সংস্কৃত ছন্দ
সংস্কৃত ভাষায় রচিত কাব্য বা মন্ত্রসমূহের ছন্দকেই সাধারণভাবে বলা হয় 'সংস্কৃত ছন্দ'। ক্রমবিবর্তনের ধারায় বৈদিক ছন্দের সূত্রে সংস্কৃত ছন্দের উৎপত্তি ঘটেছিল।

ভারতীয় আর্যদের কাব্য ও সঙ্গীতের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয় বেদকে। আনুমানিক ১২০০ থেকে ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে ভারতীয় আর্যদের দ্বারা বৈদিক সাহিত্যের প্রথম পর্ব সমাপ্ত হয়েছিল। শুরুর দিকে আর্য ঋষিরা তাঁদের ধর্মাদর্শন ছন্দে রচনা করে তা শিষ্যদের শোনাতেন। এই ছন্দোবদ্ধ ধর্মবাণীর ক্ষুদ্র অংশগুলোর সাধারণ নাম ছিল ঋক্। শিষ্যরা তা শুনে মুখস্থ করে নিতেন। এই শিষ্যরা আবার তাঁদের শিষ্যদের শোনাতেন। দীর্ঘকাল ধরে গুরুপরম্পরা এই ঋকসমূহ গুরু ও শিষ্যদের স্মৃতিতে সংরক্ষিত হয়েছিল। এই ঋকসমূহ শিষ্যরা শ্রবণের মাধ্যমে গ্রহণ করতেন, তাই এর নাম ছিল শ্রুতি। খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ থেকে ৪০০ অব্দের মধ্যে আরও বেশকিছু ঋক রচিত হয়েছিল। বৈদিক সাহিত্যের দ্বিতীয় পর্বটি প্রভাবিত হয়েছিল পৌরাণিক কাহিনি দ্বারা। এই সময়ের ভিতরে রচিত শ্রুতিসমূহ গদ্য ও পদ্যে রচিত হয়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দের দিকে কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ শ্রুতিসমূহকে ছন্দ ও বিষয়বস্তুর বিচারে পৃথক পৃথক নামে সংকলন করেছিলেন। তিনি শ্রুতিসমূহের সংকলনের নাম দিয়েছিলেন বেদ। বিদ্ অর্থাৎ জ্ঞান আর জ্ঞানগ্রন্থ হলো- বেদ। এর ছন্দে রচিত অংশের নাম সংহিতা। আর গদ্যে রচিত জ্ঞান অংশের নাম দেওয়া হয়েছিল ব্রাহ্মণ। গদ্য-পদ্যে মেশানো এই সংকলনের সাথে পরবর্তী সময়ে যুক্ত হয়েছিল আরণ্যক ও উপনিষদ নামক জ্ঞানগ্রন্থ।

প্রাচীন ভারতীয় সঙ্গীত জগতে তালের নমুনা পাওয়া যায়- সিন্ধু সভ্যতার তালযন্ত্রের নমুনা থেকে। কিন্তু সেকালের তালের নমুনা পাওয়া যায় না। খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ অব্দের দিকে যখন ঋগ্বেদের শুরুর দিকে যখন ছন্দের বন্ধনে ঋকগুলো রচিত হওয়া শুরু হলো- তখন বৈদিক তালের উৎপত্তি ঘটে নি। সে সময়ে ছিল অনার্য লোক সঙ্গীত এবং আর্যপাল্লীর লৌকিক গান। এ সকল গানের তাল বা ছন্দ ছিল। কিন্তু নমুনার অভাবে সে সকল ছন্দ বা তালের হদিস পাওয়া যায় না। তাই প্রাচীন বা আদি ছন্দ হিসেবে বৈদিক ছন্দকেই বিবেচনায় আনতে হয়।

বৈদিক সাহিত্যে বিশেষভাবে ৭টি ছন্দের পরিচয় পাওয়া যায়। ঋকবেদের প্রথম মণ্ডলের প্রথম সূক্তটি রচনা করেছিলেন বিশ্বামিত্রের পুত্র মধুচ্ছন্দা। এই সূক্তটির ছন্দ 'গায়ত্রী'। গায়ত্রীকে বৈদিক ছন্দের আদি ছন্দ হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ এই ছন্দের সাথে চারটি করে অক্ষর যুক্ত হয়ে হয়ে- নতুন নতুন ছন্দের উদ্ভব হয়েছিল। এই ছন্দগুলো হলো-
১. গায়ত্রী:  ২৪ অক্ষর বিশিষ্ট ছন্দ।
২. উষ্ণিক: ২৮ অক্ষর বিশিষ্ট ছন্দ।
৩. অনুষ্টুপ্:  ৩২ অক্ষরবিশিষ্ট ছন্দ।
৪. বৃহতী: ৩৬ অক্ষরবিশিষ্ট ছন্দ।
৫. পঙক্তি:  ৪০ অক্ষরবিশিষ্ট ছন্দ।
৬. ত্রিষ্টুপ্: ৪৪ অক্ষরবিশিষ্ট ছন্দ।
৭. জগতী: ৪৮ অক্ষরবিশিষ্ট ছন্দ।
ঋকবেদের প্রথম মণ্ডলের প্রথম সূক্তটি রচনা করেছিলেন বিশ্বামিত্রের পুত্র মধুচ্ছন্দা। এই সূক্তটির ছন্দ 'গায়ত্রী'। গায়ত্রীকে বৈদিক ছন্দের আদি ছন্দ হিসেবে বিবেচনা করা আরও একটি কারণে। গায়ত্রীর অক্ষর সংখ্যা ২৪টি। এর সাথে ৪টি অক্ষর যুক্ত করলে হয় উষ্ণিক। এই সূত্র ধরে অন্যান্য ছন্দের অক্ষর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

ভাষার ক্রমবির্তনের ধারায় বৈদিক ভাষা সংস্কারকৃত হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল সংস্কৃত ভাষা। এই সূত্রে সংস্কৃত্ সাহিত্যের আদি নমুনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়- রামায়ণ ও মহাভারত। খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-৩০০ অব্দের ভিতরে রচিত এই গ্রন্থ দুটির সূত্রে- সংস্কৃত সাহিত্যের 'মহাকাব্যিক যুগ' বলা যেতে পারে। রামায়ণে বাল্মীকি ১৩টি ছন্দ ব্যবহার করেছিলেন। এগুলো হলো-  অনুষ্টুভ্, অপরবক্ত্র, ইন্দ্রবংশা, ইন্দ্রবজ্রা,  উপেন্দ্রবজ্রা, ঔপচ্ছন্দসিক, পুষ্পিতাগ্রা, প্রহর্ষিণ্নী, বংশস্থবিল, বসন্ততিলক, বৈশ্যদেবী, রুচিরা ও সুন্দরী।

৪০০-৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে রচিত কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ মহাভারতের  পাওয়া যায় ১৮টি ছন্দ। এগুলো হলো- এগুলো হলো-  অনুষ্টুভ্, অপরবক্ত্র, ইন্দ্রবংশা, ইন্দ্রবজ্রা,  উপেন্দ্রবজ্রা,  দ্রুতবিলম্বিত, পঞ্চমচামর, , পুষ্পিতাগ্রা, প্রমাণিকা, প্রহর্ষিণ্নী, ভুজঙ্গপ্রয়াত, বংশস্থবিল, বসন্ততিলক, মালিনী, রথোদ্ধতা,  রুচির, শার্দূলবিক্রীড়িত, ও শালিনী।

এরপর সংস্কৃত ভাষায় পুরাণ রচনা শুরু হয়েছিল খ্রিষ্টয় তৃতীয় শতাব্দী থেকে। এই সময়কে সংস্কৃত সাহিত্যের 'পৌরাণিক যুগ' বলা যেতে পারে। ৩০০-৫০০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে রচিত শ্রীমদ্ভাগবতে নতুন ও পুরাতন মিলিয়ে ২৫টি ছন্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলো হলো-  অনুষ্টুভ্, ইন্দিরা, ইন্দ্রবংশা, ইন্দ্রবজ্রা,  উপেন্দ্রবজ্রা,  দ্রুতবিলম্বিত,  নর্দ্দটক,  পুষ্পিতাগ্রা, প্রমাণিকা, প্রহর্ষিণ্নী, ভুজঙ্গপ্রয়াত, বংশস্থবিল, বসন্ততিলক,  মঞ্জুভাষিণী, মন্দাক্রান্তা, মালিনী, মৃগেন্দ্রমুখ, রুচির, শার্দূলবিক্রীড়িত,  শালিনী, শিখরিণী সুন্দরী স্বাগতা, স্রগ্ধরা, ও  স্রগ্বিণী ।

খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর কবি মাঘ রচনা করেছিলেন শিশুপালবধ। রামায়ণ, মহাভারত এবং ভাগবতের প্রায় সকল ছন্দই ব্যবহার করেছিলেন। এসকল ছন্দের বাইরে শিশুপাল অতিরিক্ত ২০টি ছন্দ ব্যবহার করেছিলেন। এগুলো হলো- অতিশায়নী, আর্যাগীতি, উদ্‌গতা, কুটজা, কুররীরুতা, জলধরমালা, জলোদ্ধতগতি, দোধক, পঞ্চকাকলী, পথ্যা, পৃথ্বা, প্রভা, প্রমিতাক্ষরা, বংশপত্রপতিত, বৈতালীয়, ভ্রমরবিলসিত, মত্তময়ূর, মহামালিনী, মেঘবিস্ফূর্জ্জিতা ও হরিণী।

সংস্কৃতি ছন্দের প্রকৃতি
সংস্কৃত ছন্দ দুই প্রকার। প্রকার দুটি হলো- বৃ্ত্ত ছন্দ ও মাত্রা বা জাতি ছন্দ।

প্রাচীন ধ্রুবাগানে সংস্কৃত ছন্দের উপর ভিত্তি করে তাল নিরূপণ করা হতো। যেমন-


সূত্র: