ইনকা সভ্যতা
দক্ষিণ আমেরিকার একটি প্রাচীন সভ্যতা।
ধারণা করা হয় ইনকা সভ্যতার মানুষ, আমেরিকার অন্যান্য জাতির লোকদের মতই, বেরিং প্রণালী পার হয়ে এশিয়া থেকে, আমেরিকা মহাদেশে পা রেখেছিল। কালক্রমে নানাভাগে বিভক্ত হয়ে, এরা  আমেরিকা মহাদেশের বিভিন্ন স্থানে বসতি স্থাপন করে।

ইনকা সম্রাজ্যের ইতিহাস
১১০০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এদের একটি দল দক্ষিণ আমেরিকার অন্দিজ পর্বতমালার পেরুর উচ্চভূমির দিকে চলে আসে এবং এখানকার কুজবেন নামক স্থানে বসতি স্থাপন করে। স্থানের নামানুসারে এদেরকে বলা হয় কেচুয়া জাতি। এরা এই অঞ্চলে জঙ্গল কেটে কৃষিভূমি উদ্ধার করে এবং চাষাবাদ করতে থেকে। এদের অন্যতম ফসল ছিল ভুট্টা এবং আলু। প্রাথমিক অবস্থায় এই জনগোষ্ঠী এই অঞ্চলে একটি রাজত্ব গড়ে তোলে।

কুজবেনে বসবাসের সময় এদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং ধীরে ধীরে এদের বসবাসের এলাকা বৃদ্ধি পায়। এই সময় অন্যান্য ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলোর সাথে কিছু যুদ্ধবিগ্রহ হলে, এরা প্রতিটি ক্ষেত্রেই জয়ী হয়। এই সকল যুদ্ধের সূত্রে এদের ভিতরের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধারা সমাজে সম্মানিত এবং ক্ষমতাধর হয়ে উঠে। এরপর এই সকল যোদ্ধাদের সমর্থনে কেন্দ্রীয় নেতার উদ্ভব হয়েছিল
১২০০ খ্রিষ্টাব্দের আগেই। ধীরে ধীরে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা এই ব্যক্তি কাপাক (
capac) নামে অভিহিত হতে থাকে। উল্লেখ্য ইনকাদের ভাষায় কাপাক শব্দের অর্থ শাসক।

ইনকা ইতিহাসে মান্‌কো কাপাক (
Manco Capac)-কে প্রথম রাজা বা সম্রাটের মর্যাদা দেওয়া হয়। ইনকা সমাজের রীতি অনুসারে, মান্‌কো তাঁর নিজের বোনকে বিবাহ করেছিলেন। ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি কুজ্‌কো (Cuzco) নগরী প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়, মান্‌কো কাপাকের উত্তরসূরীরা ছোটো ছোটো রাজাদের রাজ্য জয় করে রাজ্যের বিস্তার ঘটায়।

এই রাজবংশের পাচুকুটি
(Pachacuti), ইনকা রাজ্যকে সম্প্রসারিত করে প্রথম একটি সাম্রাজ্য হিসেবে গড়ে তোলেন। যতদূর জানা যায়, ১৪৩৮ খ্রিষ্টাব্দে পাচুকুটি ক্ষমতা লাভ করেছিলেন। সাম্রাজ্যের অধিকার লাভের পরপরই কুজকোর তিনি করিক্যাঞ্চা (Coricancha) নামক স্থানটি নতুনভাবে সাজান। তাঁর সময়ে তৈরি কুজকো থেকে ৫০ মাইল দূরে ওল্লান্টায়টাম্বো (Ollantaytambo) নগরী। তবে তাঁর সময়ে তৈরি সবচেয়ে আলোচিত নগরী হলো মাচুপিচু (Machu Picchu)। সম্ভবত ১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পাচুকুটি মাচুপিচু নগরী তৈরি করেছিলেন এই নগরীটি কেন তৈরি করেছিলেন, তা নিয়ে নানা জনের নানা মত রয়েছে। অনেকে মনে করেন মাচুপিচু নগরীটি ছিল সম্রাটের নিজস্ব সম্পদ। এখানে একটি শক্তিশালী দুর্গ তৈরি করা হয়েছিল। এছাড়া শীতকালীন রাজধানী হিসেবে নগরীটি ব্যবহার করা হতো। উল্লেখ্য, ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাইরাম বিংহাম ((Hiram Bingham) 'মাচুপিচু' নামক শহরটির সন্ধান পান। এই নগরীটি স্প্যানিশদের হাত থেকে বিস্ময়করভাবে রক্ষা পেয়েছিল।

পাচাকুটিকে সম্রাট হিসেবে লোকে মান্য করার চেয়ে আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে বেশি মান্য করতো। ধারণা করা হয়, তার সময় থেকেই সাধারণ মানুষ সম্রাটকে দেবতার অংশ হিসেবে মান্য করা শুরু করে। পাচুকুটির রাজত্বকালে ইনকা সাম্রাজ্যকে দক্ষিণ আমেরিকার সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। সাম্রাজ্যে বিস্তারের প্রক্রিয়াটি সক্রিয় ছিল, পার্শ্ববর্তী রাজ্য দখলের মধ্য দিয়ে। এই সময় বিজিত রাজ্যের শাসক যদি ইনকা সম্রাটের আনুগত্য মেনে নিত, তাহলে, তাকে হত্যা করার পরিবর্তে শাসনের অধিকার দেওয়া হতো। মূলত এই প্রক্রিয়ায় ইনকা সাম্রজ্যের বিশাল অংশ ছিল করদ রাজ্য হিসেবে। বর্তমান ইকুয়েডর, পেরু, বলিভিয়া, উত্তর-পশ্চিম আর্জেন্টিনা, উত্তর চিলি ও দক্ষিণ কলম্বিয়া ইনকা সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাচুকুটির রাজত্বকালে সব মিলিয়ে ইনকা সাম্রাজ্য প্রায় দুই হাজার পাঁচশ মাইল বিস্তৃত ছিল। এই সময় ইনকারা নিজেদের সাম্রাজ্যের নাম দিয়েছিল 'তাহুয়ানতিনসুইউ' (চতুষ্কোণ ভূমি)।

১৪৭১ খ্রিষ্টাব্দে পাচুকুটির মৃত্যুর পর সম্রাট হন টোপা ইনকা (
Topa Inca)তিনি তাঁর আপন বোন মামা ওক্‌ক্লো (Mama Occlo) বিবাহ করেছিলেন এবং তাঁর প্রধান স্ত্রীও ছিলেন মামা। টোপা ইনকা-কে ইনকার অতিপ্রাকৃতিক শক্তির অধিকারী মানুষ মনে করতো। পাচুকুটির সময়, সম্রাট দেবতাদের অংশ এই ধারণা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। টোপা ইনকা-এর প্রতি আধ্যাত্মিক বিশ্বাস, সে ধারণাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল। তাঁর সময়ে তৈরি হয়েছিল চিন্‌চেরো (Chinchero) এবং  চোকুকুইরাও (Choquequirao) রাজকীয় নগরী তৈরি হয়।

১৪৯৩ খ্রিষ্টাব্দে টোপা ইনকার মৃত্যু হলে, তাঁর উত্তরসূরী হুয়াইনা কাপাক
(Huayna Capac) সম্রাট হন। এই সম্রাট তাঁর সাম্রাজ্যকে সুসংহত এবং  শক্তিশালী করেছিলেন। তাঁর আমলে ইনকা সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছিল। তাঁর সময়ে তৈরি হয়েছিল কুয়েসপিওয়ান্‌কা (Quespiwanka) এবং টোম্বেবাম্বা (Tombebamba) নগরী। ১৫২৫ খ্রিষ্টাব্দের  দিকে প্যারাগুয়ে থেকে চিরিউয়ানো গোষ্ঠীর সৈন্যরা পর্তুগিজ দখলদার আলিক্সো গার্সিয়াকে নিয়ে ইনকা রাজ্য আক্রমণ করে। এই আক্রমণ ইনকা সৈন্যরা সাফল্যের সাথে প্রতিহত করে। কিন্তু ইউরোপীয় সৈন্যদের দ্বারা সিফিলিস, বসন্ত রোগ এবং পেটের রোগ, জ্বর ইত্যাদি সংক্রামক ব্যাধি দ্বারা এরা আক্রান্ত হয়। এই জাতীয় রোগের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা ইনকাদের ছিল না। ফলে এই সকল রোগ দ্বারা বহু লোকের মৃত্যু হয়। কোনো একসময় এই জাতীয় রোগে ওয়াইনা কাপাক-এর রাজ পরিবারও আক্রান্ত হয়। ধারণা করা হয় সম্রাট ওয়াইনা কাপাক এবং তাঁর পরিবারের বহুলোকের মৃত্যু ঘটেছিল। ১৫২৭ খ্রিষ্টাব্দে ওয়াইনা কাপাকের মৃত্যুর পর, কোনোক্রমে বেঁচে যাওয়া তার দুই ছেলের ভিতরে হুয়াসকার (Huascar) রাজ্য লাভ করেন। কিন্তু তাঁর অপর ভাই আটাহুয়ালপাও (Atahuallpa) সিংহাসনের অধিকার দাবী করেন। ১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে হুয়াসকারকে অপসারিত করে আটাহুয়ালপা সম্রাট হন। আত্মকলহের কারণে এই সময় ইনকা রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এই বছরেই আটাহুয়ালপা-কে হত্যা করে স্প্যানিশ লুটেরা বাহিনীর নেতা ফ্রানসিসকো পিজারো পেরুর উপর আধিপত্য বিস্তার করে।

ফ্রানসিসকো পিজারো

ইনকা সম্রাট আটাহুয়ালপা

ইনকা সভ্যতা ধ্বংসের জন্য দায়ী করা হয় স্প্যানিশ ফ্রানসিসকো পিজারোকে। পিজারো স্পেন থেকে ১৫০২ খ্রিষ্টাব্দে হিসপানিওয়ালা (বর্তমানকালে হাইতি ও ডোমেনিকান রিপাবলিক) দ্বীপে আসেন। ১৫০৯ খ্রিষ্টাব্দে কলোম্বিয়া অভিযানে অংশ নেন। এরপর নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি পানামা পৌঁছান। এখানে এসে তিনি দক্ষিণ আমেরিকার স্বর্ণসমৃদ্ধ ভূখণ্ডের কথা জানতে পারে। ১৫২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে পরপর দুটো অভিযান চালান। এই সময় তিনি ইনকাদের সাম্রাজ্যের প্রবেশ করেন। তিনি  ষড়যন্ত্র করে কিছু ইনকা জাতির লোককে বন্দী করেন এবং সেই সাথে প্রচুর সোনাদানা এবং লামা নিয়ে স্পেনে ফিরে আসেন। এরপর পিজারো স্পেনের তৎকালীন রাজা পঞ্চম চার্লস-এর কাছে পেরু দখল এবং সেখানকার শাসক হওয়ার অনুমতি চান। রাজা পঞ্চম চার্লস পিজারোকে এই অভিযানে অনুমতি দেন । ১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বর্তমান পেরুতে পৌঁছান। ১৭৭ জন সৈন্য ও ৬২টি ঘোড়া নিয়ে কাজামারকা শহরে যাত্রা করেন। সে সময়ের ইনকা সম্রাট তখন আটাহুয়ালপা কাজামারকা শহরে অবস্থান করছিলেন। পিজারো কাজামারকা শহরের কাছে এসে ইনকা সম্রাটের কাছে স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা অনুমতি প্রার্থনা করেন। সম্রাট তাঁকে ঘোরাফেরার অনুমতি দিলে,  ১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই নভেম্বর তিনি শহরে প্রবেশ করেন। ১৬ই নভেম্বর তিনি শহরের একটি খোলা জায়গায় আটাহুয়ালপা ও ইনকা অভিজাতদের ভোজে নিমন্ত্রণ করেন। ইনকা সম্রাট এবং অভিজাত শ্রেণির লোকেরা সরল বিশ্বাসে প্রায় নিরস্ত্র অবস্থায় নিমন্ত্রণ রক্ষা করার জন্য আসেন। এরপর স্প্যানিশ সৈন্যরা তাঁদের ঘিরে ফেলেন এবং সম্রাট ছাড়া সকল অতিথিদেরকে হত্যা করে। এরপর পিজারো সম্রাটের মুক্তি পণ হিসেবে এক ঘর ভর্তি সোনা আর দুটি ঘর ভর্তি রূপা দাবী করেন। রাজ্যের অভিজাতরা পিজারোর সেই দাবী মেনে নেওয়ার পরও সম্রাটকে হত্যা করেন। সম্রাটের মৃত্যুর পর ইনকাদের প্রতিরোধ করার মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে, পিজারো ইনকার রাজধানী কুজকো দখল করে নেয়। ইনকা সাম্রাজ্যে স্প্যানিশদের দখলে আসার পর, এরা সমগ্র অঞ্চল জুড়ে হত্যা, লুণ্ঠনের তাণ্ডব চালায়। ইনকাদেরকে দাস হিসেবে বিক্রয়ের কার্যক্রম চালায়। পুরো পেরু অঞ্চল দখলে আসার পর, ১৫৩৫ খ্রিষ্টাব্দে পিজারো লিমা নামে একটি নতুন শহর প্রতিষ্ঠা করে এবং এই শহরে রাজধানী স্থাপন করে, পেরু শাসন করা শুরু করে।

এই সময় কৌশলী পিজারো, সম্রাট আটাহুয়ালপা-কে হত্যা করলেও, তার আরেক ভাই মানকো কাপাককে সিংহাসনে বসায়। ইতিমধ্যে লুটেরা স্প্যানিশদের মধ্যে স্বর্ণরৌপ্যের ভাগাভাগি নিয়ে হাঙ্গামা বাধে। মানকো তাদের এই হানাহানির সুযোগ নিয়ে পালিয়ে গিয়ে দুর্গম পাহাড়ি এলাকা ভিলকা বাম্বায় আশ্রয় নেয় এবং নতুন রাজধানী পত্তন করে। ১৫৪১ খ্রিষ্টাব্দে পিজারো ৬৬ বছর বয়সে লিমায় নিজ প্রাসাদে খুন হন।

মানকো কাপাক  ভিলকা বাম্বায় থেকে স্প্যানিশদের বিরুদ্ধে গুপ্ত যুদ্ধ পরিচালনা করা শুরু করেন। দীর্ঘদিন ধরে এই যুদ্ধ চলার পরও স্প্যানিশরা ভিলকা বাম্বার অবস্থানই জানতে পারে নি। ১৫৭২ খ্রিষ্টাব্দে স্প্যানীয়রা ভিলকা বাম্বার অবস্থান খুজেঁ পায় এবং মানকো-কে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। মূলত এই পরাজয়ের মধ্য দিয়ে সর্বশেষ ইনকা সম্রাট ও তার সাম্রাজ্য বিলুপ্ত হয়ে যায়।

ইনকার শাসককুল
কেচুয়া জাতির লোকেরা মূলত সূর্যের উপাসক ছিল। কেচুয়া জাতির লোকেরা এক সময় তাঁদের নেতাকে সূর্যপুত্র ভাবতো। সম্ভবত ইনকা শাসকরা নিজেদেরকে এইভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল। সেই সাথে যোগ দিয়েছিল ইনকা ধর্মের পুরোহিতরা। সূর্য দেবতার নামানুসারে সম্রাট নাম পেয়েছিল ইনকা। সম্রাট বিবাহ করতেন আপন বোনকে। তবে রাজ্যের সুন্দরী নারী উপহার পেলে, উপপত্নী হিসেবে তিনি গ্রহণ করতেন। এই কারণে প্রত্যেক সম্রাটের একটি প্রধান স্ত্রী থাকতো। সম্রাটের বড় ছেলে সম্রাট হতেন।

ইনকার শাসককুলের প্রধান ছিলেন সম্রাট। এরপরের ক্ষমতাধর ছিলেন অভিজাত শ্রেণি, ইনকার পুরোহিতকূল এবং সেনাপ্রধানরা। রাজধানীতে সম্রাটের ক্ষমতা যতটা ছিল, রাজধানী থেকে দূরের এলাকাগুলোতে তটটা ছিল না। দূরবর্তী অঞ্চল শাসন করতেন অভিজাত শ্রেণি, ইনকার পুরোহিতকূল এবং সেনাপ্রধানরাই।

পুরো সাম্রাজ্য কতকগুলো প্রদেশে বিভাজিত ছিল। প্রাদেশিক শাসক হিসেবে সর্বোচ্চ পদে থাকতেন সামরিক বাহিনীর প্রাদেশিক অধিকর্তা এবং প্রাদেশিক পুরোহিত প্রধানরা। এদেরকে বিশেষভাবে সহায়তা করতেন অভিজাতশ্রেণির পরিবারগুলোকে। এঁরা অর্থ-সম্পদ দিয়ে
পুরোহিতকূল এবং সেনাপ্রধানদের সন্তুষ্ট রাখতেন। পুরোহিতকূল এবং সেনাপ্রধানরাও অভিজাতশ্রেণিকে নানাভাবে সমর্থন করতেন।

ইনকাদের খাদ্যাভ্যাস ও অর্থনীতি
ইনকাদের আদিপুরুষরা শিকারী ছিল। পরে এরা ধীরে
ধীরে কৃষিজীবী হয়ে পড়ে। এদের প্রধান খাদ্য ছিল ভুট্টা ও আলু। এরা ভূট্টা থেকে এক ধরনের পানীয় তৈরি করে খেত। এই পানীয়ের নাম ছিল চিচা। পেরুতে এটি এখনো জনপ্রিয়। এছাড়া ওল, নীল শ্যাওলা, কাঁচা মরিচ খেতো। মাংসের মধ্যে ছিল গিনিপিগ ও ছাগল জাতীয় লামার মাংস। সাগরের নিকটবর্তী এলাকার মানুষ সামুদ্রিক মাছ খেতো।  ইনকাদের বড় সাফল্য ছিল খাদ্য সঞ্চয়ে। সমগ্র সাম্রাজ্য জুড়ে অসংখ্য সরকারি খাদ্যভাণ্ডার ছিল। এছাড়া সাধারণ মানুষকে খাদ্য সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করা হতো। এই প্রক্রিয়ায় এদের প্রায় ৫-৭ বছরের খাদ্য মজুদের ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। শস্য ছাড়াও তারা মাংস শুকিয়ে নোনা করে রাখতো। 

এদের কর ব্যবস্থা ছিল কঠোর। সকল ধরনের মানুষের কাজের প্রকৃতি অনুসারে কর পরিশোধ করতে হতো। কোনো ব্যক্তি কর পরিশোধে অক্ষম হলে, রাষ্ট্রীয় কাজ করে কর পরিশোধ করতে হতো। অধিকাংশ পুরুষ সৈন্যবিভাগে, খনিতে বা কৃষিখামারে কাজ করতো। মেয়েদের নির্দিষ্ট পরিমাণ কাপড় তৈরি করতে হতো।
এই সাম্রাজ্য কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলায় আবদ্ধ ছিল। সাম্রাজ্যের প্রতিটি মানুষ, এমনকি অন্ধ, খোঁড়া, মূক, বধির, বৃদ্ধ লোকেরা সম্মানের সঙ্গে তার শ্রমের বিনিময়ে উৎপাদিত শস্য সমানভাগে উপভোগ করত।

ইনকাদের সমাজব্যবস্থা
ইনকারা অত্যন্ত সামাজিক ছিল। এই কারণে এরা সামাজিক রীতিনীতিকে অত্যন্ত প্রাধান্য দিত। রাজা নিজের বোনকে বিবাহ করলেও, সাধারণ ইনকাদের
ভিতরে এই জাতীয় কোনো বিধি ছিল না। এরা আপন বোন ছাড়াও অন্য যে কোনো কন্যাকে বিবাহ করতে পারতো। এক্ষেত্রে ইনকা ছেলেদেরকে ২০ বৎসর বয়সের আগে কন্যা পছন্দ করতে হতো। কোনো ছেলে কনে খুঁজে না পেলে, অভিভাবকরা কনে খুজে দিত। অনেক সময় কোনো কোনো অভিভাবক তার পুত্র সন্তানের জন্য কন্যা পছন্দ করে রাখতো। কন্যার অভিভাবকরা তাতে রাজি হলে, ওই কন্যা বাগদত্তা হিসেবে অন্য কারো সাথে বিবাহ করতে পারতো না। বিবাহের দিন বর-কনে পরস্পরের হাত ধরে চন্দন বিনিময় করতো। এরপর বিবাহ উপলক্ষে সামাজিক ভোজ হতো। কিন্তু রাজ্যের সুন্দরী মেয়েদের অনেক সময় রাজার উপপত্নী করার জন্য পাঠানো হতো। এ বিষয়ে স্থানীয় পুরোহিত এবং সেনাশাসকদের বিশেষ ভূমিকা থাকতো।

মানতাস আবরিত ইনকা নারী

ইনকাদের পোশাক
আলস্কা ছুঁয়ে ইনকাদের যে দল আমেরিকায় প্রবেশ করেছিল, তাদের পোশাক ছিল পশুর চামড়া। আমেরিকার গ্রীষ্মপ্রধান এলাকায় প্রবেশ করার পর এরা হালকা পোশাকের জন্য সূতিবস্ত্র তৈরি করা শেখে। পেরু অঞ্চলে প্রবেশ করার পর, এরা লামার পশম দিয়ে পোশাক বানানো আয়ত্ব করে।

অভিজাতরা পোশাকের সাথে পরতো ধাতুর প্রতীকী লকেট। মেয়েরা এক ধরনের ভারি চাদর জাতীয় পোশাক দিয়ে শরীর আবৃত করতো। একে বলা হতো 'মানতাস'। তবে সকল পোশাকই সেলাইহীন ছিল। পুরুষরা নিম্নাঙ্গে লম্বা সুতির পোশাক পড়তো ধুতির মতো করে। তবে সকল মানুষে পায়ে চপ্পল জাতীয় উপকরণ ব্যবহার করতো। এই চপ্পল তৈরি হতো লামার চামড়া থেকে। পুরুষদের ঊর্ধাঙ্গে পোশাক ধারণ করার রীতি ছিল না। রাজা নানা ধরণের অলঙ্কার ধারণ করতো।

ইনকাদের স্থাপত্য-কৌশল
ইনকারা অত্যন্ত সামাজিক ছিল। সেই কারণে এদের ভিতরে যৌথ পরিবারে প্রথা প্রচলিত ছিল। সাধারণ মানুষ ঘরের দেওয়াল তৈরি করতো পাথর, মাটি, ঘাস ইত্যাদি দিয়ে। কাদামটি, খড়, ঘাস ইত্যাদি দিয়ে ছাদ তৈরি করতো। ছাদগুলো ছিল বাংলাদেশের দোচালা বা চারচালা ঘরের মতো। দেয়ালে বায়ু চলাচলের জন্য ছোটো ছোটো চৌকো ফোঁকর ছিল। এই ঘরগুলো খুব বেশি মজবুত হতো না। ধনী পরিবারগুলোর ছিল বড় বড় প্রাসাদ। এগুলো মজবুত করে তৈরি করা হতো। ইনকা
সভ্যতার নমুনা সবচেয়ে ভালো অবস্থায় পাওয়া গেছে মাচুপিচু নগরীটিতে। দুই পর্বতশৃঙ্গের মধ্যবর্তী বন্ধুর উপত্যাকার ভিতরে পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে এই শহর তৈরি করা হয়েছিল। এখানে ছিল দীর্ঘ সিঁড়িপথ, বিশেষ ব্যবস্থায় তৈরি করা কৃষিভূমি, জলনিষ্কাষণ এবং পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা।

এই বিশাল সাম্রাজ্যের ভিতরে যোগাযোগ রক্ষার প্রধান ব্যবস্থা ছিল, সড়কপথ।
পুরো সাম্রাজ্য জুড়ে এরা সড়ক তৈরি করেছিল প্রায় ১৪ হাজার মাইল। এই পথকে বর্তমানে বলা হয় ইনকা ট্রেইল। এই পথ ছিল মূলত পায়ে চলার উপযোগী। তবে স্থান বিশেষে মালামাল পরিবহনের উপযোগী গাড়ি চলাচলের জন্য রাস্তাও ছিল। স্থানের বৈশিষ্ট্য অনুসারে এই পথের প্রকৃতি নানাস্থানে নানা রকমের ছিল। সমতলভূমিতে বড় বড় পাথর বা কোথাও নুড়ি বিছিয়ে পথের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি করতো। ফলে বর্ষার সময়েও কাদা এবং পিচ্ছিল অবস্থা থেকে পথচারী মুক্তি পেতো। পাহাড়ি অঞ্চলে এই পথ তৈরি করা হতো সিঁড়ি। কোথাও কোথাও ব্যবহৃত হতো প্রাকৃতিক পাহড়ি সমতলধর্মী বন্ধুর পথ। এই পথে সামরিক ও বেসামরিক সকল লোকই চলাচল করতো। নিচের তিনটি দৃশ্যে পথের নমুনা দেখানো হলো।

সমতলের পাথর বিছানো পথ

পাহড়ি সিঁড়ি পথ

প্রাকৃতিক পাহড়ি সমতলধর্মী বন্ধুর পথ

 

সূর্যমন্দির ইনতিহুয়াটানা

ইনকাদের ধর্মবিশ্বাস
ইনকাদের প্রধান দেবতার নাম ছিল ভিরাকোকা। ইনকারা এই দেবতাকে তাদের জগৎস্রষ্টা হিসেবে মনে করতো। তবে সূর্য দেবতা ইনতি ছিল বিশেষ মর্যাদার দেবতা। ইনতির সন্তান হিসেবে এরা নিজেদেরকে ইনকা বলতো। এরা ঊচু কোনো পাহাড়ের উন্মুক্ত স্থানে পাথরের বেদী তৈরি করতো। এর উপরে সূর্যদেবতার প্রতীকী মূর্তি রাখা হতো। সূর্যমন্দিরের দায়িত্বে থাকতেন একজন প্রধান পুরোহিত এবং তাঁর কিছু সহযোগী পুরোহিত। এই মন্দিরকে বলা হতো
ইনতিহুয়াটানা।


তথ্যসূত্র: