কঙ্গেলি ধারার লাইহারাবাউবা নৃত্য |
লাইহারাউবা
মণিপুরী নৃত্য
মণিপুরী নৃত্যশেলীর একটি প্রাচীন ধারা।
মণিপুরের সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। এই
নৃত্যকে মণিপুরের সুপ্রাচীন নৃত্যধারা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি মূলত
একটি নৃত্য-উৎসব হিসেবে মণিপুরে পালিত হয়।
মণিপুরি লাই শব্দের অর্থ হলো−
দেবতা, হারাউবা' শব্দের অর্থ হলো−
আনন্দ-নৃত্য। মণিপুরে বৈষ্ণব ধর্ম প্রাধান্যলাভের আগে, শৈবমতের ব্যাপক প্রভাব ছিল।
দেবতা শিবের প্রতীক হিসেবে 'লাই' ছিল শিবলিঙ্গের প্রতীক। ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে
মণিপুর শৈব এবং বৈষ্ণব ধর্মের সহাবস্থানে একটি শান্তির জনপদে পরিণত হয়েছিল।
১৭০৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পামহৈবা মণিপুরের রাজত্ব লাভের পর বৈষ্ণবদের আধিপত্য
প্রবলতর হয়ে মণিপুরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। কারণ, রামানন্দীর ভাবদর্শের বিশ্বাসী
বৈষ্ণব সাধক শান্তি দাস অধিকারীর অনুপ্রেরণায় রাজা পামহৈবা বৈষ্ণব মত গ্রহণ করেন।
এরপর তিনি তাঁর মতকে একরকম জোর করেই মণিপুরে প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে এই অঞ্চলে
শৈবমতাদর্শের লোকের একরকম কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এই সময় রাজা পামহৈবা অন্যান্য মতের
গ্রন্থাদি ও নিদর্শন ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে মণিপুরের ইতিহাসও ধ্বংস হয়ে যায়।
মণিপুরের বৈষ্ণবরাও দেবতা হিসাবে শিবকে শ্রদ্ধা এবং পূজা করতো। ফলে প্রবল বৈষ্ণব
আধিপত্যের যুগেও শিব-পার্বতীর লীলা ভিত্তিক গীত ও নৃত্য বিলুপ্ত হয়ে যায় নি। ফলে
'লাইহারাউবা'- নৃত্য মর্যাদা হারাতে হারাতে প্রায় বিলুপ্তির পথে চলে যায়। রাজা চন্দ্রকীর্তি সিংহাসনে ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে
সিংহাসনে বাসার পর তিনি এই নাচকে আবার প্রচলন করেন।
বর্তমানে লাইহারাউবা নৃত্য দুই ভাবধারায় পরিবেশিত হয়। এই ভাবধারা দুটি হলো মৈরাঙ
লাইহারাউবা ও উমঙ লাইহারাউবা। এই দুটি ধারাতেই পরিবশিত হয় নানা ধরনের কাহিনি নির্ভর
নৃত্যগীত। এর ভিতরে খাম্বাথৈবী, নঙ্পক্নিঙ্থুপানথেবী, থনজিঙ লাইরেম্বী
উল্লেখযোগ্য। এই নাচে তাণ্ডব ও লাস্য উভয় ধারাই ব্যবহৃত হয়। এই নৃত্য শৈব
নৃত্যধারার হলেও, এতে পরবর্তী সময়ে
রাসনৃত্যের ভঙ্গীপারেঙ-এর প্রভাব পড়ে
ব্যাপকভাবে।
এই
নৃত্যধারার সাথে জড়িয়ে আছে, মণিপুরের সনাতন ধর্মে বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্ব। মণিপুরের
লোক পুরাণ মতে- নয়জন লাইবুঙথ (দেবতা) এবং সাতজন লাইনুরা (দেবী) পৃথিবী সৃষ্টি
করেছিলেন। আদিতে পৃথিবী জলমগ্ন ছিল, আর সেই জলের উপর সাতজন লাইনুরা নৃত্য করছিলেন।
এই দৃশ্য দেখে নয়জন লাইবুঙথ স্বর্গ থেকে লাইনুরাদের লক্ষ্য করে মাটি নিক্ষেপ করতে
থাকেন। নৃত্যরতা সাতজন লাইনুরা সেই ছুঁড়ে দেওয়া মাটির উপর নেচে নেচে পৃথিবীর
স্থলভাগ তৈরি করেন। এই ভাবনা থেকে লাইহারাউবা নৃত্যের সূচনা হয় 'লাইএকাউবা'।
এই নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন কিছু দেবদাস এবং দেবদাসী। উল্লেখ্য, মণিপুরে দেবতাদের
সেবায় যে পুরুষরা সারাজীবন নিজেদেরকে উৎসর্গ করেন, তাদের বলা হয় মৈবা (দেবদাস)।
একইভাবে যে নারীরা দেবতাদের সেবায় সারাজীবন নিজেদেরকে উৎসর্গ করেন, তাদের বলা হয়
মৈবী (দেবদাসী)।
লাইহারাউবা নৃত্যের অংশসমূহ :
লাইএকাউবা : এটি লাইহারউবা নাচের প্রারম্ভিক অংশ। এই গ্রামের প্রধান ব্যক্তিবর্গ, পুরোহিত এবং মৈবা-মৈবীরা নিকটস্থ কোনো জলাশয়ের ধারে গিয়ে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে দৈবশক্তির কাছে প্রার্থনা করেন।
লাইথেম্বা : এই অংশে মৈবা এবং মৈবীরা সাদা পোশাক পড়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই সময় এদের কারো কারো উপর দৈব শক্তি ভর করেছে, এমন ভাবনা থেকে মোহগ্রস্থ হয়ে অল্প পানিতে তাঁরা নৃত্য করতে থাকেন।
লাইকাবা: এই অংশে এরা ধরে নেয় দৈব শক্তি তাদের সঙ্গে রয়েছে। এই অবস্থায় এঁরা শোভাযাত্রা করে গ্রামে ফিরে আসেন। এই সময় এঁরা দৈবশক্তির প্রতীক হিসেবে দুটি মাটির কলসী নিয়ে আসেন।
লাইহুম্বা: এই অংশে নয়জন মৈবা সমবেতভাবে সাতজন মৈবীকে জাগ্রত করার চেষ্টা করেন। এঁরা মনে করেন যে, এই অনুষ্ঠান চলাকালে চারজন দেবতা (মারজিঙ, থানকিঙ, কোউব্রু এবং ওয়াঙবারেন) এদের রক্ষা করেন এবং এই অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।
জগোই ওক্পা : এই পর্যায়ে দুইজন মৈবী গ্রামবাসীদের সামনে ঢিমালয়ের ছন্দে দেববন্দনামূলক নৃত্য করেন। এই নাচে মুষ্ঠি, হংসাস্য ও অর্ধচন্দ্র মুদ্রাসহ বিভিন্ন করণ ও অঙ্গহার ব্যবহার করা হয়।
লাইপৌ : এই পর্যায়ে মৈবীরা
নৃত্যসহযোগে দেবতার জন্ম অংশের অভিনয় করেন এবং দেবতার জন্মের পর গৃহ নির্মাণের
অভিনয় করেন। এই গৃহটিকে মৈবীরা দেবতাদের উৎসর্গ করেন। এরপর শিবের অবতার
'নঙপকনিঙথ' গৃহ থেকে বেরিয়ে আসেন এবং পার্বতীর অংশ 'পানথৈরী'র সাথে মিলিত হয়ে
শৃঙ্গার নৃত্যে অংশ নেন। এরপর এঁরা তুলা চাষ, সুতা উৎপাদন, বস্ত্রবয়নের অভিনয়
করেন। এই বস্ত্রও দেবতাদের উৎসর্গ করা হয়। মূলত এরই ভিতর দেইয়ে লাইহারাউবা নৃত্যের
প্রাথমিক উৎসবের সমাপ্তি হয়।
লাইহারউবা নৃত্য-উৎসবের অংশ হিসেবে পরের কয়েকদিন ধরে চলে মৎসশিকার পর্ব। এই
পর্বের শেষে কল্পিত নৌকায় চড়ে দেবতারা স্বর্গে চলে যান।
মণিপুরের অঞ্চলভেদে নানা ধরনের লাইহারউবা নৃত্য-উৎসব হয়। তবে প্রধান ধারা হিসেবে বিবেচনা করা হয় ছয়টি ধারাকে। এই ধারাগুলো হলো− কঙ্গেলি হারাউবা, চাকপা হারাউবা, অন্ড্রো হারাউবা, সেকমাই হারাউবা, মৈরাং হারাউবা এবং কাকচিঙ হারাউবা।
মণিপুরের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাম্বা-থৈবীর লোক-কাহিনি অবলম্বনে লাইহারউবা নৃত্য-উৎসব হয়ে
থাকে। মণিপুরীরা এই কাহিনীকে জাতীয় উপাখ্যান হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন।
খাম্বা থৈবী উপাখ্যান
মণিপুরের রাজা লায়াম্বার রাজত্বকালে (১১২৭-৫৪ খ্রিষ্টাব্দ), রাজধানী ইম্ফল থেকে
প্রায় ত্রিশ মাইল দূরে, মৈরাঙ নামক এক গ্রামে খাম্বা নামক এক দরিদ্র এবং সাহসী যুবক
বাস করতেন। মৈরাঙ রাজবংশের থৈবী নামক এক রাজকন্যা একবার লোগতাক হ্রদে তাঁর সহচরীদের
নিয়ে মৎস্যশিকারে যান। রাজার আদেশে ওই স্থানে কোনো পুরুষ লোকের প্রবেশ নিষেধ ছিল।
খাম্বা প্রভু থানজিং কর্তৃক স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে ওই সময়ে লোগতাক হ্রদে যান।
সেখানে রাজকন্যা থৈবীর সাথে খাম্বা দেখা হয় এবং উভয় উভয়কে দেখে মুগ্ধ হন এবং
প্রণয়াসক্ত হন। সামাজিক বৈষম্যের কারণে উভয়ের বিবাহ প্রায় অসম্ভব ছিল। প্রথম
দিকে রাজরোষে বহুবার তাঁর জীবন বিপন্ন হয়। থৈবীকেও কিছুদিন দাসীবৃত্তি করতে হয়। শেষ
পর্যন্ত রাজা উভয়ের বিবাহে সম্মতি দেন। বিবহের কিছুদিন পর, খাম্বা থেবীকে সন্দেহ
করা শুরু করে। তৎকালীন মণিপুরের রীতি অনুসারে সতী পরীক্ষার রীতি ছিল। কোনো বিবাহিত
নারীর ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে অন্য কোন পুরুষ বর্শার অগ্রভাগ প্রবেশ করালে, ওই নারী
যদি বর্শাটি টেনে ঘরের ভিতর রাখে, তবে ওই নারীকে অসৎ বিবেচনা করা হবে। আর ওই
স্ত্রীলোক যদি বর্শা গ্রহণ করে, সজোরে ঘরের বাইরে নিক্ষেপ করে, তবে সে সতী বিবেচিত
হবে।
খাম্বা এই পরীক্ষার জন্য থৈবীকে দূরের গ্রামে যাবে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
রাত্রিবেলা খাম্বা ফিরে এসে থৈবীর ঘরের দরজা দিয়ে বর্শার অগ্রভাগ প্রবেশ করিয়ে
অপেক্ষা করতে থাকেন। থৈবী এই বর্শা নিয়ে সজোরে বাইরে নিক্ষেপ করলে, ওই বর্শা
খাম্বার বুকে বিদ্ধ হয় এবং ওই আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়। ঘরের বাইরে এসে থৈবী এই দৃশ্য
দেখে, ওই বর্শা নিজের বুকে বিদ্ধ করে আত্মহত্যা করেন। এই করুণ কাহিনী অবলম্বনে
মৈরাঙ গ্রামে প্রতিবৎসর লাইহারাউবা নৃত্য-আলেখ্য অনুষ্ঠিত হয়। মণিপুরের এই অঞ্চলের
মানুষ খাম্বা এবং থৈবীকে শিব-পার্বতীর অংশ হিসেবে পূজা করে।
সূত্র :
ভারতের নৃত্যকলা । গায়ত্রী বসু। নবপত্র প্রকাশন। নভেম্বর ১৯৮৯।