এই আইন প্রণীত হওয়ার পিছনে রয়েছে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া
কোম্পানি'র বঙ্গদেশের অধীকার লাভের ইতিহাস। এই আইনটি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া
কোম্পানি'র উপবেনিশিক শাসন ব্যবস্থা চালু রাখার ক্ষেত্রে একটি সুদূর প্রসারী ভাবনা
কাজ করেছিল।
ঐতিহাসিকদের মতে ১৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দে মোগল
সম্রাট ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বঙ্গদেশে বাণিজ্যিক সুবিধা প্রদান করে। ১৬৫৮ সালে
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন প্রতিনিধি হিসেবে জেমস হার্ট ঢাকা প্রবেশ করার মধ্য
দিয়ে বাংলায় ইংরেজ আগমন শুরু হয়। এই বৎসরেই বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার বাণিজ্যিক
কেন্দ্র হিসেবে মাদ্রাজকে সুসংহত করে। বঙ্গদেশে কোম্পানির ব্যাপক
বিস্তারের কারণে, ১৬৮১ খ্রিষ্টাব্দে, কোম্পানি বেঙ্গল এজেন্সি (Bengal
Agency নামে নতুন
প্রশাসনিক কার্যক্রম চালু করার উদ্যোগ নেয়। ১৬৮৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ আগষ্ট বেঙ্গল
এজেন্সির গভর্নর, জন বিড মৃত্যুবরণ করলে, নতুন গভর্নর হন জব চার্নক
এইভাবে কোম্পানি বঙ্গদেশে ধীরে ধীরে ইংরেজরা শক্তিশালী হয়ে উঠে। ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা নবাব সিরাজউদ্দৌলা'র সাথে ইংরেজদের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। এরপর নবাবের সৈন্যরা ইংরেজদের কাসিমবাজার কুঠি দখল করে। ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ১৬ই জুন নবাবের সৈন্যরা কলকাতা আক্রমণ করে এবং ২০ জুন কোলকাতা দখল করতে সক্ষম হয়। এরপর লর্ড ক্লাইভ এবং ওয়াটসন তামিল নাড়ু থেকে কলকাতা পুনরুদ্ধারের জন্য অগ্রসর হয়। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুন ইংরেজদের সাথে নবাবের যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে নবাবের কতিপয় সেনাপতিদের বিশ্বাসঘাতকতায় ইংরেজরা জয় লাভ করে। ১৭৬৫ খ্রিষ্টব্দের ১লা আগষ্ট দিল্লির বাদশাহ শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা-বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি লাভ করেন। এর ফলে বিহার-ওড়িশার প্রকৃত শাসন ক্ষমতা লাভ করে, নবাবের নামে মাত্র অস্তিত্ব থাকে। পূর্ব ভারতের এই অঞ্চলে যে শাসন-ব্যবস্থা চালু হয় তা দ্বৈত শাসন নামে পরিচিত। নবাবের হাতে থাকে প্রশাসনিক দায়িত্ব, আর রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের পূর্ণ কর্তৃত্ব পায় কোম্পানি। এই সূত্রে কলকাতা কোম্পানির প্রশাসনিক কেন্দ্রে পরিণত হয়।
১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে (বাংলা ১১৭৬) বাংলাদেশে অনাবৃষ্টি হয়। ফলে বাংলাদেশে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। ইতিহাসে একে বলা হয় ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। এই মন্বন্তরে ১৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বঙ্গদেশে বিপুল পরিমাণ লোক মৃত্যুবরণ করে। ফলে ক্লাইভ এবং কোম্পানির কার্যকলাপ নিয়ে পার্লামেন্ট আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠে। এর ফলে ভারতে কোম্পানির কার্যলাপকে নতুন আইনের অধীনের ঢেলে সাজানোর বিষয় উঠে আসে। কোম্পানির পরিচালক সভার নির্দেশের (২৮ আগস্ট ১৭৭১) আওতায় কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ম কাউন্সিল প্রশাসনের ক্ষেত্রে নিজেকেই সুবা বাংলার জন্য সর্বোচ্চ সরকার ঘোষণা করে।
