আখড়াই
সপ্তদশ দশকে নবদ্বীপ অঞ্চলের বিকশিত এক প্রকার গান। বৈষ্ণবদের আখড়ায় এই গানের আসর বসতো। এই সূত্রে এই গান আখড়াই নামে পরিচিতি লাভ করেছিল।

এর উদ্ভব ঘটেছিল অবিভক্ত বাংলার নদীয়া জেলার নবদ্বীপ-শান্তিপুর অঞ্চলে। প্রথমদিকে এই গান ছিল ভদ্রসন্তানদের বৈঠকি গান। এই গানের বিষয় ছিল কৃষ্ণ-লীলার সাথে নানা বিষয়। এই গানগুলো পদাবলী কীর্তনের আঙ্গিকে পরিবেশিত হতো। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে মহারাজ নবকৃষ্ণ দেবের সভাগায়ক কলুইচন্দ্র সেন কৃষ্ণ-লীলার বিষয় থেকে বেড়িয়ে এসে ভিন্নতর প্রেম ও ভক্তিমূলক আখড়াই গানের সূচনা করেন। ধীরে ধীরে এই গান উচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়।

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এই গানে কুরুচিপূর্ণ শব্দ এবং বাক্যের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। সে সময় এই গান দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এই ভাগ দুটিকে বলা হতো- খেউড় ও প্রভাতী। তবে এর আগে অনেক সময় ভবানীবিষয়ক গান পরিবেশিত হতো।
এই গান পরিবেশিত হতো দুই দলের কবিয়ালদের প্রতিযোগিতামূলক গান। এর প্রকৃতি ছিল কবি গানের মতো উত্তর-প্রত্যুত্তরের ভঙ্গিতে। পরে তা পরিবর্তিত হয়ে বিবাদের ভঙ্গিতে পরিণত হয়েছিল। এই সূত্রে যুক্ত হয়েছিল অশীল ভঙ্গী এবং গান। ফলে আখড়াই গান ক্রমে ক্রমে ইতরজনের গানে পরিণত হয়। আঠারো শতকের মধ্যভাগে নবদ্বীপ-শান্তিপুর থেকে চুঁচুড়া ও কলকাতা এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল।

এই সময় চুঁচুড়ায় কতিপয় পেশাদার শিল্পী দলীয়ভাবে এ গানকে শৈল্পিক গানে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল। তাঁরা এই গান থেকে অশ্লীল এবং কুরূচিপূর্ণ শব্দ এবং বাক্য পরিহার করা শুরু করেন। সে সময়ে এই গানের সাথে রাগ এবং রাগ-উপস্থাপক সুরযন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। বাদ্যযন্ত্র হিসেবে সে সময়ে ব্যবহৃত হতো‒ তানপুরা, বেহালা, মন্দিরা, ঢোল, মোচং, করতাল, জলতরঙ্গ, বীণা, বাঁশি, সেতার ইত্যাদি। এই গানের সাথে পাঁচ ধরনের ছন্দের তাল ব্যবহৃত হতো। এই ছন্দ এবং তার লয়কে বলা হতো‒ পিড়েবন্দী, দোলন, দৌড়, সবদৌড় ও মোড়। বিশেষ করে  তারা বছরে দুইবার কলকাতায় গান পরিবেশন করতেন। যন্ত্র হিসেবে তারা ব্যবহার করতেন হাঁড়ি, কলসিসহ বাইশটি সঙ্গীতোপযোগী যন্ত্র। এই কারণে এদেরকে সে সময় বলা হতো 'বাইসেরা'। গায়ক এবং বাদক মিলিয়ে আখড়াই গানে অংশগ্রহণ করতেন প্রায় ৩০-৩২ জন শিল্পী।

১৮০৪ খ্রিষ্টাব্দে আখড়াই গানের নবতর রূপ দেন নিধুবাবু। এই নবতর আখড়াই গানের ধারা তিনি কলকাতায় প্রচলন করেন। নবতর আখড়াইয়ের দুটি গোষ্ঠী নিধুবাবুর তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কলকাতার শোভাবাজার এবং পাথুরিয়াঘাটা অঞ্চলে। তবে এই দুই গোষ্ঠীর প্রতিযোগিতার সময় নিধুবাবু অংশগ্রহণ করতেন শোভাবাজার গোষ্ঠীর পক্ষে। পাথুরিয়াঘাট গোষ্ঠীর পরিচালনা করতেন শ্রীদাম দাস। পরবর্তী দুই দশক ধরে এই নবতর আখড়াই গান প্রচলিত থাকলেও ক্রমে ক্রমে তা নিষ্প্রভ হয়ে যায়। নিধুবাবুর বারধ্যক্যের কারণে এবং উপযুক্ত পরিচালকের অভাবে নবতর আখড়াই গান গৌরব হারনো শুরু করে। এরই মধ্যে নিধুবাবুর প্রধান শিষ্য মোহনচাঁদ বসু হাফ আখড়াই গানের প্রচলন করেন। নিধুবাবু প্রথম দিকে হাফ আখড়াই গানের প্রতি বিরক্ত হয়েছিলেন, তবু শিষ্যের এই প্রচেষ্টাকে আশীর্বাদ জানিয়েছিলেন।