বাঙালি পল্টন
১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ জুলাই থেকে ইউরোপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল এবং এর সমাপ্তি ঘটেছিল ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ১১ নভেম্বরে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে সর্বপ্রথম ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে বাংলা থেকে সৈনিক সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে সিপাহি বিদ্রোহের পর, ভারতীয় সেনাবাহিনীকে নতুনভাবে সাজানোর পরিকল্পনা করে এবং একটি অভিনব তত্ত্ব উপস্থাপন করে। এই তত্ত্বটির নাম ছিল- '
Martial Race Theory।  এই তত্ত্ব অনুসারে এরা শিখ, গুর্খা, পাঞ্জাবি, জাট, মারাঠা ইত্যাদি জাতির লোকেরা সেনা বাহিনীতে স্থান পাবে। এর বাইরে যে সকল অঞ্চলে সিপাহি বিদ্রোহ হয়েছিল এবং যারা সিপাহি বিদ্রোহে সহায়তা করেছিল, তাদের নাম দেওয়া হয়েছিল 'Non-Martial'। অর্থাৎ এরা ছিল আনুগত্যের বিচারে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর অনুপযুক্ত। এই সূত্রে বাঙালিরা ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে স্থান পায় নি।

বাঙালিরা প্রথম থেকেই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। পরে এই প্রতিবাদ সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ভারতেকে স্বাধীন করার জন্য উদ্দীপনায় পরিণত হয়। এই কারণে ব্রিটিশরা বাঙালিদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়াটা সঙ্গত মনে করে নি। তাদের ভয় ছিল, পাছে আবার একটি সিপাহী বিদ্রোহ হয়। এই কারণে ব্রিটিশরা বাঙালি পল্টনকে সুদক্ষ সেনাবাহিনী হিসেবে গড়ে তোলে নি। বরং
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার কিছুদিন পরেই বাঙালি পল্টনকে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল।

ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনীতে বাঙালিদের সৈন্য হিসেবে গ্রহণে অনীহা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে পরিসেবামূলক লোকবল বৃদ্ধির জন্য, শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশরা বাংলা থেকে সৈনিক সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করে। অবশ্য সে সময়ে মহারাজা মাহতাব চাঁদ, মতিলাল ঘোষ, এ কে ফজলুল হক, ডাক্তার (লে, কর্নেল) সর্বাধিকারীদের মতো নেতার ব্রিটিশ বাহিনীদের বাঙালিদের নেওয়ার জন্য প্রবল দাবি জানিয়েছিল। ডাক্তার (লে, কর্নেল) সর্বাধিকারী ছিলেন বেঙ্গল মেডিকেল এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। তিনি গভর্নর লর্ড কারমাইকেলের কাছে একটি বাঙালি মেডিকেল টিম গঠনের দাবি জানান। এই প্রস্তাবে ১৫ জন ডাক্তার, ১৭৫ জন নার্স, কম্পাউন্ডার, ড্রেসার রাখার দাবি করা হয়েছিল।

১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে ইরাকে তুরস্কের কাছে ব্রিটিশ বাহিনী পরাজিত হয়। এই সময় হতাহতদের সহায়তার জন্য ব্রিটিশ মেডিকেল টিম প্রশংসিত হয়। ফলে মেডিকেল টিম গঠনের দাবি জোরাদার হয়ে ওঠে। এছাড়া এই সময় চন্দন নগরে ফ্রান্সের বাহিনীতে বাঙালির যোগদান করা শুরু করেছিল। ফলে ব্রিটিশ বাহিনীতে বাঙালিদের গ্রহণ করার জন্য দাবি উঠতে থাকে।


১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দের ৭ আগস্ট ঢাকায় অনুষ্ঠিত লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সভায় গভর্নর লর্ড কারমাইকেল বাঙালি পল্টন গঠনের সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।

এই সময় বাঙালি নেতারা সেনাসদস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে কোম্পানি সহযোগিতা করেছিলেন এবং এই কারণে  বেঙ্গলি রেজিমেন্ট কমিটি নামে একটি সংস্থা গঠন করেছিলেন। এই সূত্রে কলকাতায় একটি কেন্দ্রীয় অফিস খোলা হয়। এর পাশাপাশি তদানীন্তন বাংলার প্রতিটি জেলা ও বড় মহকুমা সদরে কমিটির শাখা অফিস খোলা হয়েছিল। ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ আগস্ট কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম সেনানিবাসে বেঙ্গলি ডবল কোম্পানির সৈন্য ভর্তি কার্যক্রম চালু হয়। এক্ষেত্রে প্রার্থী বয়স উল্লেখ করা হয় ১৬ থেকে ১৫ বৎসর। এবং সর্বনিম্ন উচ্চতা নির্ধারণ করা হয় ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। এদের মাসিক বেতন নির্ধারণ করা হয় ১১ টাকা।

১২ই সেপ্টেম্বর বেঙ্গলি ডবল কোম্পানির প্রথম দশ জন সৈনিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য কলকাতা থেকে নওশেরা যাত্রা করে। পরবর্তী সময়ে ভর্তি হওয়া সৈনিকরা বিভিন্ন দফায় নওশেরায় পাঠানো হয়। এই সময় নওশেরায় বেঙ্গলি ডবল কোম্পানির প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিল ৪৬ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। বেঙ্গলি ডবল কোম্পানির ২২৮ জন সৈনিক নওশেরায় চার মাস প্রশিক্ষণ শেষে ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে করাচি পৌঁছেছিল।

বেঙ্গলি ডবল কোম্পানির প্রথম রেজিমেন্ট পূর্ণ হলেও বাংলায় সৈন্যভর্তি কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। একই সময়ে করাচিতে ১৬তম রাজপুত, ১০৬ হাজরা এবং ১১৬ মারাঠা রেজিমেন্টের অধীনে ভর্তিকৃত সৈনিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এভাবে বেঙ্গলি ডবল কোম্পানির জনবল বৃদ্ধি করে ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে জুন বাঙালিদের প্রথম ব্যাটালিয়ন গঠন করা হয়। এ সময় বাঙালি পল্টনের নামকরণ হয় ৪৯তম বেঙ্গলি রেজিমেন্ট বা সংক্ষেপে ৪৯তম বেঙ্গলিজ। ৪৯তম বেঙ্গলি রেজিমেন্ট আকারে বড় হয়ে গেলে, এর প্রথম ব্যাটালিয়নকে চারটি কোম্পানিতে ভাগে বিভক্ত হয়। এই ব্যাটেলিয়ানে সৈন্য সংখ্যা ছিল ৮৯৬ জন। এর অধিনায়ক ছিল লে কর্নেল আর্থার।

১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসের মধ্যে মেসোপটেমিয়ার যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য এই ব্যাটেলিয়ানকে তিন ভাগে প্রেরণ করা হয়। এর প্রথম দলটি ৫ জুলাই করাচি ত্যাগ করে এবং বসরা, মাকিনা হয়ে সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি বাগদাদ পৌঁছায়। ব্যাটেলিয়ানের অবশিষ্ট সৈন্যরা আগষ্টের ভিতরে বাগদাদে পৌঁছেছিল।

রেজিমেন্টের বাকি সৈনিকরা করাচিতে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে থাকে। বেঙ্গলিজের এ অংশকে বলা হত 'করাচি ডেপো'। এছাড়া কলকাতাতেও বাঙালি পল্টনের একটি ডেপো ছিল যাকে 'কলকাতা ডেপো' বলা হত। এখানে মূলত ভর্তিকৃত নতুন সৈনিকরা অবস্থান করত। উপরন্তু কিছু সৈনিক করাচি থেকে ছুটিতে আসা-যাওয়ার পথে ও অন্যান্য প্রয়োজনে কলকাতা ডেপোতে অবস্থান করত। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে পূর্ব বাংলায় খুব বেশি সৈনিক ভর্তি হওয়ার ফলে ঐ মাসে সাময়িকভাবে ঢাকাতেও ডেপো চালু করা হয়। এর নাম ছিল 'ঢাকা ডেপো'।

বাগদাদে চলে যাওয়া দলটি, ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করে। বাগদাদ যুদ্ধে এরা অংশগ্রহণ করেছিল। তবে ব্রিটিশ বাহিনী বাগদাদ দখল করলে, বেঙ্গল পল্টনকে বাগদাদের নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত হয়। এই সময় বাঙালি পল্টন বিভিন্ন সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনার নিরাপত্তা দায়িত্ব পালন করে। বাগদাদে অবস্থানের শেষের দিকে অসুস্থ হয়ে ৬৩ জন বাঙালি সৈন্য মৃত্যুবরণ করে এবং অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। উল্লেখ্য ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে আগস্ট মাসে মৃত সৈনিকদের সম্মানে কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়।

এ কারণে মার্চের মাঝামাঝি সময়ে, ৪৯তম বেঙ্গলিজকে বাগদাদ থেকে আজিজিয়া এবং কূত-এ পাঠানো হয়। সেখানে অবস্থানকালে সৈনিকদের স্বাস্থ্যগত অবস্থার বিশেষ উন্নতি না হওয়ায়, অক্টোবর মাসের শেষের দিকে কূত থেকে এদেরকে বসরার সন্নিকটে তানুমাতে পাঠানো হয়। তানুমা, কূত ও আজিজিয়া অবস্থানকালে বেঙ্গলিজ মুলত বিভিন্ন নিরাপত্তা দায়িত্ব পালন করে এবং এর পাশাপাশি সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে।

১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ১১ নভেম্বর মাসে যুদ্ধ বিরতি ঘোষিত হয়। এরপর তানুমাতে বাঙালি পল্টন যুদ্ধ পরবর্তী পুনর্বাসন দায়িত্ব পালন করে। এই সময় ২৫০ জন্ সৈনিককে ছুটি দেওয়া হয়েছিল। এই সময় কিছু কিছু সৈনিককে বাগদাদসহ অন্যান্য স্থানেও নিয়োগ করা হয়। মেসোপটেমিয়ার যুদ্ধ সমাপ্তির পর, ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে কুর্দিস্থানে বিদ্রোহ দেখা দেয়। এ বিদ্রোহ দমনে বাঙালি ব্যাটালিয়নের ২৩৫ জন সৈনিক অংশগ্রহণ করেন। বাঙালি পল্টন জুন মাসের মাঝামাঝি কুর্দিস্থানের উদ্দেশ্যে তানুমা ত্যাগ করে এবং অপারেশন শেষে সেপ্টেম্বর মাসে তানুমা ফিরে আসে। বাঙালি পল্টন ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসের মধ্যে তানুমা ত্যাগ করে করাচিতে আসে এবং সেখান থেকে কলকাতায় ফিরে আসে। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে আগস্ট বাঙালি পল্টন তথা ৪৯তম বেঙ্গলি রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হয়।

কিছু সৈনিক ও বাঙালি অফিসার মেসোপটেমিয়ায় অবস্থানকালে প্রশংসনীয় কাজের জন্য বিভিন্ন খেতাব ও স্বীকৃতি লাভ করেন। এ স্বীকৃতি সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হয়এবং ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে লন্ডনে ভিক্টরি মার্চ ও পিস সেলিব্রেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে সৈনিক ও অফিসাররা অংশগ্রহণ করেন। এই সময় ৪৯তম বেঙ্গলি রেজিমেন্ট থেকে একজন ব্রিটিশ ও একজন ভারতীয় অফিসার এবং দু'জন সৈনিক অংশগ্রহণ করেছিলেন।

বাঙালি পল্টনের সৈনিকদের ভিতরে যাঁরা নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়, তাঁরা হলেন- -সুবেদার মেজর শৈলেন্দ্রনাথ বসু, সুবেদার মেজর কুমার অধিক্রম মজুমদার, জমাদার নওয়াব খাজা হাবিবুল্লাহ, জমাদার রণদাপ্রসাদ সাহা, হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম, সৈনিক মাহবুব-উল-আলম প্রমুখ।