১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে কোম্পানির আঞ্চলিক বিষয়াদি প্রশাসনের জন্য কলকাতায় রাজস্ব কমিটি নামে এক কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়। এ কমিটির প্রেসিডেন্ট হন গভর্নর এবং বাংলার ফোর্ট উইলিয়মের প্রেসিডেন্ট ওয়ারেন হেস্টিংস। ওয়ারেন হেস্টিংস ঘোষণা করেন যে, ক্লাইভের দেওয়ানি ও নিজামত দ্বৈত-প্রশাসন ব্যবস্থা পুনরায় চালু করেন। এবং এই বিষয়ে ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে কয়েক দফা ইস্তাহার জারি করা হয়। এসব ইস্তাহার অনুসারে, রাজস্ব চাষিদের প্রকাশ্য নিলামে পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য জমি ইজারা দেওয়া হয়। এ পাঁচসালা বন্দোবস্ত কার্যকরী করার জন্য, দায়িত্ব দেওয়া হয় গভর্নর ও কাউন্সিলের চার সদস্যের নেতৃত্বে এক সার্কিট কমিটির উপর। এ কমিটির অতিরিক্ত দায়িত্ব ছিল ইজারাদারদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করা। দেশীয় জেলা কর্মকর্তাদের ভিতর ফৌজদার, কানুনগো আর আমিলদের স্থলে, কালেক্টর বা রাজস্ব আদায়ের জন্য ব্রিটিশ অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয়।
এই পাঁচসালা রাজস্ব
বন্দোবস্তের অধীনে, রাজস্ব নিলামদাররা অত্যুচ্চ হারে খাজনা আদায় করতে থাকে। ফলে
অনেক রায়ত জমি ছেড়ে পালিয়ে যায়। অনেক সময় এর ইংরেজ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ পেশ
করে এবং বহু জায়গায় রায়তরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। কিন্তু কোম্পানির প্রশাসনিক
সামর্থ্য ছিল না। ফলে ইজারদাররা এর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছিল। অবশেষে কোম্পানি
পাঁচশালা বন্দোবস্তের ত্রুটি অনুধাবন ধরতে সক্ষম হয়। এই অবস্থায় ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে
পাঁচশালা বন্দোবস্ত শেষ হওয়ার পর, রাজস্ব আদায়ের সর্বোত্তম পদ্ধতি নিয়ে
কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আলোচনা করতে থাকেন।
অবশেষে ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৮শে মার্চ অনুষ্ঠিত এক সভায় কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য
রিচার্ড বারওয়েল জমিদারদের দীর্ঘমেয়াদে ভূমি বন্দোবস্ত দানের প্রস্তাব করেন। ১৭৭৬
খ্রিষ্টাব্দের ২২শে জানুয়ারি কাউন্সিলের আরেক সদস্য ফিলিপ ফ্রান্সিস এর চূড়ান্ত
রূপ দেন। তাঁর এই তত্ত্বটকে বলা হয় ‘চিরস্থায়ী ভূমি রাজস্ব পরিকল্পনা ১৭৭৬’ । তিনি
বিশেষভাবে তাঁর তত্ত্বে বলেন, জমিদাররাই জমির মালিক। অতএব তাদেরকে
চিরস্থায়িভাবে জমির বন্দোবস্ত দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। জমিদারদের সাথে ভূমি বন্দোবস্তের
ব্যাপারে ওয়ারেন হেস্টিংস বারওয়েলকে সমর্থন দেন। পাঁচসালা বন্দোবস্ত ব্যবস্থার
অবসানের প্রাক্কালে, ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দে ২৪শে ডিসেম্বর কোম্পানির পরিচালকরা একটি
সভায় মিলিত হন। সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়. যে, নিলামে জমি ইজারা দানের রীতি পরিহার
করে কেবল জমিদারদের জমির স্বল্পমেয়াদি বন্দোবস্ত দিতে হবে। এই সভায় ভূমি
বন্দোবস্তের লক্ষ্যে জমির সম্পদ সঠিকভাবে নিরূপণের জন্য প্রয়োজনীয় জরিপ পরিচালনা
করতে কাউন্সিলকে পরামর্শ দেওয়া হয়। কাউন্সিল ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে ও পরবর্তী তিন বছরের
জন্য বার্ষিক ভিত্তিতে জমিদারদের সঙ্গে প্রাথমিকভাবে ভূমি বন্দোবস্তের সিদ্ধান্ত
নেয়। এই নতুন ব্যবস্থাতেও রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি না পেয়ে কমে যেতে থাকে।
১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা সরকারকে অনতিবিলম্বে রাজস্ব নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ করা এবং সরকার ও জমিদার উভয় তরফের জন্য সুবিধাজনক শর্তের আওতায় জমিদারদের সাথে রাজস্ব প্রশ্নে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পাদনের নির্দেশ দেওয়া হয়। এই সময় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পাদনের জন্য স্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে, ১৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ ভূস্বামী শ্রেণির অন্যতম সদস্য লর্ড কর্নওয়ালিসকে গভর্নর জেনারেল করে পাঠানো হয়। এক্ষেত্রে তিনি এবং তাঁর রাজস্ব উপদেষ্টা জন শোরের (রাজস্ব বোর্ডের সভাপতি ও কাউন্সিল সদস্য) মধ্যে প্রবল বিরোধিতার সৃষ্টি হয়। শোর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ধারণার বিরোধী না করেই, যুক্তি দেখান যে, অনতিবিলম্বে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করার মতো যথেষ্ট তথ্য তাদের হাতে নেই। তিনি এই আইন চালু করার জন্য দুই বা তিন বছর সময়ের প্রয়োজন আছে বলে তাঁর প্রস্তাবে উল্লেখ করেন। পক্ষান্তরে, কর্নওয়ালিস যুক্তি দেন যে, গত বিশ বছরে সংগৃহীত তথ্যই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পাদনের জন্য যথেষ্ট এবং কোনো এক বা একাধিক তরফের বেলায় কোনো ত্রুটি ধরা পড়লে, সেগুলি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সু-প্রভাবে অচিরেই দূর হয়ে যাবে।
কর্নওয়ালিস ও শোর তাদের নিজ নিজ অভিমত এবং এতদ্সংক্রান্ত যাবতীয় দলিলপত্র, কোম্পানির পরিচালক সভার কাছে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। তবে এরা দুজনই একমত হন যে, কাউন্সিলের অনুমতির জন্য বসে না থেকে দশশালা বন্দোবস্ত চালু করা হোক এবং ১৭৯০ থেকে কার্যকর হবে। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে দশশালা ব্যবস্থা চালু হয়ে যায়। ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শ মার্চ লর্ড কর্নওয়ালিস ঘোষণা করেন যে, দশশালা বন্দোবস্তের মেয়াদ অতিক্রান্ত হওয়ার পর, জমিদাররা তাদের নিজ নিজ জমিদারির নির্ধারিত রাজস্বের রদবদল করা হবে না। এছাড়া, তাদের ওয়ারিশ ও আইনগতভাবে অন্যান্য উত্তরাধিকারীদেরকে এ পরিমাণ প্রদেয় রাজস্বের ভিত্তিতে চিরস্থায়িভাবে তালুকের ভোগদখল করার অনুমতি দেওয়া হবে (ইস্তাহার অনুচ্ছেদ ৩, ধারা ৪, প্রবিধান ১, ১৭৯৩)।
সূত্র :
বাংলা বিশ্বকোষ। প্রথম খণ্ড। নওরোজ কিতাবিস্তান। ডিসেম্বর, ১৯৭২।
http://en.wikipedia.org/wiki/Anti-Comintern_Pact