মাকামে ইব্রাহিম
কাবাঘরের পাশে অবস্থিত একটি বর্গাকৃতির পাথর। একটি লোহার বেষ্টনীর ভেতর একটি ক্রিস্টালের বাক্সের ভিতর এই পাথরটি রাখা আছে। পাথরটির দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা সমান, প্রায় ১৮ ইঞ্চি। আরবি মাকাম শব্দের একটি অর্থ হচ্ছে দাঁড়ানোর স্থান। কথিত আছে অর্থাৎ হজরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর দাঁড়ানোর স্থান ছিল এই পথরটি। এই পাথরে দাঁড়িয়ে তিনি কি করতেন, তা নিয়ে মতভেদ আছে। এগুলোর মধ্যে বহুল প্রচলিত গল্পটি হলো, কাবা শরিফের দেয়ালের উঁচু অংশ নির্মাণের সময় তিনি এর উপর দাঁড়িয়ে কাজ করতেন। পাথরের মাঝখানে একজোড়া পায়ের ছাপ আছে। ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা বিশ্বাস করেন, হজরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর অলৌকিক স্পর্শের কারণে শক্ত পাথরটি ভিজে তাতে তাঁর পায়ের দাগ বসে যায়। আগে এই পাথরট অন্যত্র ছিল। হযরত উমর (রাঃ)-এর সময় পাথরটিকে সরিয়ে বর্তমান জায়গায় বসানো হয়।
হজরে আসওয়াদ
পবিত্র কৃষ্ণপাথর (হজরে আসওয়াত) |
এটি একটি কালো রঙের পাথর বিশেষ। আরবের মক্কা নগরীতে অবস্থিত কাবাঘরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে, তাওয়াফের জায়গা থেকে দেড় মিটার উঁচুতে রাখা। এই পাথরটি স্থাপিত আছে। এর আভিধানিক অর্থ কালো পাথর। মুসলমানদের কাছে এটি অতি মূল্যবান ও পবিত্র পাথর হিসাবে স্বীকৃত। হজের সময় তাওয়াফ (কাবা শরিফ সাতবার চক্কর দেওয়া) শুরুর স্থান হিসাবে এই পাথরটি নির্ধারিত চিহ্ন হিসাবে নির্দেশিত হয়। প্রতিবার চক্করের সময় হাজির এতে চুম্বন করেন। ভিড়ের কারণে চুম্বন করতে না পারলে চুম্বনের ইশারা করার বিধান আছে। হাজিরা ফ্রেমের ভিতর মুখ ঢুকিয়ে হাজরে আসওয়াদে চুম্বন করতে হয়। এর পাশে ২৪ ঘণ্টাই থাকে সৌদি পুলিশ। তাঁরা খেয়াল রাখেন, ফ্রেমে মাথা ঢোকাতে বা চুম্বন করতে কারও যেন কষ্ট না হয়। হাজরে আসওয়াদে চুম্বনের জন্য নারীরাও দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন। কাবা শরিফে বিভিন্ন ওয়াক্তের নামাজ আদায় করতে গিয়ে দেখা যায়, ফরজ নামাজ চলাকালে হাজরে আসওয়াদে কেউ চুম্বন করতে পারেন না।
একবার
কাবার পুনর্নির্মাণের পর
হাজরে আসওয়াদকে আগের জায়গায় কে বসাবেন— এ নিয়ে কুরাইশদের বিভিন্ন গোত্রের
মধ্যে দ্বন্দ্ব বেধেছিল। মুহম্মদ (সাঃ) নিজের গায়ের চাদর খুলে তাতে পাথরটি
