নিধুবাবু
(১৭৪১-
১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দ)
বাংলা টপ্পা গানের রচয়িতা এবং গায়ক। প্রকৃত নাম রামনিধি গুপ্ত। তাঁর বাংলা টপ্পা গানের সূত্রে, তিনি নিধুবাবু নামে খ্যাত।

নিধুবাবুর পিতা  হরিনারায়ণ গুপ্ত কলকাতার কুমারটুলি অঞ্চলে চিকিৎসক ছিলেন। এই সময় হরিনারায়ণের বড় ভাই লক্ষ্মীনারায়ণও কুমারটুলিতে বাস করতেন। বর্গীর হাঙ্গামা র (১৭৪১-৫০ খ্রিষ্টাব্দ) বহু মানুষ তাঁদের বাস্তুভিটা ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যান। এই সময় হরিনারায়ণ ও লক্ষ্মীনারায়ণ কুমারটুলী থেকে হুগলি জেলার চাপ্তা গ্রামে চলে আসেন। উল্লেখ্য, এই সময় নিধুবাবুর মামা রামজয় কবিরাজ চাপ্তা গ্রামের কবিরাজি করতেন। এই বৎসরেই চাপ্তা গ্রামে মামা বড়িতে নিধুবাবু জন্মগ্রহণ করেন।

নবাব আলীবর্দী খান (১৬৭১-১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দ), মারাঠী বর্গীদের অনেকাংশে দমন করতে সক্ষম হলে, কলকাতা নিরাপদ হয়ে উঠলে, ১৭৪৭ খ্রিষ্টাব্দে (১১৫৪ খ্রিষ্টাব্দ) হরিনারায়ণ ও লক্ষ্মীনারায়ণ আবার কুমারটুলীতে ফিরে আসেন। কলকাতায় আসার আগে গ্রামে নিধুবাবুর শিক্ষার হাতে খড়ি হয়েছিল। কলকাতায় এসে তিনি ফার্সি ও সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা শুরু হয়। এরপর পিতার ইচ্ছায় তিনি কলকাতার এক ইংরেজ শিক্ষকের কাছে কিছুদিন ইংরেজি শেখেন। এই সময় নিধুবাবুর তাঁর দুই বোন  বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠলে, তাঁদের বিবাহ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তাঁর প্রথম বোনের বিবাহ হয়েছিল পাতুরিঘাটার শিবচন্দ্র কবিরাজের সাথে। দ্বিতীয় বোনের বিবাহ হয়েছিল কাঁচড়াপাড়া'র দাতারাম কবিরাজের সাথে। এর কিছুদিন পর তাঁর পিতা হরিনারায়ণের মৃত্যু হয়।

১৭৬১ খ্রিষ্টাব্দে (১১৬৮ বঙ্গাব্দ) তিনি প্রথম বিবাহ করেন। ১৭৬৮ খ্রিষ্টাব্দে (১১৭৫ বঙ্গাব্দে) তাঁর প্রথম সন্তান জন্মগ্রহণ করে।

১৭৭১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেন।

পলাশী যুদ্ধের পর ইংরেজরা বঙ্গদেশের উপর ধীরে ধীরে তাদের রাজত্ব সুদৃঢ় করা শুরু করে। ইংরেজদের নতুন প্রশাসন কার্যক্রম সুদৃঢ় হয়ে ওঠে ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সরকারী রাজস্ব  আদায় বিভাগে চাকরি লাভ করেন। এই বৎসরেই তিনি বিহারের ছাপরা জেলার কালেক্টর অফিসে দ্বিতীয় কেরানি হিসেবে কাজ শুরু করেন।

ছাপরাতে প্রথমে তিনি এক ওস্তাদের কাছে রাগ সঙ্গীতের তালিম নেন। পরে ছাপরা জেলার রতনপুরা গ্রামের ভিখন রামস্বামীর মন্ত্র শিষ্য হন। এই সময় তিনি উত্তরভারতের বিভিন্ন ধরনের গানের সাথে পরিচিত হয়ে উঠেন এবং বিভিন্ন সঙ্গীতশিল্পীদের কাছে রাগ সঙ্গীত শেখেন। এই সময় লক্ষ্ণৌ অঞ্চলে
শোরী মিঞা'র টপ্পা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। বিভিন্ন শিল্পীদের মাধ্যমে সম্ভবত ওই টপ্পার সাথেও তাঁর পরিচয় ঘটেছিল।

কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই এই স্ত্রী এবং সন্তানের মৃত্ হয়। তাদের এই মৃত্যুর কারণ জানা যায় না। এই দুঃখে তিনি একটি গান রচনা করেছিলেন। গানটি হলো 'মনপুর হতে আমার হারায়েছে মন/কাহারে কহিব, কারে দোষ দিব/নিলে কোন্‌ জন।...'

১৭৯১ খ্রিষ্টাব্দে (১১৯৮ বঙ্গাব্দ) তিনি কলকাতায় ফিরে জোড়াসাঁকোতে দ্বিতীয় বিবাহ করেন। এই স্ত্রীর মৃত্যু হলে, ১৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দে (১২০১ বঙ্গাব্দ) তিনি তৃতীয় বিবাহ করেন। এই স্ত্রীর গর্ভে ৪টি পুত্র এবং ২টি কন্যা জন্মগ্রহণ করেছিল।

কলকাতায় ফিরে তিনি শোভাবাজারে একটি আটচালা ঘরে সঙ্গীতের আসর বসানো শুরু করেন। শোভাবাজারের এই ঘরটি ছিল আমেরিকান ক্যাপ্টেন মুচ্ছুদির। এই ঘরে রাত্রিবেলায় নিয়মিত নিধুবাবুর গানের আসর বসতো। এই আসর পরে হতো বাগবাজারের রসিকচাঁদ গোস্বামীর বাড়িতে। এ সকল আসরেই তিনি তাঁর নিজের রচিত বাংলা টপ্পা পরিবেশন করতেন।
 এই সকল আসরের ভিতর দিয়ে রামনিধি গুপ্ত-এর গান হয়ে যায় নিধুবাবুর গান।

নিধুবাবু গান পরিবেশন করতেন তাঁর গানের সুনির্দিষ্ট আসরে। এই আসরের নাম ছিল আখড়া। তিনি কোনো সৌখিন ব্যক্তি বা ধনাঢ্য ব্যক্তির আমন্ত্রণে কোনো বাড়িতে গিয়ে গান করতেন না। তাঁর গান শুনতে হলে, শ্রোতাকে তাঁর আসরে যেতে হতো। এই আসর ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত। এই সময় মুর্শিদাবাদের রাজা মহানন্দ রায় কলকাতায় বসবাস করা শুরু করেন। তাঁর শ্রীমতী নামক এক রক্ষিতা ছিলেন। শ্রীমতীর সাথে তাঁর সুগভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল এই আসরের মাধ্যমে। অনেকে মনে করেন শ্রীমতীর সাথে নিধুবাবুর প্রণয় ছিল। আবার অনেকে মনে করেন তাঁদের সম্পর্ক কখনো দৈহিক সম্পর্কে পরিণত হয় নি।

