শান্তিনিকেতন
ভারতের
পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের বীরভূম জেলার অন্তর্গত বোলপুর শহরের নিকটে অবস্থিত একটি আশ্রম ও শিক্ষাকেন্দ্র।
ভৌগোলিক অবস্থান : ২৩.৬৮
° উত্তর দ্রাঘিমাংশ ৮৭.৬৮° পূর্ব অংক্ষাংশ।

১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রায়পুরের জমিদার বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করার জন্য যাচ্ছিলেন। পথে ভুবনডাঙা নামক গ্রামের কাছে একটি দিগন্তপ্রসারিত মাঠের ভিতর দুটি মাত্র ছাতিম গাছ দেখতে পান। সেই ধূসর প্রান্তরের ভিতর এই ছাতিম গাছ দুটি দেখে তিনি এক ধরনের আত্মিক আকর্ষণ অনুভব করেন। এরপর এখানে থেমে ছাতিম গাছের ছায়ায় তিনি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন। এই স্থানের আকর্ষণ থেকেই তিনি  ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ১ মার্চ তারিখে [রবিবার ১৮ ফাল্গুন, ১২৬৯ বঙ্গাব্দ] রায়পুরের জমিদার প্রতাপ নারায়ণ সিংহের কাছ থেকে ভুবনডাঙা গ্রামের বাঁধ সংলগ্ন এই ছাতিমতলাসহ বিশ বিঘা জমি বার্ষিক পাঁচ টাকা খাজনায় মৌরসী-স্বত্ব গ্রহণ করেন। পরে এখানে একটি আশ্রম গড়ে তুলেন। এই স্থানে খুব ডাকাতের ভয় ছিল। এই সময় এই স্থানের ডাকাত-সর্দারের নাম ছিল দ্বারী সর্দার। দেবেন্দ্রনাথ এই ডাকাত-সর্দারকে এই স্থানের রক্ষাকর্তা হিসাবে নিয়োগ দেন। এর ফলে ক্রমে ক্রমে এই স্থানে ডাকাতি কমে যায়।  ১৮৮৮ সালের ৮ই মার্চ দেবেন্দ্রনাথ ট্রাস্টি চুক্তির মাধ্যমে শান্তিনিকেতনকে সবার জন্য উন্মুক্ত করেন।

ছাতিমতলা

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে এখানে একটি  দালান বাড়ি।  প্রথমে এটি ছিল একতলা, পরে দোতলা করা হয়। বাড়ির উপরিভাগে খোদাই করা আছে সত্যাত্ম প্রাণারামং মন আনন্দং মহর্ষির প্রিয়, উপনিষদের এই উক্তিটি। তিনি নিজে বাড়ির একতলায় ধ্যানে বসতেন। তাঁর অনুগামীরাও এখানে এসে থেকেছেন। কৈশোরে বাবার সঙ্গে হিমালয়ে যাওয়ার পথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে কিছুদিন বাস করেন। ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় স্থাপনের সময়ও রবীন্দ্রনাথ কিছুকাল সপরিবারে এই বাড়িতে বাস করেন। পরে আর কখনও তিনি এটিকে বসতবাড়ি হিসেবে ব্যবহার করেন নি। এখন বাড়িটির সামনে রামকিঙ্কর বেইজ নির্মিত একটি বিমূর্ত ভাস্কর্য রয়েছে। শান্তিনিকেতন ভবনের অদূরে একটি টিলার আকারের মাটির ঢিবি আছে। মহর্ষি এখান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখতেন। একসময় এই টিলার নিচে একটি পুকুরও ছিল। ১৮৯২ বঙ্গাব্দে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রাহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ এখানে বিদ্যালয় (ব্রহ্মাশ্রম) স্থাপন করেন। এর অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই বিদ্যালয়ের প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে ছিলেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় আর ছাত্র হিসেবে ছিলেন গৌরগোবিন্দ গুপ্ত, প্রেমকুমার গুপ্ত, অশোককুমার গুপ্ত, সুধীরচন্দ্র, গিরিন ভট্টাচার্য, যোগানন্দ মিত্র, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরবর্তীকালে এই বিদ্যালয়টি বিশ্বভারতী বিশ্বদ্যালয়ে পরিণত হয়।

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে আশ্রমসীমার বাইরে, মন্দিরের উত্তর অবস্থিত একটি পোড়ো জমিতে রবীন্দ্রনাথ একটি বাড়ি তৈরি করেন। খড়ের চাল এবং মাটির বেড়া দিয়ে তৈরি এই বাড়ির মেঝে ছিল কাঁকর পেটানো শক্ত মাটির। অবশ্য স্নানের ঘরটির মেঝে পাকা ছিল। এই বাড়িটিকে তিনি নাম দিয়েছিলেন 'উত্তরায়ণ'। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৪-১৫ নভেম্বর নাগাদ এই বাড়িতে তাঁর গৃহপ্রবেশ ঘটে। পরে উত্তরায়ণ ভেঙে পাকা বাড়িতে পরিণত করা হয়। এই সময় এই বাড়ির নামকরণ করা হয় 'কোণার্ক'। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে কোণার্ক পাকা করা হয়। এছাড়া উত্তরায়ণ নামক বাড়ির এলাকায় আরও চারটি বাড়ি পরে তৈরি করা হয়। এই বাড়িগুলোর নাম হলো উদয়ন, শ্যামলী, পুনশ্চ এবং উদিচী। উদয়ন এলাকার পশ্চিমে একটি সরোবর ও উদ্যান আছে। এর নাম 'পম্পা'। এই উদ্যানের ভিতরে ছিল প্রতিমা দেবীর ছবি আঁকার চিত্রভানু নামক 'স্টুডিও'। এই স্টুডিওর উপরের তলায় রয়েছে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'গুহাঘর' নামক কারখানা।  কোণার্কের পাশে ইংরেজি এল বর্ণের আকারে অনেকগুলো বাড়ি তৈরি করা হয়েছিল। এই বাড়িগুলো 'রান্নাবাড়ি' নামে পরিচিত ছিল। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে ইউরোপ থেকে ফিরে এই বাড়িগুলোর একটিতে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রতিমা দেবী কিছুদিন বসবাস করেন। রবীন্দ্রনাথ-এর কন্যা মীরা দেবীও পুত্রকন্যা-সহ এই বাড়িতে কিছুদিন বসবাস করেছিলেন। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের শতবার্ষিকীর সময় রবীন্দ্রচর্চার কেন্দ্র হিসেবে 'বিচিত্রা' নামে একটি বাড়ি তৈরি করা হয়। পরে এই বাড়িটির বিস্তার ঘটিয়ে 'মাল্টিমিডিয়া' নামক বৈদ্যুতিন কর্মশালা গড়ে তোলা হয়েছে।

শ্যামলী

পুরানো উত্তরায়ণের পাশে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রতিমা দেবীর বসবাসের জন্য একটি মাটির বাড়ি তৈরি করা হয়েছিল। এই বাড়িটির নামকরণ করা হয়েছিল 'মৃন্ময়ী'। এখন আর সে বাড়ি নেই। যতটুকু জানা যায়, দীর্ঘকাল পরে পিয়ার্সন শান্তিনিকেতনে ফিরে এলে তিনি এই বাড়িতে উঠেছিলেন। ১৩৩০ বঙ্গাব্দে পশ্চিম ভারত ঘুরে এসে এই বাড়িতে উঠেছিলেন। এখানে ১৩৩০ বঙ্গাব্দের ২ পৌষ-এ 'আমার শেষ রাগিণীর প্রথম ধুয়ো [প্রেম-২৬] [তথ্য]' গানটি রচনা করেছিলেন১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ-এর একান্ত সচিব অনিলকুমার চন্দ বিবাহের পর এই বাড়িতে সস্ত্রীক বসবাস করা শুরু করেন। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে এই বাড়িটি ভেঙে ফেলা হয়। এই সময় এই জায়গায় রবীন্দ্রনাথ তৈরি করেন 'শ্যামলী' নামক বাড়ি। এই বাড়ি তৈরির পিছনে রবীন্দ্রনাথের একটি বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে কলাভবনের শিল্পীরা 'চৈতি' নামক একটি  চৈত্য নির্মাণ করেছিলেন। এই চৈত্যটি তৈরি করা হয়েছিল মাটি আলকাতরা খড় ইত্যাদি মিশিয়ে। এটি তৈরি করা হয়েছিল অস্থায়ীভাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, ঝড়-বৃষ্টিতে এটা ধ্বসে পড়লো না। রবীন্দ্রনাথ সে সময়ে ভাবলেন, এইরকম বাড়ি যদি গরিব মানুষদের জন্য তৈরি করা যায়, তা হলে, প্রতি বৎসর তারা ঘর মেরামতের বিড়ম্বনা থেকে রক্ষা পেতে পারে। তাছাড়া ঘর আগুনে পুড়ে যাওয়ারও ভয় থাকে না। বিশেষ করে মাটির তৈরি ছাদ তাঁকে এই বিষয়ে বেশি উদ্বুদ্ধ করেছিল।  ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে এই ভাবনা থেকে পরীক্ষামূলকভাবে শ্যামলী তৈরি করা হয়েছিল। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে বাড়িটির মাটির ছাদ ভেঙে পড়ে। কিন্তু পরে তা আবার মেরামত করা হয়। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে মহাত্মা গান্ধী এবং কস্তুরী বাঈ শান্তিনিকেতন এসে এই বাড়িতে ছিলেন। রবীন্দ্রনাথে মৃত্যুর পরও মহাত্মা গান্ধী শান্তিনিকেতনে এসে এই বাড়িতেই থাকতেন।

উদয়ন

উদয়ন
১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে কোণার্ক যখন পাকা করা হয়। তখন আরও একটি বাড়ি তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে
রবীন্দ্রনাথের সাথে জাভা ভ্রমণ করেছিলেন স্থপতি সুরেন্দ্রনাথ কর। তিনি জাভার স্থাপত্য শৈলী এই বাড়িতে প্রয়োগ করেন। বাড়িটি তৈরির সার্বিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই বাড়িটির ভিতরের সাজসজ্জা করেছিলেন জাপানী শিল্পী কোনো সান্। এই বাড়ির দক্ষিণ দিকের একটি ঘর 'জাপানি ঘর' নামেই পরিচিত। সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি এই বাড়ির এই বাড়িটির নামকরণ করা হয় 'উদয়ন'। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এর নির্মাণকাজ চলেছিল।

পুনশ্চ
১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে শ্যামলী তৈরি হ‌ওয়ার পর,
রবীন্দ্রনাথ একটি নতুন ধরনের ছোটো বাড়ি তৈরি করার কথা ভেবেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, এই বাড়িতে আসার জন্য কাউকে যেনো কোনো বাধার সম্মুখিন হতে না হয়। চারিদক থেকে এই বাড়িতে অবাধে প্রবেশ করা যাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, এই রকম বাড়িতে অবাধে মানুষ ছাড়াও কুকুর, ছাগল ইত্যাদি প্রবেশ করছে। ফলে তিনি একটি বড় ঘরবিশিষ্ট বাড়ি তৈরির পরিকল্পনা করেন। যে বাড়িতে আসবাব পত্র হিসাবে বাক্স ব্যবহার করেবন। যাতে রাতে ঘুমানো যায় এবং দিনে লেখালেখির কাজও করা যায়। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এইরকম একটি বাড়ি করালেন এবং এর নাম দিলেন পুনশ্চ।  এই বৎসরেই তিনি এই বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। বাড়িটি তৈরি করা হয়েছিল শ্যামলীর পুবদিকে।

কিছুদিন পর দেখা গেল, পূব দিকের বারান্দা দিয়ে বৃষ্টির পানি ঘরে ঢুকে পড়ে। এই কারণে পূব দিকের বারান্দা কাঁচ দিয়ে ঘেরা হলো। শীতকালে উত্তরের ঠাণ্ডা বাতাস ঘরে ঢুকে, তাই সেদিকও ঘেরা হলো। অতিথিদের অপ্যায়নের জন্য দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ঘর তৈরি করা হলো। সামনের বারান্দায় বসে রবীন্দ্রনাথ লিখতেন। পূর্ব-দিক থেকে রৌদ্র এসে পড়তো। রৌদ্রে রবীন্দ্রনাথ কষ্ট পেতেন বলে সেদিকে একটি পাঁচিল তুলে দেওয়া হলো। একই কারণে পশ্চিম দিকেও পাঁচিল তোলা হয়েছিল। সব মিলিয়ে পুনশ্চ আর খোলামেলা বাড়ি রইলো না। এই কারণে রবীন্দ্রনাথ নতুন বাড়ির কথা ভাবা শুরু করলেন। রবীন্দ্রনাথ এই বাড়িটি ত্যাগ করার পর, এখানে কিছুদিন অ্যান্ড্রুজ ছিলেন। পরে ইন্দিরা দেব চৌধুরানী ও তাঁর স্বামী প্রমথ চৌধুরী বেশ কিছুদিন এখানে ছিলেন।

উদীচী (সেঁজুতি)
এরপর তৈরি হলো 'সেঁজুতি' নামক বাড়ি। কিন্তু বাড়িটি পূর্বদিকে অবস্থিত বলে
রবীন্দ্রনাথ এই বাড়ির নাম পাল্টে নতুন দিয়েছিলেন 'উদীচী'। এই নতুন বাড়িটি তৈরি করা হয়েছিল কয়েকটি থামের উপর। তোতলা সমান উঁচু এই বাড়িতে ছিল একটি মাত্র ঘর। খোলা আকাশ দেখার সুবিধার জন্য এই বাড়িটি তিনি তৈরি করিয়েছিলেন। এই ঘরে সকল ধরনের বসবাসের সুবিধা ছিল। সে কারণে সিঁড়ি বেয়ে তাঁকে বেশি নামতে-উঠতে হতো না। কিন্তু রবীন্দ্র নিচে পাঁয়চারী করার জন্য নিচে নামতেন কিন্তু উপরে উঠতে তাঁর বেশ কষ্ট হতো। এই কারণে নিচের থামগুলো ঘিরে তৈরি করা হয়েছিল একটি ঘর। এরপর থেকে রবীন্দ্রনাথ কখনো নিচে থাকতেন কখনো উপরে থাকতেন।


সূত্র :
উত্তরায়ণ  রবীন্দ্রভবন। রবীন্দ্রভবন বিশ্বভারতী। প্রশান্তকুমার পাল। ৭ পৌষ ১৪০৭।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। অজিতকুমার চক্রবর্তী 
http://www.santiniketan.com/