মঙ্গল কাব্য
খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর
ভিতরে রচিত বাংলা কাব্যের একটি বিশিষ্ট ধারা। মূলত লৌকিক কল্যাণের জন্য পৌরাণিক ও
লোক কাহিনির সমন্বয়ে এই কাব্যগুলো রচিত হয়েছিল। হিন্দু পৌরাণিক বিশ্বাসের সাথে এ
কাহিনির সম্পৃক্ততা রয়েছে অবলম্বন হিসেবে। কিন্তু কাহিনিরই বিস্তার ঘটেছে লৌকিক
জীবনযাপন ভিত্তিক উপাদনের সমন্বয়ে। এগুলো মূলত মধ্যযুগীয় পাঁচালিরই কাব্যরূপ।
মঙ্গলকাব্য রচনার সাথে গভীর সম্পর্ক রয়েছে সেকালের ধর্মীয় বিশ্বাস, রাজনৈতিক
প্রেক্ষাপট, আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং কাব্যধর্মী উপস্থাপনার প্রেরণা।
১২০০ থেকে ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে বাংলা ভাষা এবং ধর্মাচরণে বিশাল প্রভাব ফেলেছিল
মুসলমান শাসক এবং এদের সাথে আসা বিদেশী সৈন্য-সামন্তদের দ্বারা। এই সময়ে বাংলা
ভাষার শব্দভাণ্ডারে প্রচুর আরবি, ফার্সি, তুর্কি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। যার
অধিকাংশই এখন বিদেশী তকমা আঁটা বাংলা শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। একেশ্ববাদী ইসলাম
ধর্মের সাথে পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ভাবনার সংঘাত ঘটেছিল এই সময়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীর
বর্ণ-ভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত হওয়ার অনুপ্রেরণায়, ভয়-ভীতি, রাজানুগ্রহ
লাভ ইত্যাদির সূত্রে নিম্নস্তরের হিন্দুদের একটি বিরাট অংশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ
করেছিল। দেড় শ বছরের মধ্যে হিন্দু-মুসলমানের ভিতরে একটি সংহত রূপ করেছিল।
সাহিত্যক্ষেত্রে পৌরাণিক কাহিনি এবং লোককাহিনির সংমিশ্রণের কাজটি মুসলমানদের
আক্রমেণের আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। মুসলিম শাসনের ফলে সেই ধারাকে বেগবান করে তুলেছিল
মাত্র। বিশেষ করে সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে মধ্যযুগীয় কবিরা তাঁদের
সৃষ্টিকর্মকে উচ্চস্তরে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।
মঙ্গল কাব্যের সনাতন হিন্দু উপাস্য দেবতাদের
কাতারে স্থান পেয়েছে অার্য-অনার্য দেবদেবীরা। মনসাদেবীর পূজার ভিত্তি হলো অনার্য
সর্প পূজা, সিজগাছ পূজা, শিকার দেবতা, বনদেবী, শীতলা পূজা, ওলাওঠা পূজা, প্রজনন
শক্তি পূজা। শিব, বিষ্ণু, দুর্গা দেবীরাও যতটা পৌরাণিক, তার চেয়ে বেশি লৌকিক
বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত। এ সকল কাব্য স্বর্গ-নরকের অলৌকিক বিশ্বাসকে একরকম
অগ্রাহ্য করা হয়েছে। এর পরিবর্তে দেবানুগ্রহে কিভাবে লৌকিক জগৎ স্বর্গীয় হতে পারে
তারই সাধনা এ সকল
কাব্যে লক্ষ্য করা যায়। মঙ্গলকাব্যের মঙ্গলকামনা স্বর্গের জন্য নয়, লৌকিক জগতের
জন্য। এ কামনা নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, সকল মানুষের জন্য। এ সকল কাব্যের
দেব-দেবীরা বসন্ত, কলেরা, কুষ্ঠের উপশম ঘটান, সন্তানহীনাকে সন্তান দেন, শিকারে
সাফল্য দেন, বনচারীদের রক্ষা করেন।
মঙ্গলকাব্যে পাওয়া যায় নানা ধরনের লৌকিক ব্রত। যমবুড়ি, গোকাল, পুণ্যপুকুর, ইতু
ইত্যাদি নানা ধরনের ব্রত মঙ্গলকাব্যে পাওয়া যায়। এ সব ব্রতের মন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত
হয়েছে নানা ধরনের ছড়া।
মঙ্গলকাব্যের সূচনা হয়েছিল কানা হরিদত্তের রচনার মধ্য দিয়ে।
বিজয়গুপ্তের
রচনায় পাওয়া যায় 'প্রথমে রচিল গীত কানা হরিদত্ত'। এই কবির জন্মকাল বা কাব্য রচনার
কাল সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। এরপরেই আসে বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল।
মঙ্গলকাব্যের সূচনা ঘটেছিল মনসামঙ্গলের ভিতর দিয়ে, ঐতিহাসিকভাবে সত্য, একই ভাবে
সত্য মনসামঙ্গলই অন্যান্য মঙ্গলকাব্য রচনার ক্ষেত্রে প্রস্তুত করে দিয়েছিল। এই
ধারায় রচিত হয়েছিল ধর্মমঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, অনন্নদামঙ্গল, কালিকামঙ্গল, বিদ্যাসুন্দর
উপখ্যান, চৈতন্যমঙ্গল ইত্যাদি।
সূত্র:
-
পুরাতন বাংলা সাহিত্যের তথ্য ও কালক্রম/সুখময় মুখোপাধ্যায়।
[খান ব্রাদার্স এ্যান্ড কোম্পানি, ডিসেম্বর ২০০০]
-
বাংলা সাহিত্যের কথা/ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।
[মওলা ব্রাদার্স, বাংলা একাডেমী, অক্টোবর ১৯৯৯]
-
বাংলা সাহিত্যের রূপরেখা।
গোপাল হালদার। [মুক্তধারা, আগষ্ট ১৯৮০]
- বাংলা সাহিত্যের সমগ্র ইতিহাস।
ক্ষেত্র গুপ্ত। [জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ফেব্রুয়ারি ২০০০।
-
ভারতের ইতিহাস
। অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়। [মৌলিক লাইব্রেরি, কলকাতা, জুন
২০০০]