নিধুবাবুর আসর-ভিত্তিক এই গানের সূত্রে সৃষ্টি হয়েছিল নবতর আখড়াই গানের। ১৮০৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর এই নবতর আখড়াই গান অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য মূল আখড়াই গান সপ্তদশ দশকে নবদ্বীপ অঞ্চলের বিকশিত হয়েছিল। প্রথম পর্যায়ে এই গানের বিষয় ছিল কৃষ্ণ-লীলার সাথে নানা বিষয়। এই গানগুলো পদাবলী কীর্তনের আঙ্গিকে পরিবেশিত হতো। কালক্রমে এই গানে কুরুচিপূর্ণ শব্দ এবং বাক্যের ব্যবহার যুক্ত হতে থাকে। সে সময় এই গান দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এই ভাগ দুটিকে বলা হতো খেউড় ও প্রভাতী। ক্রমেই এ গান শান্তিপুর থেকে চুঁচুড়া ও কলকাতা এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। এর ফলে বিভিন্ন স্থানে এই গানের আঙ্গিক পরিবর্তন ঘটেছিল। এই গান দুই দলে বিভক্ত হয়ে পরিবেশিত হতো। প্রথমাবস্থায় এর প্রকৃতি ছিল কবি গানের মতো উত্তর-প্রত্যুত্তরের ভঙ্গিতে। পরে তা পরিবর্তিত হয়ে বিবাদের ভঙ্গিতে পরিণত হয়েছিল।  আঠার শতকের শেষভাগে মহারাজ নবকৃষ্ণ দেবের সভাগায়ক কলুই চন্দ্র সেন সংস্কারের মাধ্যমে আখড়াই গানকে উচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন। সে সময়ে এই গানের সাথে রাগ এবং রাগ-উপস্থাপক সুরযন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। নিধুবাবু মূলত এই আখড়াই গানকে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেন।

এই নবতর আখড়াই গানের সূত্রে তিনি কলকাতায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। নবতর আখড়াইয়ের দুটি গোষ্ঠী নিধুবাবুর তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কলকাতার শোভাবাজার এবং পাথুরিয়াঘাটা অঞ্চলে। তবে এই দুই গোষ্ঠীর প্রতিযোগিতার সময় নিধুবাবু অংশগ্রহণ করতেন শোভাবাজার গোষ্ঠীর পক্ষে। পাথুরিয়াঘাট গোষ্ঠীর পরিচালন করতেন শ্রীদাম দাস। পরবর্তী দুই দশক ধরে এই নবতর আখড়াই গান প্রচলিত থাকলেও ক্রমে ক্রমে তা নিষ্প্রভ হয়ে যায়। নিধুবাবুর বার্ধক্যে কারণে এবং উপযুক্ত পরিচালকের অভাবে নবতর আখড়াই গান গৌরব হারনো শুরু করে। এরই মধ্যে নিধুবাবুর প্রধান শিষ্য মোহনচাঁদ বসু হাফ আখড়াই গানের প্রচলন করেন। নিধুবাবু প্রথম দিকে হাফ আখড়াই গানের প্রতি বিরক্ত হয়েছিলেন, তবু শিষ্যের এই প্রচেষ্টাকে আশীর্বাদ জানিয়েছিলেন। উল্লেখ্য ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে বড়বাজারের রামসেবক মল্লিকের বাড়িতে সর্বসাধারণের সামনে প্রথম হাফ আখড়াই গানের আসর বসেছিল।

১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে তিনি মাঝে মাঝে যেতেন এবং সেখানকার ব্রাহ্ম-সমাজগৃহে উপস্থিত থাকতেন। কথিত আছে উৎসবানন্দ বিদ্যাবাগীশের অনুরোধে সমাজ-মন্দিরে বসেই তিনি একটি ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করে শোনান। গানটি হলো-
                 
পরমব্রহ্ম ত্বৎপরাৎপর পরমেশ্বর

১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর 'গীতরত্ন' গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে (২১ চৈত্র, ১২৪৫ বঙ্গাব্দ) তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

নিধুবাবুর মৃত্যুর কিছু কুরুচিপূর্ণ টপ্পা তাঁর নামে গাওয়া শুরু হয়। ফলে অচিরেই তাঁর অশালীন বলে কুখ্যাতি লাভ করে। বঙ্কিমচন্দ্র, হরপ্রাসাদ শাস্ত্রী প্রমুখ নিধু বাবুর গানকে অশ্রদ্ধার চোখেই দেখতেন। আরও পরে রবীন্দ্রনাথ, ভগিনী নিবেদিতা, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রমুখ তাঁর গানকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিলেন।

নিধুবাবুর গানের তালিকা


সূত্র: