অশ্বত্থামা
ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা
{
পৌরাণিক সত্তা
|
কাল্পনিকসত্তা
|
কল্পনা
|
সৃজনশীলতা
|
দক্ষতা
|
জ্ঞান |
মনস্তাত্ত্বিক বিষয়
|
বিমূর্তন
|
বিমূর্ত-সত্তা
|
সত্তা
|}
হিন্দু পৌরাণিক কাহিনিতে দুটি ক্ষেত্রে এই নাম পাওয়া যায়। যেমন–
১.
একটি হাতির নাম পাওয়া যায়।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে
পাণ্ডব পক্ষের
রাজা ইন্দ্রবর্মার হস্তির নাম ছিল অশ্বত্থামা।
এই হাতির মৃত্যু হলে— যুদ্ধের
কৌশল হিসাবে যুধিষ্ঠির দ্রোণাচর্যের সামনে নাম উচ্চারণ করেছিলেন।
২.
পিতার নাম দ্রোণাচার্য ও মাতার নাম কৃপী।
ইনি জন্মের পরপরই অশ্বের মতো শব্দ করেছিলেন বলে- এঁর এরূপ নামকরণ করা হয়েছিল।
অর্থাৎ অশ্বের ন্যায় স্থাম যাহার/ বহুব্রীহি সমাস– এই অর্থে সকার স্থানে তকারাদেশে
নাম হয়েছিল অশ্বত্থামা।
মহাদেব,
যম,
কাম ও
ক্রোধের মিলিত অংশে এঁর জন্ম হয়েছিল।
ইনি অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন।
এঁর চোখ ছিল পদ্ম-পলাশের মতো।
তাঁর মাথায় একটি সহজাত মণি ছিল।
এঁর পরিধেয় বস্ত্র ছিল নীল।
ইনি তাঁর পিতার
কাছ থেকে বেদাদিশাস্ত্র ও ধনুর্বেদ শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন।
পরে পিতা-মাতার সাথে ইনি হস্তিনাপুরে কৃপাচার্যের (কৃপী'র
ভাই ও অশ্বত্থামার মামা) কাছে আসেন।
এই সময় ভীষ্ম দ্রোণাচার্যকে কুরু-পাণ্ডবদের অস্ত্র শিক্ষায় নিয়োগ করলে তাঁদের
সাথে ইনিও অস্ত্র শিক্ষা গ্রহণ করেন।
পুত্রের প্রতি অত্যধিক স্নেহবশত ইনি অন্যান্য শিষ্যদের চেয়ে অশ্বত্থামাকে অধিকতর
শিক্ষা প্রদান করেন।
এর ফলে অশ্বত্থামা বহু গুপ্ত অস্ত্র প্রয়োগের কৌশল পিতার কাছ থেকে শিখেছিলেন।
পিতার কাছ থেকে নারায়ণ প্রদত্ত নারায়ণাস্ত্র ও ব্রহ্মশির নামক অস্ত্র লাভ করেন।
পাণ্ডবদের বনবাসকালে দুর্যোধন কর্তৃক সম্মানিত হয়ে ইনি হস্তিনাপুরে অবস্থান করেন।
এই সময় ভূমণ্ডলে অজেয় হওয়ার আশায় ইনি দ্বারকায় গিয়ে কৃষ্ণের কাছে ব্রহ্মশির
অস্ত্রের বিনিময়ে সুদর্শনচক্র প্রার্থনা করেন।
কৃষ্ণ তাঁর মনোভাব বুঝতে পেরে তাঁকে উক্ত চক্র উত্তোলন করতে বললে- ইনি তা
উত্তোলনে অক্ষম হন এবং লজ্জিত হয়ে নতশিরে প্রত্যাগমন করেন।
দ্রোণাচার্য বিরাটরাজার গো-হরণের সময় ইনি দুর্যোধনের সাথে গিয়েছিলেন।
বৃহন্নলাবেশী অর্জুনকে দেখে কর্ণ আস্ফালন করতে থাকলে,
ইনি অর্জুনের শক্তির কথা উল্লেখ করে কর্ণকে তিরস্কার ও অপমান করেন।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ইনি তাঁর পিতার সাথে দুর্যোধনের পক্ষাবলম্বন করেন।
যুদ্ধের আরম্ভে,
দম্ভের সাথে ইনি প্রতিজ্ঞা করে বলেছিলেন- দশদিনে ইনি পাণ্ডব সৈন্য নিধন করবেন।
বলাবাহুল্য তিনি তা পারেন নি।
দুর্যোধন এঁর হাতে এক অক্ষৌহিনী (২১৮৭০ গজ ও গজারোহী,
২১৮৭০ রথ ও রথী,
৬৫৬১০ অশ্ব ও অশ্বারোহী এবং ১০৯৩৫০ পদাতিক ) সৈন্যের ভার অর্পণ করেছিলেন।
