সংস্কৃত কলেজ, কলকাতা
১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ ভারতে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত কলেজ বিশেষ।

বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির জন্য জনশিক্ষা উন্নয়নের জন্য ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।
১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই জুলাই গভর্নর জেনারেল কর্তৃক গৃহীত এক প্রস্তাবে এই বিষয়টি বিশেষ বিবেচনাধীন ছিল। এই প্রস্তাবটি কার্যকর করার জন্য একটি সাধারণ কমিটি গঠন করা হয়েছিল।
এই কমিটিতে এইচ.টি প্রিন্সেপ, মেকলে ও এইচ.এইচ উইলসনএর মতো প্রাচ্যবিদ সহ দশজন সদস্য অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা প্রাচ্যদেশীয় বিদ্যা শিক্ষাদানের পক্ষপাতী ছিলেন। এই কারণে কলকাতায় সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। মূলত সংস্কৃত কলেজকে এদেশীয় হিন্দুদের শিক্ষা প্রদান করার জন্য এই কলেজ প্রতিষ্ঠিত করার পরিল্পনা করা হয়েছিল। তাই ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যদের ছাড়া অন্য সকল জাতকে শিক্ষার্থী হিসেবে এ বিদ্যাপীঠে প্রবেশ করতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল।
এই কারণে রাজা রামমোহন রায় এই উদ্যোগের প্রচণ্ড বিরোধিতা করেন। তিনি ১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই ডিসেম্বর গভর্নর জেনারেলের কাছে দাখিলকৃত এক স্মারকলিপিতে কমিটির সিদ্ধান্তের বিষয়ে আপত্তি উত্থাপন করেছিলেন। তিনি সরকারের কাছে উপযোগী বিজ্ঞানের সাথে গণিত, প্রাকৃতিক দর্শন, রসায়ন শাস্ত্র ও অঙ্গব্যবচ্ছেদবিদ্যাকে অন্তর্ভুক্ত করে অধিক উদারবাদী সবার জন্য শিক্ষাব্যবস্থার দাবি করেছিলেন। অবশ্য লর্ড আমহার্স্ট অবশ্য এ স্মারকলিপিটিকে বিশেষ গুরুত্ব দেন নি।
 
১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১লা জানুয়ারি কলকাতার বউবাজার স্ট্রীটে একটি ভাড়া করা বাড়িতে সংস্কৃত কলেজ যাত্রা শুরু করে। কলেজের সচিব ছিলেন সচিব রসময় দত্ত এবং সহকারী সচিব ছিলেন রামমাণিক্য বিদ্যালঙ্কার। প্রথম দিকে শুধু ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যদের সংস্কৃত কলেজের ক্লাসে উপস্থিত থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। ১৮২৭ খ্রিষ্টাব্দের ১লা মে প্রথমবারের মতো ইংরেজি ঐচ্ছিক বিষয় হিসাবে চালু হয়।।

১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দে রামমাণিক্য বিদ্যালঙ্কার মৃত্যুবরণ করেন। এরপর সহকারী সচিবের দায়িত্ব পান ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সচিব রসময় দত্তের অবসরগ্রহণের পর শিক্ষা পরিষদ সংস্কৃত কলেজকে কলকাতা মাদ্রাসার সম-মর্যাদা উন্নীত করে এবং বিদ্যাসাগরকে প্রথম অধ্যক্ষ নিয়োগ করে।

ক্রমে ক্রমে এই কলেজের শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন করা হয়েছিল। এই সূত্রে প্রাকৃতিক দর্শন, ভূগোল ও ইতিহাসের ওপর লিখিত গ্রন্থাবলি বাংলায় অনুবাদের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। ধীরে ধীরে এই কলেজে অঙ্গ-ব্যবচ্ছেদ-বিদ্যা, ইউরোপীয় চিকিৎসা-শাস্ত্র যুক্ত করা হয়েছিল। ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার পর এই কলেজ থেকে এই বিভাগটি তুলে দেওয়া হয়।

কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠানটিতে অনেক সংস্কার প্রবর্তন করেন। ১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে কায়স্থদের এবং ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে সকল সম্মানিত হিন্দুদের জন্য কলেজের দ্বার উন্মুক্ত করা হয়। এই সময় পরিমিত শিক্ষা ফি প্রবর্তন করা হয় এবং এর সঙ্গে শৃঙ্খলার ও নিয়মিত উপস্থিতির উপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়।

১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের সিপাহি বিপ্লবের পরে কলেজের চতুষ্পার্শ্বস্থ অঙ্গনাদিসহ মূল ভবনকে সাময়িকভাবে যুদ্ধকালীন হাসপাতাল ও শুশ্রূষা কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছিল।

১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অধ্যক্ষের পদ থেকে ইস্তফা দেন। এরপর অধ্যক্ষ পদ গ্রহণ করেন দীনবন্ধু শর্মা।

১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে নাগাদ কলেজটির তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের ক্লাসসমূহ প্রেসিডেন্সি কলেজে স্থানান্তরিত করা হয়। অবশ্য এই স্থানান্তরের প্রবল আপত্তি তুলেছিলেন- ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের মতো দেশীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ। এই সময় হিন্দু আইনের অধ্যাপকের পদটি বিলুপ্ত করতে হয়। তবে মহামহোপাধ্যায় মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন ২৫ জন অবৈতনিক ছাত্র নিয়ে কলেজের টোল বিভাগটি পুনরায় চালু করে সনাতন পদ্ধতিতে হিন্দু ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত গ্রন্থসমূহের ব্যাখ্যা প্রদান করত।
 
১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে বিশিষ্ট পণ্ডিতদের নিয়ে সংস্কৃত পরীক্ষার একটি বোর্ড গঠন করা হয়।
১৯১০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কলেজের ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে এবং বঙ্গে সংস্কৃত শিক্ষার উন্নতিসাধনে গুরুত্বপূর্ণ প্রেরণা যোগাতে কলেজটির ভূমিকা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের রিপোর্টে (১৯১৭-১৯১৯) প্রশংসিত হয়। এরপর এফ.এ পরীক্ষায় ইংরেজি, গণিত, সংস্কৃত, ইতিহাস ও যুক্তিবিদ্যার মতো বিষয়াবলি আবশ্যিক পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়।

১৯৩০-এর দশকব্যাপী দার্শনিক ও ইংরেজি ভাষায় সুপণ্ডিত ডক্টর সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত কলকাতা সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কলা বিভাগটি ইতঃপূর্বেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয় এবং কলেজটিতে পালি , প্রাচীন ভারতীয় ও বিশ্ব ইতিহাস এবং ভাষাতত্ত্বের কোর্সসমূহ পড়ানো হতো। সংস্কৃত ছাড়াও প্রাচ্যদেশীয় অথবা টোল বিভাগসমূহ এই কলেজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল।

২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে এই কলেজটির সম্প্রসারণ ঘটে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে। এই কারণে বর্তমানে একে বলা হয়, সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়।