ইলুমিনাতি
ইংরেজি:
Illuminati
বিভিন্ন
আসল বা নকল গুপ্ত সংগঠনের সামগ্রিক
নাম। তবে ঐতিহাসিকভাবে ইলুমিনাতি বলতে ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১লা মে জার্মানির
বাভারিয়াতে প্রতিষ্ঠিত গুপ্তসংগঠনকেই বুঝানো হয়ে থাকে। এই
সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল- সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাস দূরীকরণের মাধ্যমে
মানুষকে সত্যাশ্রয়ী জ্ঞানের আলোর পথে চালিত করা। এই
সংগঠনের সদস্যরা মনে করতেন যে, কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাসের মূলে রয়েছে প্রথাগত
বিশ্বাস এবং ধর্মান্ধ পুরোহিতদের প্রচারণা। এদের দ্বারা প্রভাবিত রাষ্ট্রযন্ত্র
সমাজকে অকল্যাণকর অন্ধকার জগতের দিকে ধাবিত করে। এদের প্রবল
প্রভাবের কারণে প্রকাশ্যে এদের বিরুদ্ধে
প্রচারণা বা অন্যান্য গণ-সচেতনামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা যায় না।
এই অজ্ঞানতার অন্ধকারে থাকা মানুষকে সত্যাশ্রয়ী জ্ঞানের আলোকে
আলোকিত করার জন্য এই গুপ্ত সংগঠনটি
গড়ে উঠেছিল। এই কারণে, এই সংগঠনের নাম
দেওয়া হয়েছিল, Illuminati
। উল্লেখ্য, ল্যাটিন
illuminatus
শব্দের অর্থ হলো- আলোকিতকরণ। জার্মানির বাভারিয়া এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে,
একে অনেক সময় বাভারিয়ান ইলুমিনাতি নামে অভিহত করা হয়।
বাভারিয়ান ইলুমিনাতি'র প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন চার্চ-বিধি এবং ব্যবহারিক দর্শনের
অধ্যাপক এডাম ওয়েশাউপ্ট
(Adam Weishaupt (1748–1830)
। তিনি অধ্যাপনা করতেন
University of Ingolstadt
তে
। এই
বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালিত হতো রোমের ক্যাথলিক চার্চের অধীনস্থ
Society of Jesus
-এর দ্বারা। ১৭৭৩
খ্রিষ্টাব্দে পোপ ক্লেমেন্ট চতুর্দশ এই সংগঠন আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করে দিলেও,
নিজেদের মতো করে এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালু রাখতে পেরেছিল। ফলে এই
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রটেষ্টন্ট খ্রিষ্টান এবং উদারপন্থী শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের
আনাগোনার পথ সুগম হয়েছিল। এই কারণে গোঁড়া ক্যাথলিক না হ্ওয়ার পর, এডাম এই
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের পদ লাভ করেছিলেন। এই সূত্রে তিনি ধর্মীয় কুসংস্কারের
বিরোধিতা করার সাহস পেয়েছিলেন।
এই সময় একই ভাবনা দ্বারা পরিচালিত হতো ফ্রিম্যাসোন্রি(Freemasonry)
নামক একটি গুপ্ত সংঘ ছিল। প্রথমে
এডাম এই সংঘের সাথে যুক্ত হওয়ার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু
দুটি কারণে তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। এর একটি হলো
এদের সাথে তাল মিলিয়ে চলার মতো, তাঁর যথেষ্ট আর্থিক সামর্থ্য ছিল না।
দ্বিতীয় কারণ ছিল-
মতাদর্শের বিচারেও এদের সাথে ততটা মিল ছিল না। তাই এডাম নিজেই একটি পৃথক সংগঠন তৈরি করলেন।
প্রথমে এই সংগঠনের তিনি নাম রেখেছিলেন-
“Bund der Perfektibilisten” (Covenant of Perfectibility)। এই নামটি উচ্চারণের বিচারে বেশ খটমটে ছিল। তাই ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১লা মে,
তিনি যখন এই দলটি সাংগঠনিক রূপ দিলেন তার নাম দিলেন ইলুমিনাতি।
গুপ্ত সংগঠন বলে, তিনি নিজের নাম পাল্টে ছদ্মনাম রাখলেন স্পার্টাকাস
(Spartacus)।
এছাড়া তিনি তাঁর অপর চার ছাত্রের নাম পাল্টে ছদ্মনাম দিলেন।
এই চার ছাত্রের প্রকৃত নাম
Massenhausen. Bauhof, Merz, Sutor-এর পরিবর্তে ছদ্মনাম দিলেন যথাক্রমে
Ajax, Agathon, Tiberius, Erasmus Roterodamus।
পরে অবশ্য দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে তিনি Sutor
-কে দল থেকে বহিষ্কার করেছিলেন।
তিনি এই গুপ্তসংগঠনের জন্য নির্বাচন করেছিলেন আউল অফ এ্যাথেনা'
(এথেনা'র
প্যাঁচা) প্রতীক।
শুরুর দিকে ওয়েশাউপ্ট তাঁর ৪ জন ছাত্রের মাধ্যমে তাঁর মতাদর্শ প্রচার শুরু করেন। মাসেনহাউসেন
(ছদ্ম নাম এ্যাজাক্স) সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রচারকার্যে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
ইলুমিনাতি'র বিধিমালা তৈরি হওয়ার পর, কিছুদিন মিউনিখে লেখাপড়ার জন্য যান। এই সময়
তিনি মিউনিখে ব্যাপকভাবে সংগঠনের কাজে দক্ষতা দেখাতে সক্ষম হন। ফলে এডামের