এঁর রথের পতাকায় সিংহের লেজ অঙ্কিত ছিল।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে দ্রোণাচার্য অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলে- শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডবদের সকল সৈন্যকে 'অশ্বত্থামা নিহত হয়েছে'- এইরূপ ঘোষণা দিতে বলে। সেইভাবে এই বাক্য ঘোষিত হতে থাকলে দ্রোণাচার্য প্রথমে তা অবিশ্বাস করে বলেন যে,- যুধিষ্ঠির বললে তবেই তিনি তা বিশ্বাস করবেন। এরপর কৃষ্ণ ও ভীমের প্ররোচনায় যুধিষ্ঠির দ্রোণের উদ্দেশ্যে 'অশ্বত্থামা হতঃ- কুঞ্জর ইতি' (অশ্বত্থামা -নামক হাতী নিহত হয়েছে) বাক্য উচ্চারণ করেন। উল্লেখ্য পাণ্ডব পক্ষের রাজা ইন্দ্রবর্মার হস্তির নাম অশ্বত্থামা ছিল এবং তা পূর্বেই নিহত হয়েছিল। যুধিষ্ঠির কুঞ্জর ইতি শব্দটি আস্তে বলাতে দ্রোণচার্য মনে করেন যে তাঁর পুত্র অশ্বত্থামার মৃত্যু সংবাদ দেওয়া হয়েছে। এরপর দ্রোণাচার্য অস্ত্র ত্যাগ করলে– ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁকে হত্যা করেন।
অশ্বত্থামা তাঁর পিতার এরূপ মৃত্যুর কথা শুনে নারায়ণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। কিন্তু কৃষ্ণের উপদেশে সকলে রথ ও অস্ত্রাদি ত্যাগ করে অস্ত্রের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়ালে এই অস্ত্র বিফল হয়। এরপর ইনি পিতার হত্যাকারী ধৃষ্টদ্যুম্নকে হত্যা করার জন্য বার বার চেষ্টা সত্বেও ভীম, অর্জুন ও সাত্যকির কারণে তা সম্ভব হয় নি। এই সময় অসংখ্য পাণ্ডব সৈন্য ধ্বংস করার পরও কৃষ্ণার্জুনকেও হত্যা করতে সক্ষম হলেন না। এরপর অর্জুন-কর্ণের যুদ্ধে অর্জুনের বীরত্ব দেখে ইনি দুর্যোধনকে পাণ্ডবদের সাথে সন্ধির প্রস্তাব দিতে বলেন। দুর্যোধন সে কথা না শুনে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন।অশ্বত্থামা এই হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পর প্রথমে দুর্যোধনকে সংবাদ দান করলে, আনন্দে ইনি তাঁকে আশীর্বাদ করে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর ইনি ভাগীরথীর তীরে ব্যাসদেবের কাছে যান। এঁকে খুঁজতে খুঁজতে যুধিষ্ঠির ভীম ও অর্জুন সেখানে উপস্থিত হলে- ইনি পাণ্ডব নিধনের উদ্দেশ্যে ব্রহ্মশির অস্ত্র প্রয়োগ করেন। কৃষ্ণের নির্দেশে অর্জুনও প্রতিষেধক হিসাবে একই অস্ত্র প্রয়োগ করলে- উভয় অস্ত্রের কারণে পৃথিবী ধ্বংসের উপক্রম হয়। সে কারণে দেবর্ষি নারদ ও মহর্ষি ব্যাস এই দুই অস্ত্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে উভয়ের অস্ত্র সংবরণ করতে বলেন। অর্জুন ব্রহ্মচর্য পালনের কারণে অস্ত্র প্রতিহারে সমর্থ হলেও, অশ্বত্থামা সদা সত্পথে না থাকায় ইনি তাঁর অস্ত্র প্রত্যাহার করতে পারলেন না। ফলে উক্ত অস্ত্র ব্যর্থ হয়ে অর্জুনের পুত্রবধু উত্তরার গর্ভস্থ শিশুকে হত্যা করে। পরে কৃষ্ণ যোগবলে শিশুটিকে জীবিত করেন।
অশ্বত্থামা এর পরে পাণ্ডবদের কাছে পরাজয় স্বীকার করে তাঁর সহজাত মণি প্রদান করেন। এরপর দুঃখিত মনে বনে গমন করেন। অশ্বত্থামা বিবাহ করেন নি। ব্রাহ্মণ হয়েও ইনি পিতার মতো ক্ষাত্রবৃত্তি অবলম্বন করেছিলেন।