পাঁচালি
বাংলা আধা-লোকগীতির একটি ধারা। খ্রিষ্টীয়
অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই আখ্যানধর্মী গানের বিকাশ ঘটেছিল। বলা হয়ে থাকে গীত,
বাদ্য, ছড়াকাটা, কবিগানের লড়াই এবং নৃত্যের সমন্বয়ে এই গীতি গড়ে উঠেছিল বলে, এর নাম
ছিল পঞ্চাল বা পঞ্চালিকা এবং সেখান থেকে পাঁচালি শব্দের উৎপত্তি। তবে সুরের বিচারে
পাঁচালি প্রাচীন এবং খাঁটি লোকগীতি। মধ্যযুগে আখ্যানকাব্য হিসেবে রামায়ণ,
শাক্ত-কাহিনি,
মঙ্গলকাব্য ইত্যাদি পাঠ করা হতো পাঁচালি হিসেবে সরল সুরে। এছাড়া পুঁথি পাঠও করা হতো
পাঁচালির সুরাঙ্গে।
খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে পুতুলনাচের প্রচলন ঘটে। তখন পুতুল নাচের
সাথে যে আখ্যান ও ছড়া থাকতো, তাও পরিবেশিত হতো পাঁচালির সুরে। পুতুল নাচের
অধিকারীদের কাছে গীত-বাদ্যের এই অংশ পাঁচালি নামেই পরিচিত ছিল। ঊনবিংশ
শতাব্দীর প্রথমভাগে পুতুলনাচের কদর কমে যেতে থাকে। এই সময় গায়েনরা নিজেরাই নূপুর
পরে,
হাতে চামর দুলিয়ে বা মন্দিরা নিয়ে নৃত্য পরিবেশন করতেন। এসময় এঁরা বহুরূপীর মতো
চরিত্রানুসারে নিজেদের নানা পাত্রপাত্রীর রূপে সাজতেন। কালক্রমে এই ধারার কাহিনীপ্রধান গান পাঁচালি নামে
স্বতন্ত্র গীতিধারা হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। পাঁচালিতে হাফ আখড়াই গানের মতো
তানপুরা, বেহালা, ঢোল, মন্দিরা, মোচং ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হতো।
এই সময় অনেক কবিয়াল পাঁচালি গান
রচনায় হাত দেন। এর ফলে কবিগানের কিছু বিশিষ্ট ধারা পাঁচালিতে যুক্ত হয়। এই ধারার
অন্যতম পাঁচালি রচয়িতা ছিলেন
দাশরথি
রায় (১৮০৬-১৮৫৭
খ্রিষ্টাব্দ)।
দাশরথি
রায় প্রথম জীবনে কবিয়াল ছিলেন। এক কবিগানের আসরে
প্রতিপক্ষ রামদাস স্বর্ণাকরের দ্বারা তিরস্কৃত হয়ে দলত্যাগ করেন। এরপর তিনি পাঁচালি
রচনায় হাত দেন। ১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পাঁচালির আখড়া স্থাপন করেন। তিনি প্রচলিত পাঁচালির রীতি ত্যাগ করে, কবি গানের মতো চাপান-উতোর
ভঙ্গীতে পাঁচালিকে সাজান। একই সাথে উৎকৃষ্ট ছড়া যুক্ত করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর
মধ্যভাগে পাঁচালির সুরে টপ্পার সংমিশ্রণ ঘটে। কবিগানের প্রভাবে পাঁচালী ধীরে ধীরে
আসরকেন্দ্রিক হয়ে উঠে। এই সূত্রে পাঁচালি হয়ে যায় আখড়াই গানের একটি প্রকরণ। এই সময়
অঙ্গভঙ্গি ও অভিনয় এর সাথে যুক্ত হতে থাকে। এছাড়া আখ্যান বর্ণনাতে সংলাপ অভিনয়
সহকারে পরিবেশন করতেন মূল গায়েন। এই সময় আসরে হাস্যরস পরিবেশনের জন্য যুক্ত হয়েছিল
'সঙ' নামক চরিত্র। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে পৌরাণিক বা লৌকিক কাহিনির পাশাপাশি
পাঁচালিতে বিষয় হিসেবে উঠে আসে বিধবা বিবাহ, আয়কর সমস্যা,
প্রেমকাহিনি ইত্যাদি সামাজিক নানা সমস্যা।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাঁচালি একটি পরিবেশনযোগ্য রীতিতে পৌঁছেছিল। এই রীতিতে শুরু
বাদ্যযন্ত্রের লড়াই হতো। এর নাম ছিল 'সাজ-বাজানো'। এরপর শ্যামা অংশ ছিল। এই অংশে
মূলত সমবেত কণ্ঠে শ্যামাকে গান হতো। একজন কবি ছড়া কাটতেন অর্থাৎ মুখে ছড়া বলে
শ্রোতাদের মুগ্ধ করতেন। এছাড়া ছড়াকে মূল কবি সুর-সহযোগে পরিবেশন করতেন। সেই কারণে
উত্তম ছড়াকারকে গানও জানতে হতো। একটি দল শ্যামা বিষয় শেষ করার পর, অন্যদল আসরে
আসতেন। এই দল সখী-সংবাদের গান গেয়ে ছড়া কাটা শুরু করতেন। এরূপ কবিদের পর্যাক্রমিক
মাথুর, মান, দান ইত্যাদি বিষয় হতো। তবে পাঁচালিকার একটি বিষয়ের ভিতরে থেকে সব কিছু
করতে হতো। বিষয়ের বাইরে বেড়িয়ে যাওয়াটা পাঁচালির রীতিবিরুদ্ধ ছিল।
পরবর্তী সময়ে পাঁচালি, কবিগান, কীর্তন
ইত্যাদির সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছিল পালা গান। এই ধারার উল্লেখযোগ্য পালাগান রচয়িতা
হিসেবে পাওয়া যায়
কৃষ্ণকমল গোস্বামী
(১৮১০-১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দ)-কে। বিশেষ করে 'রাই উন্মাদিনী',
'স্বপ্ন-বিলাস', 'সুবল-সংবাদ', 'নন্দহরণ', 'বিচিত্রবিলাস', 'ভরতমিলন', 'গন্ধমিলন',
কালীয়দমন', 'নিমাই সন্ন্যাস' পালাগানগুলো সেকালের সঙ্গীতজগতে আলোড়ন তুলেছিল। আবার
পালাগানের সূত্রে উদ্ভব হয়েছিল যাত্রাগান।
এই ধারায় যে সকল পালাগান রচয়িতারা বিশেষ
অবদান রেখেছিলেন, তাঁরা হলেন, ঠাকুরদাস দত্ত (১৮০১-১৮৭৬),
রসিকচন্দ্র রায় (১৮২০-১৮৯২), ব্রজমোহন রায় (১৮৩১-১৮৭৬), রসিকচন্দ্র গোস্বামী,
নন্দলাল রায় প্রমুখ।
গোড়ার দিকে পাঁচালি পরিবেশিত হতো বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই ঘরোয়া আসরে। পুতুলনাচের সূত্রে
এর সাথে যুক্ত হয়েছিল মৃদঙ্গ, ঢোল, কাঁসি, বাঁশি, সারিন্দা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র।
পরবর্তী সময়ে পালগানধর্মী পাঁচালিতে এর সাথে যুক্ত হয়েছিল হারমোনিয়াম, বেহালা,
তবলা, খোল ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র।