টপ্পা
উত্তর ভারতীয় সঙ্গীতে অর্ধ-শাস্ত্রীয় সঙ্গীত হিসেবে টপ্পা একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। সংস্কৃত লম্ফ শব্দ রূঢ়ারার্থে হিন্দি ভাষায় হিন্দুস্থানি সঙ্গীত গৃহীত হয়েছিল। এর অর্থ সংক্ষেপ। খেয়াল বা ধ্রুপদের সংক্ষিপ্তরূপ হিসেবে হিন্দিতে 'টপা' শব্দ গৃহীত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এই শব্দটি দাঁড়ায় টপ্পা।

টপ্পার উৎপত্তি কখন এবং কিভাবে শুরু হয়েছিল, তা নিয়ে নানা রকমের গল্প আছে। তবে সবচেয়ে প্রচলিত গল্পটি হলো- পাঞ্জাবের উট চালকদের লোকগান থেকে টপ্পার উৎপত্তি। কিন্তু অনেকেই এই কথা মানতে রাজি নন। তবে আদি টপ্পাতে পাঞ্জাবি ভাষার আধিক্য রয়েছে। এই বিচারে বলা যায়, পাঞ্জাবের লোকগীতি থেকে এই গানের সূত্রপাত ঘটেছিল। হয়তো অন্যান্য পেশার মানুষের সাথে উটচালকরা এই গান গাইতেন। কাপ্তেন উইলার্ভকে উদ্ধৃতিকে অনুসরণ করে রাজ্যেশ্বর মিত্র তাঁর বাংলার গীতিকার ও বাংলা গানের নানা দিক গ্রন্থে টপ্পার উৎস সম্পর্কে লিখেছেন

‘টপ্পা ছিল রাজপুতনার উষ্ট্র চালকদের গীত। শোনা যায়, মধ্যপ্রাচ্য থেকে যেসব বণিক উটের পিঠে চেপে বাণিজ্য করতে আসত, তারা সারারাত নিম্নস্বরে টপ্পার মতো একপ্রকার গান গাইতে গাইতে আসত। তাদের গানের দানাদার তানকেই বলা হতো ‘জমজমা’। আসলে জমজমা শব্দে ‘দলবদ্ধ উষ্ট্র’ বোঝায়। সাধারণভাব উষ্ট্রবিহারিদের গানও এই শব্দের আওতায় এসে গেছে। লাহোরে উট বদল হতো। এই লাহোর থেকেই টপ্পার চলটি ভারতীয় সংগীতে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে।’

টপ্পার জনক হিসেবে শৌরী মিঞা সুবিখ্যাত। শৌরী মিঞার পিতা গোলাম রসুল ছিলেন সুজা-উদ্-দৌল্লার (রাজত্বকাল ১৭৫৩-১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দ) রাজদরবারের সভাগায়ক। উত্তরাধিকার সূত্রে শৌরী মিঞার সঙ্গীত শিক্ষা হয়েছিল পিতার কাছে। কথিত আছে, তাঁর কণ্ঠ পিতার মতো ধ্রুপদ খেয়ালের উপযোগী ছিল না। তাই তিনি রাগাশ্রয়ী চটুল গান করতেন। পাঞ্জাবের লোকগান (উট চালকেদের গান হিসেবে উল্লেখ করা হয়) তিনি পরিবেশন করতেন বিভিন্ন আসরে। পরে তিনি এর সাথে রাগের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নতুন ধরনের সঙ্গীত শৈলী প্রচলন করেছিলেন। তাঁর এই গান ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং টপ্পা নামে পরিচিতি লাভ করে। তিনি পাঞ্জাবি লোকসঙ্গীতের সাথে রাগের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে যে গায়নরীতি প্রচলন করেছিলেন, তিনি তা তৈরি করেছিলেন না কি সংস্কার করেছিলেন, সে সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে তাঁর আগে উৎকৃষ্ট টপ্পার সন্ধান পাওয়া যায় না। এই কারণে তাঁকে টপ্পার জনক বলা হয়।

শৌরী মিঞর টপ্পার জনপ্রিয়তার সূত্রে নবাব সুজা-উদ্-দৌল্লা তাঁকে গান পরিবেশনের জন্য দরবারে আমন্ত্রণ জানান। গান শুনে দরবারের সবাই তাঁর প্রশংসা করেন। নবাব নিজেও তুষ্ট হয়ে, তাঁকে পুরস্কৃত করেন। দরবারের এই কদর তাঁর গানকে ভিন্নতর মর্যদা দান করেছিল।

উল্লেখ্য
শোরী মিঞার মূল নাম গোলাম নবী। তিনি তাঁর রচিত এবং পরিবেশিত গানের ভণিতায় শোরী মিঞা নাম উল্লেখ করতেন। এই কারণে তাঁর গান শোরী মিঞার গান হিসেবে প্রচলিত হয়। অনেকের মতে শোরী মিঞা ছিল গোলাম নবীর অপর নাম। কেউ কেউ এও বলে থাকেন যে, শোরী ছিলেন গোলাম নবীর স্ত্রীর নাম।

উত্তর ভারতে শোরী মিঞার টপ্পা জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। শোরী মিয়ার মৃত্যুর পর, টপ্পাকে অধিকতর জনপ্রিয় করে তোলেন তাঁর শিষ্য গাম্মু মিয়া। গাম্মু মিঞার পুত্র শাদে খাঁ টপ্পা বারানসীতে চর্চা করতেন। পরে ভারতে বিভিন্ন প্রদেশে টপ্পা ছড়িয়ে পড়ে।
 

বাংলা টপ্পা
বাংলা টপ্পার আদি পুরুষ কালী মীর্জা। ১৭৮০-৮১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি উত্তর ভারত থেকে সঙ্গীত শিক্ষা শেষে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে হুগলিতে এসে বসবাস শুরু করেন। এখানেই তিনি বাংলা টপ্পা গানের চর্চা শুরু করেন। কালী মির্জা বারানসীতে টপ্পা শিখেছিলেন গাম্মু বা শাদে খাঁর কোন শিষ্যের কাছ থেকে। তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক ছিলেন। তিনি হিন্দুস্থানী টপ্পার পাশাপাশি বাংলা ভাষায় টপ্পা রচনা করেন এবং গুপ্তি পাড়ায় তাঁর জন্মস্থানে বাংলা টপ্পা শুনিয়ে স্থানীয় গুণিজনদের মুগ্ধ করেন। শেষ জীবনে তিনি কলকাতায় কাটান।

 

তিনি নিধুবাবুর অনেক আগে থেকে বাংলা টপ্পার প্রচলন করেন। উল্লেখ্য, ছাপরা থেকে কলকাতায় ফিরে নিধুবাবু বাংলা টপ্পা শুরু করেন ১৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দে। সময়ের নিরিখে বাংলা টপ্পার আদি পুরুষ বলতে কালী মির্জাকে বিবেচনা করা হয়।

 

বাংলা টপ্পা জলপ্রিয়তা লাভ করেছিল রামনিধি গুপ্ত তথা নিধুবাবু'র সূত্রে। ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সরকারী রাজস্ব আদায় বিভাগে চাকরি লাভ করেন। এই বৎসরেই তিনি বিহারের ছাপরা জেলার কালেক্টর অফিসে দ্বিতীয় কেরানি হিসেবে কাজ শুরু করেন। ছাপরাতে তিনি প্রথম এক ওস্তাদের কাছে রাগ সঙ্গীতের তালিম নেওয়া শুরু করেন। পরে ছাপরা জেলার রতনপুরা গ্রামের ভিখন রামস্বামীর মন্ত্র শিষ্য হন। এই সময় তিনি উত্তরভারতের বিভিন্ন ধরনের গানের সাথে পরিচিত হয়ে উঠেন এবং বিভিন্ন সঙ্গীতশিল্পীদের কাছে রাগ সঙ্গীত শেখেন। এই সময় লক্ষ্ণৌ অঞ্চলে শোরী মিঞা'র টপ্পা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। বিভিন্ন শিল্পীদের মাধ্যমে তিনি সম্ভবত ওই টপ্পার সাথেও তাঁর পরিচয় ঘটেছিল। ১৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ছাপরা থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন। কলকাতায় ফিরে তিনি শোভাবাজারে একটি আটচালা ঘরে একটি নিয়মিত সঙ্গীতের আসর শুরু করেন। প্রতিরাত্রে এই আসরে মূলত নিধুবাবু'র গানই হতো। এই আসরের মাধ্যমেই আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর টপ্পা গানের সূচনা হয়। কিছুদিন পর তিনি শোভাবাজারের আখড়া ত্যাগ করে বাগবাজারের রসিকচাঁদ গোস্বামীর বাড়িতে টপ্পার আসর বসাতে শুরু করেন। এই সকল আসরের ভিতর দিয়ে রামনিধি গুপ্ত-এর গান হয়ে যায় নিধুবাবু'র গান বা নিধুবাবু'র টপ্পা।

