্তি হয়। এই চুক্তি বলে
Indian Broadcasting Company LTD (IBC) দুটি সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারের অধিকার লাভ করে। এই চুক্তির পর, বোম্বাই বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচার শুরু হয় ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে জুলাই (শুক্রবার, ৭ শ্রাবণ ১৩৩৩। এই বেতারকেন্দ্রটি উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন ভরতের ভাইসরয় লর্ড আরউইন।  মিডিয়াম ওয়েভ ১.৫ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রান্সমিটার।

দ্বিতীয় বেতারকেন্দ্র, কলকাতা
১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে আগষ্ট (বৃহস্পতিবার, ৯ ভাদ্র ১৩৩৩), কলকাতা বেতারকেন্দ্র চালু হয়। এই বেতারকেন্দ্রটি স্থাপিত হয়েছিল ১ নম্বর গারস্টিন প্লেসে। দেড় কিলোওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন একটি মিডিয়াম ওয়েভ ট্রান্সমিটার চালু করা হয়েছিল কাশীপুরের ঢালা পার্কের কাছে। এই কেন্দ্র থেকে প্রথম যে বাণী উচ্চারিত হয়েছিল, তা হলো 'ক্যালকাটা কলিং'। এই বেতারকেন্দ্রটি উদ্বোধন করেছিলেন বাংলার গভর্নর স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন।

নলিনীকান্ত সরকারে স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়- কলকাতা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার আগে হাইকোর্টের কাছে টেম্পল চেম্বার্সে এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্সে কলেজে বেতার কেন্দ্র ছিল। কলকাতা বিশ্বিদ্যালয়ের এই বেতারকেন্দ্রটি স্থাপন করেছিলেন- পদার্থবিজ্ঞানে অধ্যাপক ডক্টর শিশিরকুমার মিত্র। এই বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতি সপ্তাহে পাঁচদিন গান-বাজনা বক্তৃতা প্রচারিত হতো।

এই সময় কখন বেতার সম্প্রচার শুরু হতো, তা জানা যায় না। তবে ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বেতার সম্প্রচার শুরু হতো সকাল ৮টায়। সে সময় বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান হিসেবে রেকর্ডে  ভারতীয় ও পাশ্চাত্য গান বাজানো হতো। এর ভিতরে কণ্ঠসঙ্গীত ও যন্ত্রসঙ্গীত উভয়ই ছিল।

কলকাতা বেতার কেন্দ্রের প্রথম পরিচালক ছিলেন বিবিসি থেকে আগত সি সি ওয়ালিক
(C.C. Wallick) । ভারতীয় প্রোগ্রামের প্রযোজক ছিলেন নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার। নানা ধরনের সমস্যার কারণে এই প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যায়। ফলে ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১লা মার্চ (শনিবার ১৭ ফাল্গুন ১৩৩৬) থেকে আইবিসি'র সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়।। এই সময় সকল কর্মচারীচাকরি হারিয়ে অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে। এই অবস্থায় তৎকালীন ভারত সরকার বেতার সম্প্রচারের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই সময় এই সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানের নাম হয়- Indian State Broadcasting Service (ISBS) । নতুন প্রতিষ্ঠানে পুরানো কর্মচারীরা চাকরি পায়। তবে নতুন করে কর্ম বিন্যাস করা হয়।

এই প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষামূলক বেতার সম্প্রচার শুরু হয় ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১লা এপ্রিল (মঙ্গলবার, ১৮ চৈত্র ১৩৩৬) থেকে। এই সময়ে বেতার নাটক প্রচারিত হতো প্রায় নিয়মিত। এসকল নাটকে অহীন্দ্র চৌধুরী, জহর গাঙ্গুলী, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সরযূবালা, শম্ভু মিত্র, বসন্ত চৌধুরী, ছবি বিশ্বাস, মঞ্জু দে ও বিকাশ রায়ের মত অভিনেতারা অভিনয় করতেন। এ্ছাড়া ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে শুরু হয়েছিল অল্প-বিস্তর ফুটবল খেলার ধারাবিবরণী।

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র পঙ্কজ কুমার মল্লিককে নিয়ে বাণীকুমার রচিত বিখ্যাত ‘মহিষাসুর-মর্দিনী’ অনুষ্ঠানটি শুরু করেছিলেন এবং বহুদিন এই অনুষ্ঠান জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল।

দুই বছর পরীক্ষামূলক স্তর পার করে এসে, ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে এই সম্প্রচার ব্যবস্থা স্থায়ী সাংগঠনিক রূপ করে।  ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা সংবাদ পরিবেশন শুরু হয়। সে সময়ে রাজেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন স্থানীয় সংবাদের দায়িত্বে। কিছুদিন পরে সংবাদ বিভাগে যেওগদান করেন বিজন বসু, বিভূতি দাস প্রমুখ।

উল্লেখ্য, ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারত সরকার, ভারতে বেতার সম্প্রচার উন্নয়নের জন্য ৪০ লাখ রুপি বরাদ্দ করে। ভারতে বেতার সম্প্রচারের কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করার জন্য, বেতার নিয়ন্ত্রক কমিটি বিবিসির পরামর্শ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সূত্রে ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রকাস্টিং নিয়ন্ত্রক এবং বিবিসির বেতার গবেষণার প্রধান এইচ.এল. কির্কে ভারত ভ্রমণে করেন। এই ভ্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বেতার সম্প্রচারের জন্য স্থান নির্ধারণ করা। গুটি কয়েক বেতারকেন্দ্রের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক মানুষকে বেতার সম্প্রচারের অধীনে আনা যায়, এই লক্ষ্য সামনে রেখে এঁরা জনবহুল এলাকাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যকে কারক্রকরীর করার লক্ষ্যে পুরানো বেতারকেন্দ্রগুলোর উন্নয়ন করা হয়।

তৃতীয় বেতারকেন্দ্র, দিল্লী ক
১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১লা জানুয়ারি ২০ কিলোওয়াট মিডিয়াম তরঙ্গে নিয়মিত বেতার সম্প্রচার শুরু হয় দিল্লী থেকে।

১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা জুন (বৃহস্পতিবার ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৩) এই সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় All India Radio। আর ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে এই প্রতিষ্ঠানের ভারতীয় নামকরণ হয় 'আকাশবাণী'

চতুর্থ বেতারকেন্দ্র, পেশোয়ার
১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ১লা এপ্রিল, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সরকার পেশোয়ারে বেতারকেন্দ্র স্থাপন করে। এটি ছিল  ১.২৫ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ। পঞ্চম বেতারকেন্দ্র, লাহোর
১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর, পাঞ্জাব প্রদেশের সরকার লাহোরে বেতারকেন্দ্র স্থাপন করে। এটি ছিল  ৫ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ। এই বেতারকেন্দ্রের উদ্বোধন করেছিলেন পাঞ্জাবের গভর্নর হারবার্ড এমাসন।

ষষ্ঠ বেতারকেন্দ্র, দিল্লী খ
১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর, দিল্লীতে প্রথম ১০ কিলোওয়াট শর্ট ওয়েভ বেতারকেন্দ্র স্থাপিত হয়।  এই কেন্দ্রের উদ্বোধন করেছিলেন- ভারত সরকারের যোগাযোগ কমিটির সদস্য, থমাস স্টুয়ার্ড।

সপ্তম বেতারকেন্দ্র, বোম্বাই খ
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ৪ ফেব্রুয়ারি, বোম্বাইতে  ১০ কিলোওয়াট শর্ট ওয়েভ বেতারকেন্দ্র স্থাপিত হয়। এই কেন্দ্রের উদ্বোধন করেছিলেন- বোম্বাইয়ের গভর্নর রজার লুমলে। অষ্টম বেতারকেন্দ্র, লক্ষ্ণৌ
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ২ এপ্রিল, লক্ষ্ণৌতে ৫ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ স্থাপিত হয়। এই কেন্দ্রের উদ্বোধন করেছিলেন- উত্তর প্রদেশের গভর্নর হ্যারি হাইগ।

নবম বেতারকেন্দ্র, দিল্লী গ
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১ জুন, দিল্লীতে প্রথম ৫ কিলোওয়াট শর্ট ওয়েভ বেতারকেন্দ্র স্থাপিত হয়।

দশম বেতারকেন্দ্র, মাদ্রাজ-ক
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুন, মাদ্রাজে ১.২৫ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ বেতারকেন্দ্র স্থাপিত হয়।  এই কেন্দ্রের উদ্বোধন করেছিলেন- মাদ্রাজের গভর্নর লর্ড এরস্কিন।

একাদশ বেতারকেন্দ্র, মাদ্রাজ-খ
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুন, মাদ্রাজে ১০ কিলোওয়াট শর্ট ওয়েভ বেতারকেন্দ্র স্থাপিত হয়।  এই কেন্দ্রের উদ্বোধন করেছিলেন- মাদ্রাজের গভর্নর লর্ড এরস্কিন।

দ্বাদশ বেতারকেন্দ্র, কলকাতা -খ
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ আগষ্ট, কলকাতায় ১০ কিলোওয়াট শর্ট ওয়েভ বেতারকেন্দ্র স্থাপিত হয়।  এই কেন্দ্রের উদ্বোধন করেছিলেন- বাংলার গভর্নর রবার্ট রেইড।

ত্রয়োদশ বেতারকেন্দ্র, ত্রিচিনোপল্লী
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মে, ত্রিচিনোপল্লীতে ৫ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ বেতারকেন্দ্র স্থাপিত হয়।  এই কেন্দ্রের উদ্বোধন করেছিলেন- মাদ্রাজের গভর্নর লর্ড এরস্কিন।

১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে দিল্লী থেলে 'এক্সটারনাল সার্ভিস' হিসেবে সম্প্রচার শুরু হয় পোস্তু ভাষার কার্যক্রম।

চতুর্দশ বেতারকেন্দ্র, ঢাকা
১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর (শনিবার ৩০ অগ্রহায়ণ ১৩৪৬) ঢাকাতে  ৫ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ বেতারকেন্দ্র স্থাপিত হয়।  এই কেন্দ্রের উদ্বোধন করেছিলেন- বাংলার গভর্নর লর্ড জন হারবার্ট।
          [দ্রষ্টব্য: বাংলাদেশ বেতার]

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীন ভারতে ১১টি বেতার কেন্দ্র নিয়ে অল ইন্ডিয়া রেডিওর সম্প্রচার শুরু করে। এই কেন্দ্রগুলো ছিল দিল্লি (ক, খ, গ), বোম্বাই (ক, খ), কলকাতা (ক, খ), মাদ্রাজ (ক, খ), লক্ষ্ণৌ এবং ত্রিচিনোপল্লী। এর অধীনস্থ তিনটি বেতার কেন্দ্র পাকিস্তানের অংশে চলে যায়। এই কেন্দ্র তিনটি ছিল লাহোর, পেশোয়ার এবং ঢাকা।

১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা অক্টোবর থেকে শুরু হয় বিভিধ ভারতী কার্যক্রম কলকাতা -গ থেকে।
১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে অল ইন্ডিয়া রেডিও-এর অধীনে শুরু হয় টেলিভিশন শুরু হয়। এই সম্প্রচারের প্রথম কেন্দ্র ছিল দিল্লি।
১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১লা এপ্রিল, রেডিও ও টেলিভিশনকে পৃথক করা হয়। টেলিভিশনের জন্য সংগঠনের নাম হয় 'দূরদর্শন'।
১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে জুলাই থেকে চেন্নাইতে শুরু হয় এফএম সম্প্রচার।
সূত্র:

  • The Indian Listener 7 December 1939- Vol-IV-No. 24