আস্থাভাজন শিষ্যে পরিণত হন। তবে এক সময় মাসেনহাউসেন
কর্মে অবহেলা করার জন্য, সদ্য দলে যোগ দেওয়া এডামের পুরানো ছাত্র
Xavier von Zwack
মিউনিখের প্রচারণার দায়িত্ব দেন।
ইতিমধ্যে মাসেনহাউসেন
গ্রাজুয়েট এবং পোষ্ট গ্র্যাজুয়েট শেষ করে আবার দলে পূর্ণ সদস্য হিসেবে ফিরে আসেন।
১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে এডাম তাঁর সংগঠনের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি এবং
ক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেন। এই সময় তিনি
Rite of Strict Observance
নামক মেশনরি দলের সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলেন।
এই সময় প্রাচীন ধর্মীয় গুপ্তমন্ত্রের বিষয় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এসকল প্রক্রিয়ার ভিতর
দিয়ে ইলুমিনাইতে তাত্ত্বিক জ্ঞানের বিকাশ ঘটেছিল, কিন্তু সদস্য সংখ্যা ততটা বৃদ্ধি
পায়নি।
১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দের শুরুর দিকে দলের সদস্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল মাত্র ১২ জন। এই বছরের শেষে দলের
সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছিল ২৭ জন।
শুরুর দিকে সদস্যদের তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছিল। এই ভাগ তিনটি ভাগ ছিল-
- শ্রেণি ১ শিক্ষানবীশ : সদ্য যোগ দেওয়া সদস্য।
- শ্রেণি-২ মিনার্ভাল: পুরোনো অধিকতর সক্রিয় সদস্য। এই শ্রেণির সদস্যদের ছিল
গোপন সঙ্কেত ও প্রতীক
- শ্রেণি-৩ আলোকিত মিনার্ভাল: সদস্যদের ভিতরে যারা গোপনীয় জ্ঞানের অধিকারী ছিল।
এই দলের সদস্য হিসেবে নেওয়া হতো- ১৮-৩০ বৎসর বয়সী সচ্চরিত্র খ্রিস্টানদের। ইহুদি ও মূর্তিপূজকরা এই দলে স্থান পেতো না। এ ছাড়া নারী,
ধর্মযাজক এবং ধনী ব্যক্তিদের দলে নেওয়া হতো না। ফলে মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত খ্রিষ্টান যুবকরাই এই দলে স্থান পেতো। ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দের শেষে মোট সদস্য
দাঁড়িয়েছিল ৬৫০ জন।
যথেষ্ট গোপনীয়তা রক্ষা করা সত্ত্বেও এক সময়, এই সংগঠনের নাম ছড়িয়ে পরতে লাগলো। এরা
চরমভাবে অসাম্প্রদায়িক হওয়ার কারণে- এরা নাস্তিক নামে অভিহিত হয়েছিল। ফলে ধীরে ধীরে
জনরোষ বাড়তে থাকলো। ফলে বাভারিয়ার শাসক চার্লস থিওডোর ভয় পেলেন যে, ভবিষ্যতে এদের
প্রতিরোধের জন্য গণবিপ্লবের সৃষ্টি হতে পারে। তাই তিনি ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দের ২রা মার্চ,
এই দলকে গুপ্তসংঘ হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। এডাম ওয়েশাউপ্টের বিরুদ্ধে
গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির কারণে, তিনি পালিয়ে গেলেন। সরকার ইলুমিনাতির প্রচুর নথিপত্র
বাজেয়াপ্ত করেছিল। ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে সরকার ইলুমিনাতি'র এ সকল গোপন নথিপত্র প্রকাশ করে দিয়েছিল।
মূলত এরপর থেক মূল ইলুমিনাতি হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কিছু কিছু গুপ্ত সংগঠন
নিজেদেরকে ইলুমিনাতি নামে প্রচার করেছিল। ইউরোপ আমেরিকার অনেক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের
পিছনে ইলুমিনাতিদের হাত আছে বলে দাবি করা হয়ে থাকে। যদিও অনেক এই সংগঠনের মূল
মন্ত্র ছিল নিজেদেরকে গোপন রাখা। কিন্তু কোনো কোনো সংগঠন তাদের পরিচয় গোপন রাখার
পরিবর্তে প্রচার করে থাকে। এদের কারো কারো ওয়েব সাইট পর্যন্ত আছে।
সূত্র :
- Richard van Dülmen, The Society of Enlightenment (Polity Press 1992) p.
110
- Introvigne, Massimo (2005). “Angels & Demons from the Book to the Movie
FAQ – Do the Illuminati Really Exist?”. Center for Studies on New Religions.
Archived from the original on 28 January 2011. Retrieved 27 January 2011.
- McKeown, Trevor W. (16 February 2009). “A Bavarian Illuminati Primer”.
Grand Lodge of British Columbia and Yukon A.F. & A.M. Archived from the
original on 28 January 2011. Retrieved 27 January 2011.
- The Illuminati: Facts & Fiction Paperback – Print, April 13, 2009 by
Mark Dice
- Inside the Illuminati: Evidence, Objectives, and Methods of Operation
Paperback – October 31, 2014 by Mark Dice