রেখে সব গোত্রপ্রধানকে চাদর ধরে তা স্থানান্তরের বিধান দিয়ে বড় ধরনের
সংঘাতের হাত থেকে আরববাসীদের রক্ষা করেন।
ঐতিহাসিকেদের মতে, আগে এটি একটি আস্ত পাথর ছিল। হজরত আবদুল্লাহ বিন
জোবায়েরের শাসনামলে (৭৫৬
সালে)
কাবাঘরে আগুন লাগলে
পাথরটি টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আবদুল্লাহ বিন জোবায়ের পরে ভাঙা টুকরোগুলো
রুপার ফ্রেমে বাঁধিয়ে দেন। ফ্রেম সংস্করণের সময় চুনের ভেতর কয়েকটি টুকরো
ঢুকে যায়। বর্তমানে হাজরে আসওয়াদের আটটি টুকরো দেখা যায়। এগুলোর আকৃতি
বিভিন্ন রকম। এর ভিতরে বড় টুকরোটি খেজুরের সমান।
৯৩০ সালে বাহরাইনের
নেতা আবু তাহের আল কারমাতি এই পাথরটি চুরি করে নিয়ে যায়। ইনি তাঁর স্থাপিত
'মাসজিদ আল দিরার'-এ এই পাথরটি স্থাপন করেন। ৯৫২ সালে আব্বাসীয় বংশীয়
নেতারা বিপুল টাকার বিনিময়ে পাথরটি মক্কায় ফিরিয়ে আনেন।
এই পাথরটির প্রকৃতি, কাবায় স্থাপন, চুম্বন প্রথা নিয়ে নানাবিধ গল্প প্রচলিত
আছে। যেমন-
আদম(আঃ) বেহেস্তে থেকে নির্বাসিত হওয়ার সময় তিনি সাথে করে এই পাথরটি এনেছিলেন। হযরত নুহ(আঃ) -এর প্লাবনের সময় পাথরটিকে ফেরেস্তা জীবরাইল(আঃ) আবু কায়েস পাহাড়ে সংরক্ষণ করে রাখেন এবং পরে কাবা শরীফ নির্মাণের সময় এনে দেন।
তাওয়াফ শুরু করার জায়গা চিহ্নিত করার জন্যই এই পাথর রাখা হয়েছে।
হযরত ইব্রাহিম (আঃ) কাবাঘর পুনঃতৈরি সমাপ্তির পর একটি পাথর ঘরের কাজে না লেগে অবশিষ্ট থেকে যায়। এ অবশিষ্ট পাথরটি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছেন,"হে আল্লাহ, আমি কি অপরাধ করেছি যে আমার সঙ্গী-সাথীরা তোমার ঘরে স্থান পেয়েছে কেবলমাত্র আমি তা থেকে বঞ্চিত হলাম"। আল্লাহ পাথরটিকে কাবা ঘরের এক কোণে স্থাপন করার নির্দেশ দেন এবং তাওয়াফকারীদের চুম্বন বাধ্য করে নির্দেশ দেন। এভাবেই কাবাঘরের মধ্যে যেসব পাথর স্থান পেয়েছিল এ পাথরের মর্যাদা তাদের সমতুল্য রাখা হয়।
হযরত মুহম্মদ(সাঃ) এই পাথরকে চুম্বন করেছিলেন বলে, হজে সরাসরি বা ইশারা চুম্বন করা হয়। হযরত উমর(রাঃ) এই পাথর সম্পর্কে বলেছেন-"আমি জানি, তুমি একখানা পাথর, তোমার উপকার ও ক্ষতিসাধন করার কোনো ক্ষমতা নেই। রাসুলুল্লাহ (সাঃ)কে তোমার গায়ে চুম্বন করতে না দেখতাম, তাহলে আমি কখনো তোমাকে চুমু দিতাম না"
অনেকে মনে করেন এটি ব্যাসাল্ট, এগেট, বা কাঁচের তৈরি। বিজ্ঞানমনষ্ক লোকদের ধারণা 'রুব আল খালী' মরুতে ৬০০০ বছর পূর্বে পতিত একটি পাথুরে মহাকাশীয় খণ্ড থেকে এই পাথর সংগ্রহ করা হয়েছিল।