তান
ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রের একটি পারিভাষিক শব্দ। রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে তন্ (বিস্তার করা) +অ (ঘঞ)। এর আভিধানিক অর্থ হলো- বিস্তার বা প্রসার। সঙ্গীতশাস্ত্রে স্বরের বিস্তারকে তান বলা হয়।

প্রাচীন গ্রন্থাদি মতে- মূলত মূর্ছনা থেকে তানের উৎপত্তি ঘটেছিল। বৃহদ্দেশী মতে- মূর্ছনাতে আরোহ ও অবরোহ দুইই থাকতো। আর মূর্ছনায় থাকতি শুধু আরোহণ। এই বিচারে একে অনেক সময় অর্ধমূর্ছনা উল্লেখ করা হয়েছে।


তানের প্রথম ব্যাখ্যা শ্রেণিকরণ পাওয়া যায় খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে
ভরত মুনির রচিত নাট্যশাস্ত্রে। এই গ্রন্থের  অষ্টাবিংশ  অধ্যায়ে দুই গ্রাম (ষড়্জ ও মধ্যম গ্রাম)  অনুসারে তানগুলোকে সম্পূর্ণ, ষাড়ব ও ঔড়বিত হিসেবে শ্রেণিকরণ করা হয়েছে। এর ভিতরে ষড়্‌জ ও মধ্যম গ্রামে সম্পৃর্ণ জাতির তান ছিল- দুই প্রকার।

ষড়্‌জগ্রামে ষাড়ব জাতির (ছয় স্বরের) তানে ষড়্‌জ, ঋষভ, নিষাদ ও পঞ্চম বর্জিত হতো। পক্ষান্তরে মধ্যম গ্রামে ষড়্‌জ, ঋষভ ও গান্ধার বর্জিত হতো। এই দুই গ্রাম মিলে ষাড়ব জাতীয় তানে ৪৯টি তান ছিল। ঔড়বিত জাতির (পাঁচ স্বরের) তানে ষড়জ গ্রামে বর্জিত স্বর ছিল- ষড়্‌জ ও পঞ্চম, ঋষভ ও পঞ্চম ও গান্ধার ও নিষাদ।  মধ্যম গ্রামে বর্জির স্বর ছিল- গান্ধা ও নিষাদ। সব মিলিয়ে ঔড়বিত জাতিতে  তান ছিল ২১টি।

আবার তারের যন্ত্রে বিচারে তান সংযো্গ উল্লেখ করা হয়েছে দুটি প্রণালী হিসেবে বলা হয়েছে- প্রবেশ ও নিগ্রহের কথা। তাঁর মতে- তন্ত্রীতে তান দুই প্রকারে নিষ্পন্ন হয়। একে বলা হয়েছে প্রবেশ এবং নিগ্রহ।  উল্লেখ্য এক স্বরের ঊর্ধে অবস্থিত স্বরের প্রবেশকে বলা হয়- প্রকর্ষ। আবার নিম্নস্থিত স্বরে প্রবেশকে বলা হচ্ছে মার্দব। এই দুটি ক্রিয়াকেই প্রবেশ বকা হয়। যেমন- স গগ, প্রকর্ষ আর স ধ্  মার্দব। আর প্রকর্ষ এবং মার্দব হলো প্রবেশকের দুটি প্রকরণ মাত্র। নিগ্রহ হলো- নিম্নস্থ স্বরের অসংস্পর্শজনিত পরিত্যাগ। যেমন- স স  গ র প প ম র। এখানে আরোহণে- স এর পরে গা, অর্থৎ ঋষভ বর্জিত। কিন্তু অবরোহণে বক্রভাবে ঋষভে পৌঁছেছে। আরোহণ নিম্নস্থ স্বর অসংস্পর্শিত ঋষভ। এটাই নিসর্গক্রিয়া।


 বৈদিক গান এবং পরবর্তী গান্ধর্ব গানে স্বরের বিস্তারে সংখ্যর উপর ভিত্তি করে তানের শ্রেণিকরণ করা হতো। যেমন-
১. আর্চিক: বৈদিক যুগের শুরুতে যজ্ঞানুষ্ঠানে সামগান পরিবেশন করা হতো একটি সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনিতে। একে বলা হতো আর্চিক তান।
২. গাথিক: বৈদিক যুগের শুরুতে যজ্ঞানুষ্ঠানে পরিবেশিত সামগানে দুটি সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি ব্যবহার শুরু হয়। একে বলা হতো গাথিক তান। মূলত এই গান করা হতো গাথা নামক ছন্দের সাথে।
৩. সামিক: আর্চিক ও গাথিক তানের পরে যাজ্ঞিক ঋষিরা তিনটি স্বরস্থানে সামগান পরিবেশন করতেন। এই স্বরস্থানগুলো ছিল- উদাত্ত, অনুদাত্ত ও স্বরিত। তিন স্বরস্থানের এই তানের নাম ছিল সামিক তান।
৪. স্বরান্তর: চার স্বরের ব্যবহারে সৃষ্ট স্বরবিস্তারের নাম ছিল স্বরান্তর। ধারণা করা হয়- সাতস্বরের মধ্যে চতুর্থ স্বরটি মধ্যবর্তী বা অন্তর্বর্তী। এই কারণে এর নাম স্বরান্তর।
৫. ঔড়ব বা ঔড়ুব: পাঁচ স্বরের ব্যবহারে সৃষ্ট স্বরবিস্তারের নাম ঔড়ব। পাঁচ স্বরযুক্ত রাগে এই তানের ব্যবহার হয়ে থাকে।
৬. ষাড়ব:
ছয় স্বরের ব্যবহারে সৃষ্ট স্বরবিস্তারের নাম ষাড়ব। ছয় স্বরযুক্ত রাগে এই তানের ব্যবহার হয়ে থাকে।
৬. সম্পূর্ণ: সাত স্বরের ব্যবহারে সৃষ্ট স্বরবিস্তারের নাম সম্পূর্ণ। সাতস্বরযুক্ত রাগে এই তানের ব্যবহার হয়ে থাকে।
প্রাচীন গ্রন্থাদিতে তানের চলন অনুসারে দুটি ভাগে ভাগ করা হতো। এর নাম ছিল-
১. শুদ্ধ তান: স্বাভাবিকভাবে ক্রমাধারায় উচ্চারিত তান। যেমন- সরগমপধন
২. কূট তান: ক্রম উলঙ্ঘন পূর্বক স্বরের বিস্তারকে কূটতান বলা হতো। যেমন- সগপন।
ষড়্‌জ ও মধ্যম গ্রামে ষাড়ব ও ঔড়ব শুদ্ধতান ৮৪টি আর ২টি গ্রামের সম্পূর্ণ তান ৪টি। সমবিলিয়ে মোট শুদ্ধ তান ছিল ৮৮টি। কিন্তু ষড়্‌জ ও মধ্যম গ্রামের (পুনরুক্তি বাদে) ষাড়ব ও ঔড়ব জাতিতে কূটতান ছিল ৩,১৭,৯২৭টি। একটি মূর্চ্ছনার স্বরগুলোকে নানাভাবে সজ্জিত করলে, তান পাওয়া যায় মোট ৫০৪০। ষাড়ব ক্রমে এর সংখ্যা ৭২০, ঔড়বক্রমে ১২০, স্বরান্তরে ২৪, সামিক ক্রমে ৬ট, ফাথিক ক্রমে ২টি, আর্চিক ক্রমে ১টি।

বর্তমানে খেয়াল গানে তান একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। মূল বন্দিশের সাথে শিল্পীরা তালের সাথে সমন্বয় করে তান পরিবেশন করে থাকেন। স্বরবিস্তারের প্রকৃতি অনুসারে তাকে নানাবিধ ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। নিচে উল্লেখযোগ্য কিছু তানের উল্লেখ করা হলো।
তথ্যসূত্র: