ধরা যাক, আপনি কোনো এক
মহাশূন্যের মধ্যে একাকী দাঁড়িয়ে আছেন। আপনার পায়ের তলা দিয়ে নিরপেক্ষ সময় প্রতিনিয়ত
প্রবাহিত হচ্ছে। আপনি সেই নিরপেক্ষ সময়ের যেদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন, সেদিকে রয়েছে
অনাগত ভবিষ্যৎ, আর পিছনে চলে গেছে অতীত। এবং আপনি যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, সেটিই
হচ্ছে প্রবহমান বর্তমান। কিম্বা এমনও হতে পারে সময় স্থির আছে, আপনিই একটি গতিতে
এগিয়ে চলেছেন। বিষয়টি যাই হোক না কেন, আসল ব্যাপারটি হচ্ছে, আপনার এবং সময়ের গতির
মধ্যে কিছু বৈষম্য আছে। যদি আপনার এবং সময়ের গতি একই হতো তবে একটি নিরপেক্ষ অসীম
বর্তমানে আপনি অবস্থান করতেন। বাস্তবে তেমন ঘটছে না। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়, সময় বয়ে
যাচ্ছে এবং আমরা স্থির আছি। নিরপেক্ষ সময়ের স্রোতে আমাদের উন্মেষ এবং লয়। সুতরাং
সময়টা আমাদের কাছে সবসময় একটি ভিন্নতর গুরুত্ব আদায় করে নিচ্ছে। বিজ্ঞান এই সময়কে
নাম দিয়েছে চতুর্থ মাত্রা। সঙ্গীতে তালের ব্যাপারটাই হলো এই চতুর্থ মাত্রার। অধরা
চতুর্থ মাত্রাকে ছন্দে-বন্ধে ধরাটাই দোলা-ছন্দ-তাল।
সময়ে বয়ে যাচ্ছে, যেন অনাগত ভবিষ্যতে তার বাস। দুরন্ত শিশুর মতো খেলাচ্ছলে
মুহূর্তের মধ্যে বর্তমানের পা ফেলে কি ফেলে না, মুহূর্ত পরেই অতীতের দিকে ছুট লাগায়।
গানের তালও সে পথে চলে। এই আছে এই নাই। যে সময় বয়ে চলেছে, সেখানে ভালো কি মন্দ,
সুর কি অ-সুর, ছন্দ কি ছন্দোপতন, কিছু নেই। সময় নৈর্ব্যক্তিক এবং নিরপেক্ষ। কিন্তু
এই সময়ই বাঙ্ময় এবং পক্ষপাতে দুষ্ট হয়ে ওঠে অনুভূতির মধ্য দিয়ে। সে অনুভূতি হতে পারে
বৈষয়িক কিম্বা শৈল্পিক। এই যে সময় বয়ে চলেছে, মানুষের হাতে গড়া ঘড়ি নামক যন্ত্রটি
তার একটি প্রতীকি চিহ্ন দিয়ে চলেছে। মানুষ বিচিত্র কারণে সময়কে মান্য করে চলেছে। এ
মান্যটা মানুষের কল্যাণের জন্য, শৃঙ্খলার জন্য।
কোনো অখণ্ড
সময়ের ধারাবাহিকতায় মানুষ যা অনুভব করে, তা বৈচিত্র্যহীন দশায় থাকে। ধরা যাক একটি
মহাকাশযান একই দিকে সমগতিতে চলছে। এই চলায় নভোযাত্রীরা কোনো ছন্দ অনুভব করবেন না।
কারণ তাতে দোলা নেই। এই নভোযানটি যদি একটি বার দিক বা গতি পরিবর্তন করে, তা হলে সে
পরিবর্তনটা অভিযাত্রীরা অনুভব করলেও তাতে দোলার অনুভব জাগবে না। কারণ, এই
পরিবর্তনের পর থেকে নতুন দিকে নতুন গতিতে নভোযান চলতে থাকবে। একইভাবে যে কোনো
বিষয়ের অগ্রসরমান দশার কোনো বিশেষ পরিবর্তন ভিন্নতর অনুভবের সৃষ্টি করলেই তাতে
দোলার অনুভব জাগবে না। তবে এর ফলে দোলা তৈরির সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু কোনো
কিছুর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যখন যখন দোলার সৃষ্টি হয়, তখন কতকগুলো বিশেষ শর্ত কাজ
করে। যেমন—
এখানে ক বিন্দুতে যে পরিবর্তন ঘটবে তা এবং খ সময় বিন্দু পর্যন্ত চলমান থাকবে। খ- সময় বিন্দুতে দ্বিতীয় পরিবর্তন ঘটবে এবং একটি তা আবার নতুন পরিবর্তনের পথ ধরে চলতে থাকবে। ফলে ক-খ সময় বিন্দুতে একটি দোলার সৃষ্টি হবে।
একটি দশার আদি বিন্দু থেকে ঘটনাপ্রবাহ যখন শুরু হয়, তখন তা একই ভাবে চলতে থাকলে দোলার সৃষ্টি হয় না। এর জন্য প্রয়োজন উত্থান-পতন। পর্যায়ক্রমে এই উত্থান-পতনের বিষয়টি মানুষের মনোজগতে এসে দোলার সৃষ্টি করে। ঘরের দেয়াল-ঘড়ির দোলক দুলছে। এটা দেখার পরে দর্শনেন্দ্রিয়ে পর্যায়ক্রমিক গতিপথের অনুভব জাগবে মনে। পাশের চিত্র অনুসরণ করে আমরা বিষয়টা বুঝার চেষ্টা করতে পারি। যদি ক-কে দোলকের আদি বিন্দু ধরি। তাহলে ক থেকে খ পর্যন্ত মনে হবে দোলকের গোলকটি নামছে এবং খ থকে গ পর্যন্ত মনে হবে গোলকটি উঠছে। এক্ষেত্রে ক-খ যদি সর্বোচ্চ বিন্দু ধরা হয়, তাহলে খ হবে সর্বনিম্ন বিন্দু। দর্শনের বিচারে এই উত্থান-পতনের পর্যাক্রমিক পরিবর্তনই মনে দোলার সৃষ্টি করবে। এক্ষেত্রে দোলার সংজ্ঞা হতে পারে- কোনো সত্তার এগিয়ে যাওয়া এবং ফিরে আসার কার্যক্রম বা ঘটনা। এখানে ফিরে যাওয়াটা অতীতে ফিরে যাওয়া নয়, ঘটনার পুনরাবৃ্ত্তি হওয়া। চলমান সময়ের স্রোতে এই দোলার রূপ হবে বর্তমান থেকে অতীতের দিকে এবং তরঙ্গাকারে। ক বিন্দু থেকে যাত্রা শুরু করে গ বিন্দুতে দোলকের গোলক একটি দোলার সৃষ্টি করেছে। দোলকের গোলক এরপর ক বিন্দুর দিকে অগ্রসর হবে। এর ফলে ক-গ-ক একটি আবর্তন সম্পূর্ণ করবে। পর্যাক্রমিক এই গতিময় রূপকেই আমরা দোলা হিসেবে বিবেচনা করে থাকি। নিচের চিত্রে দোলার তরঙ্গায়িত রূপ দেখানো হলো।
প্রতিটি শ্রোতার ভিতরে যে
'আমি' আছে। সেই 'আমি'র অনুভবের ক্ষমতাই বড়। যে দোলা 'আমি' অনুভব করে না, সে দোলা ওই
'আমি'র কাছে উপলব্ধিহীন দশায় থাকে। ধরা যাক একজন অন্ধলোককে বাগানে বসিয়ে রাখা
হয়েছে। বায়ুপ্রবাহে গাছের শাখায় যে দোলার সৃষ্টি হচ্ছে, অন্ধলোকটির কাছে তা
উপলব্ধিহীন হয়েই থাকবে। আবার সকল দোল সকল মানুষ সমানভাবে গ্রহণ করতে পারে না বা করতে চায়
না। এখানে রয়েছে মনস্তাত্ত্বিক এবং উপলব্ধি করার বিষয়। গাছের ডালে দোলনা বেঁধে
কিশোরী দোলায়িত হচ্ছে। এই দোলা সে অনুভব করবে দেহে এবং মনে। কিন্তু দূরে বসে ঠাকুমা
তা দেখে দোল খাচ্ছে মনে মনে। ঠাকুমার এই দোলা মনস্তাত্ত্বিক।
সময়ের নিরিখে দোলার মানকে
প্রাথমিকভাবে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগ দুটি হলো- অনিয়মিত ও নিয়মিত।
এরপর শাখাটি তার আগের অবস্থানে ফিরে আসার চেষ্টা করবে। স্বাভাবিকভাবে শাখাটি তার স্থিতিস্থাপক বৈশিষ্ট্যের কারণে উপরের দিকে ৫ ইঞ্চি উঠে আসতে পারে। শাখাটির অবস্থান পরিবর্তনের কারণে দর্শনানুভূতিতে একটি চলমান দশার সৃষ্টি হবে। এর ফলে রেখাচিত্রটি হবে, নিচের চিত্রের মতো।
এক্ষেত্রে শাখার ০ থেকে ৫-এর অবস্থানগত দশা পরিবর্তনের সূত্রে একটি দোলা তৈরি হয়। বায়ু প্রবাহজনীত শক্তির হেরফেরে কারণে, এরূপ দোলা একই রকম হবে না। একটি সুনির্দিষ্ট সময়ে অনেকগুলো দোলা মিলে একটি দর্শানুভূতিতে বড় দোলার সৃষ্টি করবে। এই বড় দোলাটিই হবে ছন্দ। এর চিত্রটি হতে পারে- নিচের মতো।
দোলা, স্পন্দন এবং একক
ক্ষুদ্রসময়ের ব্যবধানে
সৃষ্ট দোলার মানুষের মনকে দোলায়িত করে না। স্বল্প সময়ের এই দোলাকে বলা যায় স্পন্দন।
যেমন হৃদ-স্পন্দন। যার গড় গতিমান প্রতি সেকেন্ডে ৭২টি। এই অনুভবের অভিঘাত কমতে
থাকলে,স্পন্দন দোলায় পরিণত হয়, বা তাকে দোলা নামে অভিহিত করা যায়।
মূলত অনুভবের
দুটি অভিঘাতের মধ্যে বিরাম অংশটুকুই দোলার অনুভব সৃষ্টি করে। সঙ্গীত ও কাব্য
শাস্ত্রে এই দোলাকে বলা হয় মাত্রা। আর দোলার গতিকে সঙ্গীতশাস্ত্রে বল হয় লয় বলা হয়।
প্রকৃতির দোলা অনিয়মিত। কারণ সময়ের বিচারে এই দোলাগুলো সুষম নয়। যেমন- সমুদ্র ঢেউ,
ধানের ক্ষেতে বায়ুপ্রবাহজাত ঢেউ-খেলানো রূপ, দূর পাহাড়ি বনাঞ্চলের উপরিভাগের
ঢেউ-খেলানো রূপ। এ সবই অনিয়মিত দোলা। চলমান দোলার মধ্য দিয়ে তৈরি হয় ছন্দের। যে
দোলা মনকে দুলিয়ে দেয়, সে দোলা ছন্দের তৈরি করে। একাধিক দোলা যখন নিয়মিত বা
অনিয়মিতভাবে ঘটতে থাকে এবং এর ভিতরে এক ধরনের স্বস্তিদায়ক বৃহৎ দোলার সৃষ্টি করে,
তখন ছন্দের সৃষ্টি হয়। সেই বিচারে বলা যায়, ছন্দ হলো একাধিক দোলার সমন্বয়ে সৃষ্ট বড়
দোলা। আর গুচ্ছবদ্ধ দোলার সমন্বয়ে সৃষ্টি হয়
ছন্দ ।