অব্যয়
ব্যাকরণে বর্ণিত পদ বিশেষ। বিভিন্ন ভাষায় অব্যয়ের প্রকৃতি শব্দানুসারে বিভিন্নভাবে
নির্ধারিত হয়। বাংলা ব্যাকরণ মতে–
বাক্যে বা
শব্দের সাথে ব্যবহৃত যে সকল ধ্বনি- বিভক্তি,
বচন,
লিঙ্গ ও কারকভেদে কোনভাবে পরিবর্তন হয় না, সে সকল পদকে অব্যয় বলে।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এর সমার্থ ইংরেজি গ্রহণ করেছেন-Indeclinables।
সুনীতি চট্টোপাধ্যায়-এর
ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ মতে– সংস্কৃত-ভাষার এরূপ পদ, বিশেষ্য, বিশেষণ,
সর্বনাম ও ক্রিয়াপদ-পদের ন্যায়, লিঙ্গ, বচন, কারক, এবং কাল ও পুরুষ-বাচক প্রত্যয়
বিভক্তি গ্রহণ করিত না; বিভক্তি-যোগে এগুলির মূল রূপের অথবা অর্থের কোনও ব্যয়
অর্থাৎ 'ক্ষয় বা সঙ্কোচ বা পরিবর্তন' হইত না,–এই জন্য এই গুলিকে অ–ব্যয় বলা
হইত; যথা "অপি; চ; উত; তু; ননু"; ইত্যাদি। বাঙ্গালায় এরূপ বিকার-হীন অব্যয় শব্দ
আছে; যথা- "আর; না; ও; তো"; ইত্যাদি।
বাংলা ব্যাকরণে অব্যয়ের প্রকৃতি যেভাবে নির্ধারিত হয়, তা হলো-
ক। এর বহুবচন হয় না।
খ। ক্রিয়ার কাল দ্বারা প্রভাবিত হয় না।
গ। লিঙ্গান্তর নেই।
ঘ। এর সাথে কোন বিভক্তি যুক্ত হয় না।
বাক্যে এর ব্যবহার বিবিধ কারণে ব্যবহৃত হয়। এই
পদ নিজে অপরিবর্তনীয় অবস্থায় থেকে, যে ফলাফল প্রদান করে তা হলো-
ক। বাক্যের শোভা বৃদ্ধি করে।
খ। বাক্যকে সংযুক্ত করে।
গ। শব্দের অর্থগত পার্থক্য সৃষ্ট করে।
গঠন প্রকৃতি দিক থেকে অব্যয় বিভিন্ন প্রকারের
হতে পারে। যেমন–
ক। এক বা একাধিক বর্ণ, বা শব্দ দিয়ে অব্যয় তৈরি হতে পারে।
একটি বর্ণ- ও,
একাধিক বর্ণ- বটে।
একটি শব্দ- অতএব, বটে।
একাধিক শব্দ- হায় হায়।
বর্ণ ও শব্দ যুক্ত হওয়ার প্রকৃতি অনুসারে একে
কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন–
১। শব্দ ও বর্ণ যোগ : প্রথম +ত= প্রথমত। উল্লেখ্য তৎসম শব্দের সাথে ত যুক্ত হয়ে এই
জাতীয়, অব্যয় তৈরি হয়।
২। একাধিক শব্দযোগ : অতএব (অতঃ +এব), কদাপি (কদা +অপি) ইত্যাদি।
৩। শব্দ দ্বিত্ব : হায় হায়, ছি ছি, বেশ বেশ ইত্যাদি
৪। অনুকার শব্দ : কনকন, শনশন, ছলছল ইত্যাদি
শব্দ-প্রকৃতি, ভাবগত অর্থ ও ব্যবহারিক মূল্যের
বিচারে অব্যয়কে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগগুলো হলো- শব্দ-উৎসের বিচারে অব্যয়,
ভাবগত অর্থের বিচারে অব্যয় ও ব্যবহারিক মূল্যের বিচারে অব্যয়।
১। শব্দ-উৎসের বিচারে অব্যয় : শব্দ-উৎসের বিচার হলো–
নির্ধারিত অব্যয়টি কোন ভাষার সূত্রে বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছে। এই বিচারে অব্যয়
চার প্রকার। এগুলো হলো–
ক। তৎসম অব্যয় : যে সকল অব্যয় সংস্কৃত থেকে অবিকৃতভাবে গৃহীত হয়েছে। যেমন– যদি,
সদা, সহসা ইত্যাদি।
খ। তদ্ভব বা অর্ধ-তৎসম অব্যয় : যে সকল অব্যয় সংস্কৃত থেকে বিবর্তিত হয়ে বাংলায়
প্রবেশ করেছে। যেমন আর= সংস্কৃত অপর>প্রাকৃত আর>বাংলা আর।
খ। বাংলা অব্যয় : যে সকল অব্যয় দেশী উৎস থেকে গৃহীত হয়েছে।
যেমন– অ, ও ইত্যাদি।
গ। বিদেশী অব্যয় : সংস্কৃত, অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব ও দেশী অব্যয় ব্যতীত সকল অব্যয়কেই
বিদেশী অব্যয় বলা হয়। যেমন– আলবত, বহুত, শাবাশ ইত্যাদি।
২। ভাবগত ও ব্যবহারিক অর্থের বিচারে অব্যয় : শব্দ হিসাবে এবং তা বাক্যে কি ভাবগত
অর্থে ব্যবহৃত হয়, তার বিচারে অব্যয়কে প্রাথমিকভাবে ৩টি ভাগে ভাগ করা হয়। ভাগ দুটি
হলো-
১.সংযোগ-বাচক বা সম্বন্ধবাচক (conjjunctions
বা
Post-positions)
২. মনোভাববাচক (রাজা রামমোহন রায়ের মতে অন্তর্ভাবার্থক )
অব্যয় (Interjection)।
৩. শব্দ-উৎপাদক বা পরিবর্তক অব্যয়।
১.সংযোগ-বাচক বা সম্বন্ধবাচক (conjjunctions বা Post-positions): বাক্যের সংযোজক, বিয়োজক, প্রাতিপক্ষিক, ব্যতিরেক ইত্যাদি অর্থে- যে সকল অব্যয় ব্যবহৃত হয়। এইসকল বিচারে সংযোগ-বাচক বা সম্বন্ধবাচক অব্যয়কে যে সকল ভাগে ভাগ করা হয়, তার সংজ্ঞা ও তালিকা নিচে তুলে ধরা হলো। | ||
১.১. সংযোজক অব্যয় (connectives)
অব্যয় : যে সকল অব্যয় পদ বা বাক্যের ভিতরে সংযোজক সাধন করে।
যেমন–অধিকন্তু, আর, আরও, এবং, ও, তথা, তাই, সুতরাং। ১.২. বিযোজক অব্যয় (exceptives) : যে সকল অব্যয় বাক্য বা পদকে বিকক্পবাচক ভাবকে নির্দেশ করে। যেমন– মন্ত্রের সাধন, কিংবা শরীর পতন। এই শ্রেণীর অব্যয়গুলো হলো- নইলে, নতুবা, নয়তো, না-হয়, না হলে। ১.৩. সঙ্কোচক ( প্রাতিপক্ষিক, adversatives) অব্যয় : যে সকল অব্যয় বাক্য বা পদকে সংকোচিত করে। যেমন– তিনি বিদ্যান কিন্তু অসৎ। এই শ্রেণীর অব্যয়গুলো হলো-অথচ, অধিকিন্তু, অপরন্তু, অপিচ, আবার, আর, এদিকে, ওদিকে, কিন্তু, তত্রাচ, তত্রাপি, তথাপি, তথাপিও, তবু, তবুও, তৎসত্ত্বেও, তথাপি, তো, নয় তো, পরন্তু, পুনরায়, পুনশ্চ, বটে, বরং, বরঞ্চ্। ১.৪. অবস্থাত্মক (conditional) : যে সকল অব্যয় বাক্য বা পদকে অনুসরণ কষ্রে শর্তসাপেক্ষ্য ভাব প্রকাশ করে, সেক্ষেত্রে অনুগামিতা সৃষ্টি করে। এই জাতীয় অব্যয়কে অনুগামী বলা হয়। যেমন– যদি বনিবনা হয়, তা হলে তার সাথে ব্যবসা হতে পরে। এই জাতীয় অব্যয়গুলো হলো-না হলে, পরে, যদি, যদি নাকি, যদি না হয়, যদিও, যাই, যে, যেন, হলে। ১.৫. কারণাত্মক (causals) : যে সকল অব্যয় দ্বারা কারণ বা হেতুর অন্বষণ করা হয় তাদেরকে কারণাত্মক অব্যয় বলে। অব্যয়গুলো হলো-এই কারণে, এই জন্য, এই হেতু, কারণ, জন্য, বলে, তাই, বলিয়া, যে কারণ, যে কারণে, যে হেতু, সেই জন্যে,সেই হেতু। ১.৬. অনুধাবনাত্মক (conclusives) : যে সকল অব্যয় দ্বারা কোন বিষয়ের অনুধাবন বা পরিসমাপ্তির ভাব প্রকাশ করা হয়। যেমন– অতএব, সুতরাং। ১.৭. সমাপ্তিবাচক (final) : যে সকল অব্যয় দ্বারা কোন বিষয়ের অনুধাবন বা পরিসমাপ্তির ভাব প্রকাশ করা হয়। যেমন– অবশেষে, শেষে। ১.৮. অবধারণ, পাদপূরণ বা বাক্যালঙ্কারে ব্যবহৃত অব্যয় (explectives): তো, না। ১,৯, প্রশ্নবাচক (Interrogatives): যে সকল শব্দের উচ্চারণের ভিতর দিয়ে প্রশ্নবাচক ভাব প্রকাশ করা হয়। যেমন– তাই না কি?, না? ১.৯. উপমা-দ্যোতক (comparatives): যে শব্দের দ্বারা কোনো কিছুর ভিতর তুলনা করা হয়। যেমন– মত, যেমন, ন্যায়, যথা। |
||
২. মনোভাববাচক (রাজা রামমোহন রায়ের মতে অন্তর্ভাবার্থক ) অব্যয় (Interjection) | ||
যে সকল অব্যয় দ্বারা কোন বিষয় সম্পর্কে কর্তা তাঁর মনোভাব প্রকাশ করে থাকেন। এই জাতীয় অব্যয়ের দ্বারা, সম্মতি, অসম্মতি, অনুমোদন, ঘৃণা, বিরক্তি, ভয়, মনঃকষ্ট, বিস্ময়,, করুণা, আহ্বান ইত্যাদি প্রকাশ করা হয়। | ||
২.১ সম্মতিবাচক (assertives)।
এই জাতীয় অব্যয় দ্বারা কোন বিষয়ের সাথে একমত হওয়া বা তাতে সম্মতি প্রদান
প্রকাশ করা হয়। যেমন– আচ্ছা, আজ্ঞে, যথা-আজ্ঞা, যা বলেন, যে আজ্ঞে, হাঁ,
হুঁ, হ্যাঁ ইত্যাদি। ২.২. অসম্মতিবাচক (negetive)। এই জাতীয় অব্যয় দ্বারা কোন বিষয়ের সাথে একমত না হওয়া বা তাতে অসম্মতি প্রদান প্রকাশ করা হয়। যেমন– না, একদমই না, না তো, আদৌ না ইত্যাদি। ২.৩. অনুমোদনজ্ঞাপক
(appreciatives)। এই জাতীয় অব্যয় দ্বারা কোন
বিষয়ের অনুমোদনের ভাব প্রকাশ করা হয়। এই অনুমোদনের
বহিঃপ্রকাশ ঘটে প্রশংসাসূচক অর্থে হতে পারে। যেমন– বাঃ, বাহ্, চমৎকার। |
৩. শব্দ-উৎপাদক বা পরিবর্তক অব্যয়।
শব্দার্থ-বিবর্তক অব্যয় : যে সকল অব্যয়
ক্রিয়ামূলের সাথে যুক্ত নতুন ভাবের শব্দ সৃষ্টি করে বা নাম শব্দের সাথে যুক্ত হয়ে
বাক্যের শব্দগুলির মধ্য সম্পর্ক স্থাপন করে, সেগুলিক শব্দ-উৎপাদক বা পরিবর্তক অব্যয়
বলা হবে। এই জাতীয় অব্যয়গুলি ক্রিয়ামূলের পূর্বে বা শব্দের পরে বসে শব্দের ভাব
প্রকাশ করে বা বাক্যের অন্যান্য শব্দের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। অবস্থানের বিচারে
এই সকল অব্যয়কে যে ভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা যায়, তা হলো–
৩.১ আদ্য অব্যয়। এই
জাতীয় ক্রিয়ামূলের পূর্বে বসে প্রত্যয় নিষ্পন্ন শব্দের বিভিন্ন ভাবকে
প্রকাশ করে। সংস্কৃত ব্যাকরণে এই তালিকায় আছে উপসর্গসহ অন্য কিছু শব্দ। এই
বিচারে এই অব্যয়গুলিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
৩.১.১. উপসর্গ : সংস্কৃত ব্যাকরণে
এর সংখ্যা ২১টি। এছাড়াও রয়েছে বাংলা এবং বিদেশী উপসর্গ। দেখুন :
উপসর্গ
। |
||
৩.২ উত্তর অব্যয়।
এই জাতীয় অব্যয় ক্রিয়ামূল বা শব্দের পরে যুক্ত হয়ে- নূতন শব্দ তৈরি করে বা
শব্দের ভাবকে সম্প্রসারিত, সঙ্কোচিত করে বা বাক্যের শব্দগুলির ভিতর সম্পর্ক
স্থাপন করে। এই জাতীয় অব্যয়কে প্রাথমিকভাবে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। ভাগ দুটি
হলো– ৩.২.১. প্রত্যয় (suffix): ক্রিয়ামূল বা শব্দমূলের পরে বসে। প্রত্যয় পাঁচ প্রকার। এগুলি হলো- ১. কৃৎপ্রত্যয় (Primary suffix) ২. তদ্ধিত প্রত্যয় (Secondary suffix) ৩. স্ত্রী-প্রত্যয় (faminine suffix) ৪. ধাত্ববয়ব (Parts of roots) ৫. বিভক্তি (Inflection) |
||
৩.২.২. অনুসর্গ : এই জাতীয় অব্যয় শব্দের পরে পৃথকভাবে বসে বাক্যের অন্যান্য শব্দের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। এর অপর নাম কর্মপ্রবচনীয়। এর ভিতরে কিছু অনুসর্গ কারক বিভক্তিরূপে ব্যবহৃত হয়। এর বাইরে বাংলাতে আরও অনেক অনুসর্গ ব্যবহৃত হয়। সব মিলিয়ে এই জাতীয় অব্যয় যতগুলি পাওয়া যায়, তা হলো- অধিক, অপেক্ষা, অবধি, উপরে, কর্তৃক, কারণে, ছাড়া, জন্যে, তরে, নিমিত্তে, চাইতে, চেয়ে, থেকে, দিয়া, দিয়ে, দ্বারা, নামে, নিচে, বই, বলে, বিনা, বিনি, বিহনে, মত, মাঝে, সহিত, সাথে, হইতে, হতে, হেতু। যেমন– দ্বারা, দিয়া, কর্তৃক, হইতে থেকে, চেয়ে। এর বাইরে আরও অনেক অনুসর্গ ব্যবহৃত হয়। দেখুন : অনুসর্গ |