কালিম্পং
(Kalimpong)
বর্তমানে
ভারতেরপশ্চিমবঙ্গ
রাজ্যের কালিম্পং জেলা ও মহকুমা
সদর শহর। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কালিম্পং-এর উচ্চতা ৪,১০০
ফুট। এর গড় উচ্চতা ১,২৫০ মিটার (৪,১০১ ফুট)। ভৌগোলিক স্থানঙ্ক: ২৭.০৬° উত্তর ৮৮.৪৭° পূর্ব ।
এর মোট আয়তন ১,০৫৬.৫ বর্গকিমি (৪০৭.৯ বর্গমাইল)
এর দাপ্তরিক ভাষা: নেপালি, বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি ।
কালিম্পং-এর সর্বোচ্চ স্থান ডেলোর উচ্চতা ১,৩৭২ মি (৪,৫০১ ফু)। পাহাড়ের নিচের উপত্যকাযর
মধ্য দিয়ে তিস্তা নদী প্রবাহিত হয়েছে। মূলত তিস্তা কালিম্পং-কে সিকিম রাজ্য থেকে পৃথক করেছে। কালিম্পং-এর
অধিকাংশ অঞ্চলের মাটির রং লাল। কোথাও মাটির রং কালচে দেখায়।
অন্যান্য হিমালয়ের পাদদেশীয় পার্বত্য এলাকার মতোই এখানকার ভূমি ঢালু এবং মাটি
বেশ নরম। বর্ষাকালে এখানে প্রায়ই ধস নামে।
কালিম্পং থেকে হিমালয়ের তুষারাবৃত উঁচু উঁচু শৃঙ্গগুলি দেখা যায়।
কালিম্পং-এ পাঁচটি ঋতুর চক্র লক্ষিত হয়। এগুলো হলো- বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত ও বর্ষা।
এখানকার বার্ষিক তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৮৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট) এবং সর্বনিম্ন ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৪৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। আগস্ট মাসে গ্রীষ্মের গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৮৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। গ্রীষ্মের পরে আসে বর্ষা, যা স্থায়ী হয় জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টি হয়।
এই সময় মাঝেমাঝে ধস নেমে শহরটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শীতকাল। তখন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৫৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। বর্ষা ও শীতে কালিম্পং ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকে।
কালিম্পং নামের অর্থ নিয়ে দুটি মত রয়েছ। একটি মত হলো- তিব্বতি
ভাষায় কালোন (রাজার মন্ত্রী) ও পং (বেড়া)।
এই দুটি শব্দের সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছে কালিম্পং।
উভয় শব্দ মিলে এর অর্থ দাঁড়ায়- রাজার মন্ত্রীদের সভা।
অন্য মতে, লেপচা ভাষায় কালিম্পং শব্দটির অর্থ হলো- 'শৈলশিরায় আমরা খেলা করি'।
কথিত আছে দূর অতীতে এই অঞ্চলের
স্থানীয় আদিবাসীদের গ্রীষ্মকালীন ক্রীড়ানুষ্ঠানের
আয়োজন করতো। পাহাড়ের অধিবাসীরা এই অঞ্চলকে কালিবং-ও (কালো নাল) বলে থাকেন।
ষোড়শ শতাব্দীর দিকে কালিম্পং সিকিম রাজ্যের শাসনাধীনে থাকার সময় এই অঞ্চলটি ডালিংকোট নামে পরিচিত ছিল। ১৭০৬
খ্রিষ্টাব্দে সিকিমের রাজাকে পরাজিত করে ভুটান রাজা অঞ্চলটি নিজেদের অধিকারে আনে।
এই সময় এই অঞ্চলের নামকরণ করা হয় কালিম্পং । সে সময়ে এখানকার জনসংখ্যা সেই সময় খুবই কম ছিল।
অধিবাসীদের অধিকাংশই ছিল আদিবাসী লেপচা সম্প্রদায়ের। ভুটানের অধিকারের পর এখানে ভুটিয়া ও লিম্বু
জাতির লোকেরা বসবাস শুরু করে।
১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে, নেপালের গোর্খারা কালিম্পং আক্রমণ জয়। পরে অঞ্চলটি পুনারয়
ভুটানের দখলে চলে যায়। ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজদের সাথে ভুটানের যুদ্ধ হয়। তারপর ১৮৬৫ সালে সিঞ্চুলার চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী তিস্তা নদীর পূর্বদিকের ভুটানি-অধিকৃত অঞ্চলগুলি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আওতাভুক্ত হয়। এই সময় কালিম্পং-এ
মাত্র কয়েকটি পরিবার বসবাস করতো। ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে অ্যাশলে ইডেন নামে এক বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস অফিসারের তাৎক্ষণিক প্রতিবেদনে
কালিম্পং-এর উল্লেখ পাওয়া যায়। এটাই ছিল কালিম্পং শহরের প্রথম ঐতিহাসিক নামোল্লেখ।
ইঙ্গ-ভুটান যুদ্ধের পর, কালিম্পংকে পশ্চিম ডুয়ার্স জেলার মহকুমা করা হয়।
১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে কালিম্পং দার্জিলিং জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮৬৬-৬৭ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ একটি ইঙ্গ-ভুটানি কমিশন কালিম্পং ও ভুটানের সীমা নির্দেশ করার জন্য নিযুক্ত হয়। এরপর কালিম্পং মহকুমা ও দার্জিলিং জেলা একটা ভৌগোলিক আকার পায়।
ব্রিটিশরা গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলের তীব্র দাবদাহ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য,
কালিম্পং-এ দার্জিলিং-এর বিকল্প শৈলশহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়। ক্রমে ক্রমে
কালিম্পং ভারত ও তিব্বতের মধ্যে পশুরোম, উল ও খাদ্যশস্য আমদানি-রফতানির কেন্দ্রস্থলে
পরিণত হয়। বাণিজ্যে সমৃদ্ধ-এলাকায় পরিণত হওয়ার সূত্রে নেপাল থেকে বহু
মানুষ এসে এখানে বসতি স্থাপন করতে থাকে। ফলে এখানকার জনসংখ্যাও বেড়ে যায়।
কালিম্পং-এ রবীন্দ্রনাথের বাড়ি
এখানে স্কটিশ মিশনারিরা এসে এখানে ব্রিটিশদের জন্য স্কুল ও ওয়েলফেয়ার সেন্টার গড়ে তোলেন। রেভারেন্ড ডাবলিউ ম্যাকফারল্যান্স ১৮৭০-র দশকে এই এলাকায় প্রথম স্কুল স্থাপন করেন।
১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে এখানে স্কটিশ ইউনিভার্সিটি মিশন ইনস্টিটিউশন চালু হয়। এর কিছু
পরে স্থাপিত হয় কালিম্পং গার্লস হাই স্কুল। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে রেভারেন্ড জে এ গ্রাহাম দুঃস্থ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ছাত্রদের জন্য ড. গ্রাহাম'স হোমস চালু করেন। ১৯০৭
খ্রিষ্টাব্দের দিকে কালিম্পং-এর অধিকাংশ স্কুলের দরজা ভারতীয় ছাত্রদের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
এসকল কারণে ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ শহরের জনসংখ্যা হয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৭,৮৮০
জন।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাক-ভারত বিভাজনে কালিম্পং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে চীন তিব্বত দখল করে নিলে, তিব্বত থেকে বহু বৌদ্ধ সন্ন্যাসী কালিম্পং-এ
আশ্রয় নেন এবং এখানে মঠ স্থাপনা করেন। ভারত-চীন যুদ্ধের পর জেলেপলা পাস পাকাপাকিভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে ভারত-তিব্বত বাণিজ্য ব্যাহত হয়
এবং কালিম্পং-এর অর্থনীতি ক্ষতির মুখে পড়ে। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে দলাই লামা কালিম্পং-এ এসে জ্যাং ঢোক পালরি ফোডাং মঠটিকে পবিত্র ঘোষণা করেন।
১৯৮৬ ও ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে জাতিগত ভিত্তিতে পৃথক গোর্খাল্যান্ড ও কামতাপুর রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়।
এই সময় গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (জিএনএলএফ) ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিবাদে জড়িয়ে পড়ে।
এই সময় দাঙ্গা শুরু হলে চল্লিশ দিনের বনধ ঘোষিত হয়। কালিম্পং বিদ্রোহীদের দখলে চলে যায়।
এই সময় আইনশৃঙ্খলা বাজায় রাখার জন্য রাজ্য সরকার সেনাবাহিনীকে তলব করে। এরপর শিলিগুড়ি মহকুমা ছাড়া বাকি দার্জিলিং জেলা নিয়ে স্বশাসিত সংস্থা দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল গঠিত হয়। ২০০৭
খ্রিষ্টাব্দে পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবি নতুন করে মাথাচাড়া দেয়। এবার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা (গজম)।
এখন পর্যন্ত পৃথক গোরখাল্যান্ড রাজ্য স্বীকৃতি পায় নাই।
বর্তমানে এই
জেলার অধিকাংশ অঞ্চল সংরক্ষিত বনভূমি হিসাবে ঘোষিত হয়েছে।
এখানকার বনভূমির প্রধান গাছগুলো হলো- পাইন, শাল, জারুল।
অর্থকরী ফসলগুলো হলো- ভুট্টা, চা, কমলালেবু, বড় এলাচ।
এছাড়া মংপু ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে সংরক্ষিত বাগান রায়েছে। এই মহকুমার
প্রধান প্রধান নদীগুলো হলো- লিশ, গিশ ও চেল-তিন।