মণিপুরী নৃত্য
ভারতীয় চিরায়ত নৃত্যশেলীর একটি অন্যতম ধারা।
ভারতের পূর্বাঞ্চলের ভারত-মায়ানমার সীমান্তে অবস্থিত মণিপুর রাজ্যে বিকশিত একটি
স্বতন্ত্র
নৃত্যশৈলী মণিপুরী নৃত্য নামে পরিচিত। এই নৃত্যশৈলীর নানান ধারার সমষ্টিগত নাম মণিপূরী নর্তন বা
'মৈতৈ জগোই'। উল্লেখ্য
মনিপুরী ‘ইমার ঠার’ শব্দের অর্থ হলো‒
মায়ের ভাষা {ইমার (মায়ের) ঠার (ভাষা)}। এই ভাষার লোকেরা নিজেদেরকে মণিপুরী নামে
অভিহিত করে থাকেন। পক্ষান্তরে প্রাচীন মণিপুরের রাজধানী বিষ্ণুপুরের ভাষা হিসাবে এর
নাম হয়েছে বিষ্ণুপ্রিয়া। এর দুটি আঞ্চলিক রূপ রয়েছে। এই দুটি রূপ হলো‒
রাজার গাঙ এবং মাদাই গাঙ।
মণিপুরী নাচের পৌরাণিক কথন
পুরাণ এবং মণিপুরের উপকথা অনুসারে জানা যায়, শ্রীকৃষ্ণ একবার রাধাকে নিয়ে একটি
রাসলীলা'র (রাধাকৃষ্ণের নৃত্যলীলা) ব্যবস্থা করেন। মহাদেব এই লীলা দেখার আগ্রহ প্রকাশ
করলে, কৃষ্ণ তাঁকে রাসলীলাস্থলের দ্বার রক্ষক হয়ে এই লীলা উপভোগের অনুমতি দেন।
মহাদেব যথারীতি দ্বাররক্ষক হয়েই এই লীলা উপভোগ করতে করতে তাঁর দ্বাররক্ষার কর্তব্য
ভুলে যান। এই সময়, পার্বতী সেখানে উপস্থিত হন। মোহিত মহাদেবকে ফাঁকি দিয়ে, পার্বতী
এই লীলা উপভোগ করেন। এই অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর, পার্বতী নিজেদের জন্য একটি রাসলীলার
আয়োজন করার জন্য মহাদেবের কাছে আবদার করেন। মহাদেব তাতে সম্মত হয়ে রাসলীলার উপযোগী
স্থান নির্বাচন করার জন্য সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ালেন। কিন্তু উপযুক্ত স্থান পেলেন
না। অবশেষে তিনি ঘুরতে ঘুরতে মণিপুর
রাজ্যে এলেন। এখানকার কোউব্রু পর্বত (কুমার পর্বত)-কে এই নাচের জন্য উপযুক্ত
স্থান মনে করেলন। কিন্তু পাহাড়, জলাভূমি মিলিয়ে এই স্থানটি রাসলীলার উপযুক্ত ছিল
না। তাই তিনি এই স্থানকে রাসলীলার উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য− সূর্য,
চন্দ্র এবং পাঁচটি গ্রহকে আহ্বান করলেন। মণিপুরী ভাষায় এদের নাম হলো−
নোঙমাইজিঙ (সূর্য), নিঙ্থোউকাবা (চন্দ্র), লেইপাক্পোকু (মঙ্গল), য়ুম-সাইকে-সা
(বুধ), সাগোলসেল (বৃহস্পতি), ইরাই (শুক্র) এবং খাঙ্জা (শনি)। রাসলীলার ক্ষেত্র
নির্মাণের সময় দেখা গেল, কুমারপর্বতের পাদদেশ জলমগ্ন। মহাদেব এই স্থানকে জলশুন্য
এবং রাসক্ষেত্রে উপযোগী পরিচ্ছন্ন স্থানে পরিণত করার জন্য কৃষ্ণকে অনুরোধ করেন।
কৃষ্ণ এই কাজের জন্য ১০জন দেবতার নিয়োগ করেলন। এঁরা হলেন−
হওবা শোরারেল (ইন্দ্র),
মারজিঙ (কুবের), রাঙব্রেল (যম), খোরিকাবা (বরুণ), ইরুমলাকপা (বায়ু), নোঙসাবা ও
কোঙবা-মেইরোম্বা।
এদের সমবেত চেষ্টায় রাসলীলার ক্ষেত্র তৈরি হলে, এই স্থানে সাতদিন সাতরাত শিব-পার্বতীর রাসলীলা অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানের সঙ্গীত সহযোগী ছিলেন গন্ধর্ব এবং অন্যান্য দেবতারা। রাত্রিবেলার অনুষ্ঠানের জন্য নাগরাজ অনন্তদেব তাঁর মাথার মণি দান করেন। নাগদেবের মণির নামানুসারে এই স্থানের নাম হয় মণিপুর। কথিত আছে, রাসলীলা শেষে দেবতারা মণিপুরকে একটি জনপদের মর্যাদা দেন এবং এই অঞ্চলের প্রথম রাজা হন অনন্তদেব। এই থেকে মণিপুরে নৃত্যগীতের সূচনা হয়।
এই
কাহিনি অনুসারে মনে হয়, রাসলীলা বা রাস নৃত্যই মণিপুরের আদি নৃত্য।
রাসনৃত্যের পূর্ণ রূপ পাওয়ার আগেই আরও কিছু নৃত্যগীতের সন্ধান পাওয়া যায়। এসকল
নৃত্যের সাথেও মণিপুরের লোকগাঁথা জড়িয়ে আছে। কালক্রমে এই সব লোক
উপাখ্যানগুলোও মণিপুরী নাচের মতই চিরায়ত কাহিনীতে পরিণত হয়েছে। এরূপ একটি
উপখ্যান থেকে সৃষ্টি হয়েছে
লাইহারাউবা নৃত্য।
১৭০৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পামহৈবা মণিপুরের রাজত্ব লাভের পর বৈষ্ণবদের আধিপত্য
প্রবলতর হয়ে মণিপুরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। কারণ, রামানন্দীর ভাবদর্শের বিশ্বাসী
বৈষ্ণব সাধক শান্তি দাস অধিকারীর অনুপ্রেরণায় রাজা পামহৈবা বৈষ্ণব মত গ্রহণ করেন।
এরপর তিনি তাঁর মতকে একরকম জোর করেই মণিপুরে প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে এই অঞ্চলে
শৈবমতাদর্শের লোকের একরকম কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এই সময় রাজা পামহৈবা অন্যান্য মতের
গ্রন্থাদি ও নিদর্শন ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে মণিপুরের ইতিহাসও ধ্বংস হয়ে যায়।
মণিপুরের বৈষ্ণবরাও দেবতা হিসাবে শিবকে শ্রদ্ধা এবং পূজা করতো। ফলে প্রবল বৈষ্ণব
আধিপত্যের যুগেও শিব-পার্বতীর লীলা ভিত্তিক
গীত ও নৃত্য বিলুপ্ত হয়ে যায় নি। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার কারণে 'লাইহারাউবা নৃত্য মর্যাদা হারাতে হারাতে প্রায়
বিলুপ্তির পথে চলে যায়।
১৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দে রাজা চিঙ্থাঙ খম্বা বা ভাগ্যচন্দ্র সিংহের শাসনামলে মণিপুরের নৃত্যগীতের চরম উৎকর্ষতায় পৌঁছায়। তারই চেষ্টায় মণিপুরে রাসনৃত্যের প্রবর্তন হয়। কথিত আছে, রাজা স্বপ্নে রাসলীলা করার আদেশ পেয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ স্বপ্নের ভিতর তাঁকে জানান যে, রাজকন্যা বিম্ববতীমঞ্জরীকে রাধা সাজিয়ে শ্রীকৃষ্ণের মূর্তিমণ্ডলীর ভিতরে রেখে নৃত্যলীলা করতে হবে। রাজা তাঁর কন্যাকে রাস নৃত্য শিখিয়ে, স্বপ্নের আদেশ পালন করেন। কালক্রমে এই নৃত্য রাসনৃত্য নামে মণিপুরে ছড়িয়ে পড়ে। তবে এই কাহিনির সাথে কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাবে তার আমলে রাস নৃত্য সমস্ত মণিপুরকে আপ্লুত করেছিল। শৈবযুগে রাসনৃত্য পৃথক নৃত্য শৈলী হিসেবে বিকশিত না হলেও− তালরাস, দণ্ডরাস এবং মণ্ডলরাসে প্রচলন ছিল। নৃত্য-গীতযুক্ত অভিনয় অংশ নিয়ে রাসের যে নানা পর্ব, রাজা ভাগ্যচন্দ্রই তা সাজিয়েছিলেন। তিনি রাসের মহারাস, বসন্তরাস, কুঞ্জরাস ও ভঙ্গীপারেঙ প্রবর্তন করেন। শুধু তাই নয়, রাসনৃত্য বিষয়ক তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'গোবিন্দ সঙ্গীত লীলাবিলাস'-কে রাসনৃত্যের আদি পুস্তক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই গ্রন্থে নাট্যকে রূপক (প্রাচীন নাট্য) ও রাসক (নৃত্যনাট্য) পর্যায়ে বর্ণনা করেছেন। আগে রাসলীলায় গান, নাচ এবং অভিনয় ছিল। কিন্তু সুসমন্বয়ে তা গ্রথিত ছিল না। তিনি এই গ্রন্থের রাসক অধ্যায়ে রাসনৃত্যের বিভিন্ন আঙ্গিক ও পদ্ধতি লিপিবদ্ধ করেন। এই গ্রন্থানুসারে রাসনৃত্যকে ৫টি পর্যায়ে ভাগ করেন। এই ভাগগুলো হলো− মহারাসক, মঞ্জুরাসক, নিত্যরাসক, নির্বেশরাসক ও গোপরাসক। বর্তমানে এই রাসকগুলো মহারাস, বসন্তরাস, নিত্যরাস, কুঞ্জরাস, গোপরাস বা গোষ্ঠরাস এবং উলুখল রাস নামে পরিচিত। রাজ ভাগ্যচন্দ্রের পৌত্র চন্দ্রকীর্তি সিংহাসনে আরোহণ করেন ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে। তাঁর সময়ে রাসনৃত্য আরও সমৃদ্ধতর হয়ে উঠে। তিনি প্রথম নর্তনরাসের প্রবর্তন করেন। এছাড়া প্রায় বিলুপ্ত -'লাইহারাউবা নৃত্যকে তিনি মর্যাদার আসনে বসাতে সমর্থ হন।
ভাগ্যচন্দ্র এবং চন্দ্রকীর্তির পরবর্তী সময়ে নিয়মিত চর্চার ভিতর দিয়ে লাইহারাউবা এবং রাসনৃত্য আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠে। কালক্রমে জয়দেব, বিদ্যাপতী, চণ্ডীদাসের বৈষ্ণব পদাকর্তাদের প্রভাব পড়ে রাসলীলার বাণী অংশে। অন্যদিকে বাংলার কীর্তন প্রভাব পড়ে এর সুরে। বর্তমানে রাসনৃত্য শৃঙ্গার, রসসম্ভূত, বিপ্রলম্ভ ও সম্ভোগ অংশের লীলায় সুর ও বাণীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
মণিপুরী নাচের বৈশিষ্ট্য
লাইহারাউবা নৃত্য বা রাসনৃত্য-এর উপস্থাপনের বিষয় যাই হোক, নাচের ভঙ্গী প্রায় একই। এই নাচে নাট্য, নৃত্য এবং নৃত্তের প্রয়োগ হয় সমানভাবে। এতে লাস্য ও তাণ্ডব নৃত্য রয়েছে, তবে তাতে ভাব এবং বিভাব সমভাবে প্রকাশ পায়। এই নাচে আঙ্গিকাভিনয় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এই নাচে দেহ ভঙ্গিমাকে নানা ধরণের জ্যামিতিক অবয়বে ফুটিয়ে তোলা হয় বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে। এই নাচে ভক্তিরস প্রবল। এমনকি শৃঙ্গার রসের ভিতরে অপূর্ব সংযম লক্ষ্য করা যায়, যা ভক্তিরসকেই উজ্জীবিত করে।
এই নৃত্যশৈলীতে একক দেহভঙ্গিমাকে বলা হয় ভঙ্গী আর বিভিন্ন ভঙ্গীর সমষ্টিগত রূপ হলো ভঙ্গিপারেঙ। মণিপুরী নৃত্যশৈলীতে চারপ্রকার ভঙ্গী ব্যবহৃত হয়। এগুলো হলো−
সমভঙ্গ: এই ভঙ্গীতে দেহ সোজা ও স্থিতিশীল অবস্থায় থাকে। মেরুদণ্ড সোজা করে এই ভঙ্গীতে চাঞ্চল্য নেই।
আভঙ্গ: এই ভঙ্গীতে মেরুদণ্ড নমনীয় ও সক্রীয় রেখে অঙ্গভঙ্গী করা হয়। ফলে নানারূপ দেহভঙ্গিমা ফুটে উঠে।
ত্রিভঙ্গ: এই ভঙ্গীটি লাস্যভাব ফুটে উঠে। ক্ষিপ্র গতিতে নানারূপ দেহভঙ্গীমা ফুটিয়ে তোলা হয়। বংশীধারী শ্রীকৃষ্ণের ভঙ্গিমা এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
অতিভঙ্গ: এই ভঙ্গীতে তাণ্ডবভাব প্রকট হয়ে ধরা পড়ে। উদ্দাম নৃত্যের মধ্য দিয়ে দেহের নানা রূপ ভঙ্গিমা ফুটিয়ে তোলা হয়।
এই চারটি ভঙ্গীর সমন্বয়ে মিশ্রণে ভঙ্গিপারেঙ গঠিত হয়। মণিপুরী নাচে পাঁচটি পর্যায়ে ভঙ্গিপারেঙ ব্যবহার করা। লাস্য এই এবং তাণ্ডবভাবের বিচারে ভঙ্গিপারেঙ দুটি পর্যায়ে বিভক্ত। যেমন-
ভঙ্গিপারেঙ লাস্য: এই ভঙ্গিপারেঙ-এ দুটি ভঙ্গিমা ব্যবহৃত হয়। ভঙ্গিমা দুটি হলো− সীমিতাঙ্গ ও স্ফুরিতাঙ্গ।
ভঙ্গপারেঙ তাণ্ডব: এই ভঙ্গিপারেঙ-এ তিনটি ভঙ্গিমা ব্যবহৃত হয়। ভঙ্গিমা তিনটি হলো− গুণ্ঠন, চলন এবং প্রসরণ।
ভঙ্গিপারেঙ পাঁচ প্রকার। এই প্রকারগুলো হলো- অছুবা, খুড়ুম্বা, বৃন্দাবন, গোষ্ঠ ও গোষ্ঠ বৃন্দাবন।
মণিপুরী নৃত্যে নৃত্য সংগঠনে অন্যতম অঙ্গকে চালি বলা হয়। পদ, জঙ্ঘা, উরু ও কটিদেশ
একই সরল রেখায় রেখে নৃত্য পরিবেশনের কৌশলকে চালি বলা হয়।
মণিপুরী নৃত্যে বাদ্যযন্ত্র
মণিপুরী নৃত্যে তালযন্ত্র একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। এর ভিতরে আনদ্ধ
যন্ত্র হলো- পুঙ, ইয়াবুঙ, হারাপুঙ, তানইবুঙ, নাগনা, খোল, ঢোলক, দফত, খঞ্জরী,
পাখোয়াজ ও ঢোল। ঘনবাদ্যের ভিতরে আছে সেমবুঙ, ঝালারি, মঙগঙ, জাল, করতাল, রমতাল
ইত্যাদি। তত যন্ত্রের মধ্যে রয়েছে পেনা, এস্রাজ, তানপুরা। সুষি-যন্ত্রের মধ্যে
রয়েছে বাঁশি, ময়বুঙ, পেরে ও খঙ।
মণিপুরী নৃত্যে ব্যবহৃত তালিসমূহ:
মণিপুরী নৃত্যে নানাবিধ তাল এবং তার লয়ের প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। এর ভিতরে
উল্লেখযোগ্য তালগুলো হলো তাণ্চেপ, মেনকুপ, রূপক, দশকোশ, তিনতাল দশকোশ, তিনতাল মাচা,
তেবড়া, রাজমেল, দুতাল, অছুবা, যাত্রা রূপক, তিনতাল অছৌবা, তিনতাল মেল, ভঙ্গদাস,
গাজন, মদন, মৈতৈ, সুরফাঁক, ঝাঁপ, রাস, চারতাল। চার মাত্রা থেকে আটষট্টি মাত্রা
পর্যন্ত বিভিন্ন ভাগে অলঙ্কার পুংলোন বা প্রস্তর ছন্দিত হয়। অনেক সময় দুই বা
ততোধিক তালের সমন্বয়ে এবং নৃত্যালঙ্কার প্রয়োগে তাল প্রবন্ধ ও নৃত্য প্রবন্ধ গঠিত
হয়।
মণিপুরী নৃত্যের পোশাক
কথিত আছে, রাজ ভাগ্যচন্দ্র স্বপ্নাদেশের মাধ্যমে রাসনৃত্যের পোশাকের নির্দেশ পেয়েছিলেন। এই পোশাকের অন্যতম হলো জড়ি জড়ানো মাথার চূড়া। মুখের উপর পাতলা জালের মতো সাদা কাপড়ের আবরণ। একে বলা হয় মাইখুম। ঘন সবুজ ভেলভেটের ব্লাউজ বা রেশমী ফিরুৎ। চুমকি খচিত সবুজ শার্টিনের পেটিকোট। পোশাকের নিম্নভাগে পিতলের তবকমোড়া বিভিন্ গোলাকার আয়না সমান্তরালভাবে বাসন থাকে। নিম্নভাগে কাপড়ের ভিতর বেত দিয়ে শক্ত করা থাকে। এই পোশাককে কুমিন বলা হয়। উপরের দিকে থাকে রুপোলি কাজ করা আয়না বসানো সাদা স্বচ্ছ ঘাঘরা। এই ঘাঘরাকে বলা হয় পেশোয়ান। কাঁধের উপর থাকে পাশে ঝোলানো কাপড়। একে বলা হয় খাওন। এর নিম্নভাগে থাকে সোনালী ও রূপালী কাজ করা। অর্ধচন্দ্রাকর, গোল চৌকা কাঁচ বসানো মখমলের বেল্ট ব্যবহৃত হয়। একে বলা হয় খানপ।
এই নাচের সময় তাল, তানথাক, তাংখা, রতনচূড়, অনন্ত, সেনাখুজি, খুড়পা, কুণ্ডলীন, পারেঙ, ঝাপা ইত্যাদি অলঙ্কার থাকে। লাইহারবা নৃত্যে ফনেক নামক পোশাক ব্যবহার করা হয়। ফনেক-এর পাড়ে পদ্মফুল, ও মৌমাছির নকশা থাকে। ফনেকের মাঝখানে লাল ও কালো রঙের সারি থাকে। এর ভিতরে কাল রাত্রির এবং লাল প্রভাতের প্রতীক।
মণিপুরী নৃত্যের প্রচার
মণিপুরের এই ঐতিহ্যবাহী নৃত্যকে বিশ্ব-দরবারে তুলে আনেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
তিনি সিলেট, কাছাড় এবং আগরতলা ভ্রমণের সময় এই নাচ দেখে মুগ্ধ হন। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে
তিনি নবকুমার সিংহ নামক একজন মণিপুরী নৃত্যের শিক্ষককে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসেন।
পরে নবকুমার সিংহের পরিচালনায় নটীর পূজা এবং ঋতুরঙ্গ মণিপুরী নৃত্যশৈলীতে মঞ্চস্থ
হয়। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ সিনারিক সিং রাজকুমার এবং নীলেশ্বর মুখার্জিকে
মণিপুরী নাচের শিক্ষক হিসেবে শান্তিনিকেতনে আনেন। এই নৃত্যশৈলী অনুসারে শ্যামা,
চিত্রাঙ্গদা এবং চণ্ডালিকা-র নৃত্যরূপ দেওয়া হয়। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের
অনুরোধে শান্তিনকেতনে আসেন নৃত্যগুরু আতম্বা সিং। শান্তিনিকেতনের সূত্রে মণিপূরী
নাচ ক্রমান্বয়ে ভারতীয় চিরায়ত সঙ্গীতের অন্যান্য ধারার পাশে স্থান করে নিয়েছে।
সূত্র :
ভারতের নৃত্যকলা । গায়ত্রী বসু। নবপত্র প্রকাশন। নভেম্বর ১৯৮৯।