নিধুবাবু এবং কালীমির্জা নতুন ধারার কাব্যসঙ্গীতের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন টপ্পার মধ্য দিয়ে। এঁদের অধিকাংশই গানই ছিল চৌপদী অর্থাৎ চার পংক্তির গান। এ সকল গানের বাণী অংশ ব্যঞ্জনাপ্তধান এবং কাব্যিক। এই চারটি পদের ভিতর গানের ভাব এমন ভাবে প্রকাশিত হয়েছে, যা বহু পদের দ্বারা প্রকাশ করা অসম্ভব মনে হয়। এই চৌপদীতে যুক্ত করেছিলেন পাঞ্জাবী টপ্পার জমজমা। বাংলা শব্দ ও ভাবের প্রাধান্য দিতে গিয়ে, তিনি বেশির ভাগ গানে জমজমাগুলোকে তিন থাক বিশিষ্ট মোটা দানার তান যুক্ত করেছিলেন।

 

দুর্গাদাস লাহিড়ি'র সম্পাদিত বাঙ্গালির গান গ্রন্থে নিধুবাবুর গান সংকলিত হয়েছে ৪৪৭টি। এই সকল গানে যে সকল রাগ ও তালে তিনি গান বেঁধেছিলেন, তার তালিকা দেওয়া হলো।

রাগ তালিকা: আড়ানা, আলাইয়া, আলাইয়া ঝিঁঝিট, আশাভৈরবী, ইমন, ইমনকল্যাণ, ইমনকেদারা, ইমনঝিঁঝিট, ইমনপুরিয়া, ইমনভূপালী, কল্যাণ, কানাড়া, কাফি, কাফি পলাশী, কামোদ, কামোদ খাম্বাজ, কামোদ গৌড়, কালাংড়া, কালাড়া খাম্বাজ, কেদারা, কেদারা কামোদ, খট, খাম্বাজ, গারাকাফি, গাড়া ঝিঁঝিট, গুর্জরী টোড়ি, গৌরী, গৌড় মল্লার, ছায়ানট, ঝিঁঝিট,  ঝিঁঝিটখাম্বাজ, জয়জয়ন্তী, টোড়ি, দরবারি কানাড়া, দরবারি টোড়ি, দেওগিরি, দেশকার, ধানশ্রীপুরিয়া, পরজ, পরজকালাংড়া, পাহাড়ি ঝিঁঝিট, পিলু, পূরবী, বসন্তবাহার, বাগেশ্বরী টোড়ি, বাগেশ্রী,বাগেশ্রী কানাড়া, বাগেশ্রী মুলতানি, বারোয়াঁ, বাহার, বিভাস, বিভাসকল্যাণ, বেহাগ, বেহাগ-ঝিঁঝিট, বেলোয়ার-ঝিঁঝিট, ভাটিয়ারি,  ভৈরব, ভৈরবী, মালকোষ, মুলতানি, রাগসাগর, রামকেল-ললিত, ললিত, ললিতবিভাস, শঙ্করভরণ, শ্যাম, শ্যামপূরবী, সরফরদা, সরফরদা-কালাংড়া, সিন্ধু, সিন্ধুকাফি, সিন্ধুখাম্বাজ, সিন্ধুভৈরবী,  সুরট, সোঘরাই বাহার, সোহিনী, সোহিনীকানাড়া, হাম্বির, হিন্দোল, হিন্দোলবেহাগ।
 

তাল তালিকা: আড়া, আড়াঠেকা, একতালা, কাওয়ালি, ঠুংরি, তেতালা (ঢিমে, মধ্য ও জলদ), মধ্যমান, হরি।

যদিও কালী মীর্জা- নিধুবাবুরফ বেশ আগে থেকে বাংলা ট্প্পা শুরু করেছিলেন, তারপরেও অনেকেই নিধুবাবুকে বাংলা টপ্পার জনক হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। মূলত নিধুবাবু বাংলা টপ্পাকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। মূলত কালী মির্জা নিধু বাবুর আগে বাংলা টপ্পার সূচনা করলেও তা সাধারণ মানুষের ভিতরে তাঁর ছড়িয়ে পড়ে নি। কারণ, তিনি সম্মানীর বিনিময়ে বিভিন্ন রাজাদের ঘরোয়া আসরে গান করতেন। সাধারণ মানুষের সেখানে প্রবেশাধিকার ছিল না। পক্ষান্তরে নিধুবাবু গান করতেন আসরে। নিধুবাবুর বক্তব্য ছিল, তাঁর গান শুনতে হলে, তাঁর আসরে আসতে হবে। সে আসরে উচ্চ-নীচের প্রভেদ ছিল না। ফলে তিনি নানা ধরনের শ্রোতার কাছে তাঁর টপ্পাকে পরিচিত করে তুলতে সক্ষম হয়েছিল।

 

কালী মীর্জা এবং নিধুবাবুর পরে বাংলা টপ্পাকে সচল রাখেন শ্রীধর কথক। শ্রীধর সযত্নে কালী মীর্জা এবং নিধুবাবুর টপ্পাকে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে তাঁর গানে নিধুবাবুর প্রভাবই ছিল বেশি। এছাড়া নিধুবাবুর শিষ্যদের সৃষ্ট হাফ-আখাড়াই গানেও টপ্পা বিশেষ স্থান অধিকার করে নিয়েছিল।

 

হিন্দুস্থানী টপ্পা এবং নিধুবাবুর টপ্পার তুলনা

স্বরের দানাসম্বলিত হিন্দুস্থানী টপ্পার অনুকরণে নিধুবাবু টপ্পার সুরবিন্যাস করেছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর টপ্পা হিন্দুস্থানী টপ্পার মতো দ্রুত লয়ের ছিল না। তিনি লয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মধ্যলয়। আর মধ্য লয়ের উপযোগী তিনি বেছে নিয়েছিলেন মধ্যমান মত তাল। হিন্দুস্থানী টপ্পায় দ্রুতলয়ের সাথে যুক্ত করা হয় জমজমা বা গিটিকিরি। একই সাথে এর প্রতিটি বোল বিশিষ্ট সুরভঙ্গীতে নিবদ্ধ থাকে। এছাড়াও থাকে সুরের উলম্ফন। নিধুবাবু এর কোনোটিই দ্রুতলয়ে বাঁধেন নি। তিনি হিন্দুস্তানী টপ্পার দোলা রেখেছিলেন মধ্যলয়ে এবং সুরের উলম্ফনকে বর্জন করেছিলেন। তিনি বাণীর আবেগকে সুরের ভিতর দিয়ে প্রকাশ করতে গিয়ে এক ধরনের মোলায়েম এবং সুসমন্বিত সুরভঙ্গীকে ব্যবহার করেছিলেন। ফলে সুরের ভিতর দিয়েই আবেশময় রসের সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ সকল বৈশিষ্ট্যের ভিতর দিয়ে তাঁর টপ্পা হয়ে উঠেছিল বঙ্গীয় শৈলীর।

নিধুবাবুর টপ্পার প্রবল প্রভাবে কালী মির্জার গান অপ্রধান হয়ে পড়েছিল। শুধু তাই নয়, নিধু বাবুর গানে অনুরক্ত হয়ে, অনেকে তাঁর শিষ্যও হয়েছিলেন। তাঁদের অনেকে পরবর্তী সময়ে টপ্পা রচয়িতা এবং গায়ক হিসেবে সুখ্যাতি লাভ করেছিলেন। বিভিন্ন টপ্পা আসরে নিধু বাবু এবং শিষ্যদের দাপট ছিল। ফলে সে আমলে কালী মির্জার টপ্পা অনেকটা অপাংক্তেয় হয়ে গিয়েছিল। এসব কারণেই এক সময় লোকে ভাবতে শুরু করেছিল, টপ্পার জনক নিধু বাবু।

নিধু বাবুর পরে তাঁর ধারাকে সচল রেখেছিলেন তাঁরই শিষ্য শ্রীধর কথক। শ্রীধর এতটাই নিধু বাবুর দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন লোকে তাঁর অনেক গান নিধু বাবুর রচিত বলে মনে করতেন। যেমন 'ভালবাসিব বলে ভালবাসিনে' গানটির রচয়িতা নিধু বাবু না কি শ্রীধর কথক- এ নিয়ে এখনো সংশয় আছে। বাণীর বিচারে কালী মির্জার গান ছিল পরিশীলিত পরিমার্জিত, অন্য দিকে নিধুবাবুর গান ছিল আটপৌরে ভাষায়। শ্রীধরের গানের সুরের চলনে ছিল নিধু বাবুর প্রভাব আর বাণীর ধাঁচ ছিল অনেকটা কালী মির্জার মতো। ফলে নিধু বাবুর গানকে বঙ্কিমচন্দ্র, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, নবকান্ত চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ অপছন্দের কাতারে ফেলা চেষ্টা করেছেন।

অশালীনতার দায় নিধু বাবুর কতটুকু এ নিয়ে সংশয় আছে। প্রথম দিকে নিধুবাবুর গানের সংকলন হিসেবে 'গীতরত্ন' (১৮৩৭-৩৮ খ্রিষ্টাব্দ, ১২৪৪ বঙ্গাব্দ)-এ অশালীন বলা যায় এমন গানের নমুনা পাওয়া যায় না। নিধু বাবু এই ধরনে গান পছন্দ করতেনে তেমনটাও মনে হয় না। মূলত তিনি তৎকালীন অশালীন আখড়াই গানকে পরিমার্জিত রূপ দিয়েছিলেন তাঁর আখড়াই গানে। নিধু বাবুকে অশালীন রচয়িতার কাতারে ফেলার পিছনে বিশেষভাবে দায়ী ছিলেন, তাঁরই কিছু শিষ্য। এঁদের অশালীন অনেক গান নিধু বাবুর নামে প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল মুখে মুখে। আর তার দায় বহন করতে হয়েছে নিধু বাবুকে। নিধু বাবুর অন্যান্য শিষ্যদের মতো শ্রীধর কথক অশীলনতার পথে পা না বাড়িয়ে, পরিশীলিত বাণীকে টপ্পা সুরাঙ্গে নিবদ্ধ করেছিলেন। তবে অনেকে মনে করেন তাঁর বহু উৎকৃষ্ট টপ্পা নিধুবাবুর নামে প্রচলিত হয়ে যায়।
 দুর্গাদাস লাহিড়ি সম্পাদিত বাঙালির গান গ্রন্থে তার রচিত ১৯৬টি গান পাওয়া যায়।
 
কালী মির্জার কাছে গানের তালিম নিয়েছিলেন
রামমোহন রায়, রাজা । এই সূত্রে ব্রহ্মসঙ্গীতে টপ্পার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। পরে ব্রহ্মসঙ্গীতের সূত্রে ঠাকুরবাড়িতে টপ্পার গানের চর্চা শুরু হয়েছিল। শুধু ঠাকুর বাড়ি নয় আধা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত


বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ বেশ কিছু টপ্পাঙ্গের রচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে টপ্পার চলন রেখেছিলেন বটে, কিন্তু বাণীর ভাবকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন অনেক বেশি। এই সূত্রে তালে নিবদ্ধ টপ্পাঙ্গের গানের পাশাপাশি, রচনা করেছিলেন বৈতালিক টপ্পা। রবীন্দ্রনাথের পর সার্থক টপ্পা রচনা করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুল ইসলামের টপ্পার চলন অনেকটাই নিধুবাবুর টপ্পার মতো। তবে তাঁর গান সুর-তাল ও বাণীর সুসমন্বয়ে অনেকে বেশি মহিমান্বিত।

এর বাইরে টপ্পা রচয়িতা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন মহেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তিনি পশ্চিমা টপ্পা শিখে এসে বাংলায় টপ্পা রচনা করেছিলেন কালী মির্জা এবং নিধু বাবুর মত। সঙ্গীতে তাঁর অসাধারণ দখলের কারণে তিনি মহেশ ওস্তাদ নামে খ্যত হয়েছিলেন। মহেশচন্দ্র ১৮৫০-১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তাঁর বাংলা টপ্পাকে সজীব করে রেখেছিলেন।
 


সূত্র: