দুর্যোধন
ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা { পৌরাণিক সত্তা | কাল্পনিকসত্তা | কল্পনা | সৃজনশীলতা | দক্ষতা | জ্ঞান | মনস্তাত্ত্বিক বিষয় | বিমূর্তন | বিমূর্ত-সত্ত | সত্তা |}

হিন্দু পৌরাণিক কাহিনিতে এই নামে দুটি চরিত্র রয়েছে। এঁরা হলেন

. মাহিস্মতী ইক্ষ্বাকু বংশের একজন রাজা বিশেষএঁর ঔরসে ও দেবনদী নর্মদার গর্ভে সুদর্শনা নামক একটি কন্যা জন্মেঅগ্নিদেব পরে এই কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন

. ধৃতরাষ্ট্রের ঔরসে গান্ধারীর গর্ভে এর জন্ম হয়েছিলকুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ইনি ছিলেন কৌরব দলনেতাইনি এবং ভীম একই দিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেনজন্মের সময় ইনি গাধার মতো গর্জন করেছিলেনবিভিন্ন লক্ষ্মণ বিবেচনা করে বিদুর ও অন্যান্য ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা এঁকে কুরু বংশের ধ্বংশের কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেন অনেকে তাঁর পিতাকে এই কুলক্ষণযুক্ত পুত্রকে ত্যাগ করার পরামর্শ দেনকিন্তু শেষ পর্যন্ত ইনি রাজ-পরিবারেই প্রতিপালিত হন

ধৃতরাষ্ট্রের ১০০টি পুত্রের মধ্যে ইনি ছিলেন সবচেয়ে বড়পাণ্ডুর মৃত্যুর পর পঞ্চপাণ্ডবদেরকে ধৃতরাষ্ট্র হস্তিনাপুরে আনেনপাণ্ডবদের সাথে দুর্যোধন এবং তাঁর অন্যান্য ভাইয়েরা শিক্ষাগ্রহণ করেনএই সময় দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীম, দুর্যোধনসহ তাঁর অপর ভাইদের নিগৃহীত করতেন বলে- দুর্যোধন তাঁকে ঘৃণা করতেনতাছাড়া ভীম গদাযুদ্ধে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করলে- দুর্যোধন ঈর্ষাবশত একদিন খেলার সময় ভীমকে বিষ পান করানভীম বিষের প্রভাবে অজ্ঞান হয়ে পড়লে দুর্যোধন তাঁকে গঙ্গায় নিক্ষেপ করেনপরে ভীমকে বাসুকি নাগালোকে নিয়ে যান এবং সেখান থেকে বিষের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে ভীম আবার ফিরে আসেন

ধৃতরাষ্ট্র সকল রাজকুমারদের অস্ত্র শিক্ষার জন্য দ্রোণাচার্যকে নিয়োগ করেনশিক্ষা শেষে দুর্যোধন ও ভীম পরস্পরকে গদা দ্বারা আক্রমণ করলে দ্রোণাচার্যের আদেশে অশ্বত্থামা তা নিবারণ করেন যুদ্ধস্থলে অনাহুত কর্ণ এসে যুদ্ধের প্রার্থনা জানালে, কৃপাচার্য ও পাণ্ডবেরা তাঁকে বংশপরিচয়হীন বলে অপমান করেনপরে দুর্যোধন তাঁকে অঙ্গরাজ্যে অভিষিক্ত করেনশিক্ষাশেষে দ্রৌণাচার্য গুরুদক্ষিণা স্বরূপ দুর্যোধন ও তাঁর ভাইদেরকে দ্রুপদ রাজাকে ধরে আনার জন্য বললে- তারা অগ্রসর হন কিন্তু তাতে তাঁরা ব্যর্থ হলে-পাণ্ডবরা তাঁদেরকে রক্ষা করেন

পাণ্ডবদের ক্রমবর্ধমান শ্রীবৃদ্ধিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে দুর্যোধন তাঁর মামা শকুনি ও কর্ণের পরামর্শে পাণ্ডবদেরকে জতুগৃহে পুড়িয়ে মারার জন্য প্রেরণ করেনকিন্তু বিদুরের সহায়তায় তা ব্যর্থ হয় দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় অর্জুন লক্ষ্যভেদ করে দ্রৌপদীকে লাভ করেন- কিন্তু দুর্যোধন ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেনধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের খাণ্ডবপ্রস্থসহ অর্ধ রাজত্ব দান করলে, অচিরেই পাণ্ডবরা এই অঞ্চলকে একটি সমৃদ্ধশালী রাজ্যে পরিণত করেনদুর্যোধন এতে ঈর্ষান্বিত হয়ে শকুনির সাহায্যে কপট পাশাখেলার আয়োজন করেনএই খেলায় যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীসহ রাজ্য হারানপাশা খেলায় দ্রৌপদীকে জয় করার পর ইনি দ্রৌপদীকে রাজসভায় আনার আদেশ দেনদ্রৌপদী আসতে অস্বীকার করলে- দুর্যোধনের আদেশে দুঃশাসন রজঃস্বলা দ্রৌপদীর চুলধরে সভাস্থলে আনেনকর্ণের পরামর্শে দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ শুরু করলে কৃষ্ণ অলৌকিক ক্ষমতা দ্বারা দ্রৌপদীর বস্ত্রকে এত সুদীর্ঘ করে দেন যে, দুঃশাসন উক্ত কাপড় খোলা আরম্ভ করে শেষ করতে ব্যর্থ হনদুর্যোধন দ্রৌপদীকে তাঁর উরুর উপর বসতে আদেশ করলে- ভীম ক্রুদ্ধ হয়ে দুর্যোধনের উরুভঙ্গ করার প্রতিজ্ঞা করেন উল্লেখ্য একবার মহাদেব দুর্যোধনকে বর দেবার সময় নগ্ন হয়ে আসতে বলেনদুর্যোধন এই সময় একটি কৌপিন পড়ে আসেন এরপর মহাদেব তাঁর নগ্ন গায়ে দৃষ্টি বুলালে- দুর্যোধনের শরীর অভেদ্য হয়কিন্তু কৌপিন পড়ে থাকার জন্য তাঁর উরুসহ মাজা অভেদ্যগুণ হতে বঞ্চিত হয়

পাশা খেলার শেষে ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের রাজ্য ফিরিয়ে দিলে শকুনি দ্বিতীয়বার কপট পাশা খেলায় যুধিষ্ঠিরকে পরাজিত করেন এবং খেলার শর্তানুসারে পাণ্ডবেরা বার বত্সর বনবাস ও এক বত্সর অজ্ঞাতবাসে যানপাণ্ডবরা দ্বৈতবনে অবস্থানকালে দুর্যোধন মৃগয়ার অছিলায় পাণ্ডবদের দুর্দশা দেখতে এসে গন্ধর্বরাজ চিত্রসেনের দ্বারা নিগৃহীত হলে পাণ্ডবরা তাঁকে রক্ষা করেনএই সময় আত্মগ্লানিতে দুর্যোধন প্রায়োপবেশন করেনপরে পাতালবাসী দানবেরা কুরুপাণ্ডব যুদ্ধে জয়লাভের ভরসা দিলে ইনি এই অঙ্গীকার ত্যাগ করেনএরপর ইনি বৈষ্ণব যজ্ঞ করেন বিরাটরাজ গৃহে পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসকালে-দুর্যোধন বিরাটকে দুর্বল মনে করে তাঁর গবাদি পশু হরণ করলে- বৃহন্নলারূপী অর্জুন দুর্যোধনের বাহিনীকে পরাজিত করেন

বার বত্সর বনবাস ও এক বত্সর অজ্ঞাতবাস শেষ করে পাণ্ডব ও কৌরবেরা যুদ্ধের আয়োজন শুরু করেনএই সময় কৃষ্ণের সমর্থন লাভের জন্য অর্জুন ও দুর্যোধন প্রায় একই সময়ে কৃষ্ণের কাছে আসেনএঁদের আসার বিষয় অবগত হয়ে কৃষ্ণ ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকেনদুর্যোধন আগে এসে কৃষ্ণের ঘুম ভাঙার অপেক্ষা করতে থাকলে- অর্জুন সেখানে উপস্থিত হনঅর্জুন কৃষ্ণের পাদদেশে কৃতাঞ্জলিপুটে অপেক্ষা করতে থাকলে কৃষ্ণ কপট নিদ্রা ত্যাগ করে প্রথমে অর্জুনের দিকে দৃষ্টিপাত করেন কৃষ্ণ উভয়পক্ষকেই আশ্বাস দেন যে তিনি যুদ্ধ ক্ষেত্রে কোন পক্ষের হয়েই অস্ত্র ধারণ করবেন নাতবে কৃষ্ণ স্বয়ং এক পক্ষে থাকবেন এবং তাঁর দশ লক্ষ নারায়ণী সৈন্য অপর পক্ষকে প্রদান করবেনএই দুইয়ের মধ্যে কে কোনটি চায় তা কৃষ্ণ জানতে আগ্রহ প্রকাশ করলে- দুর্যোধন নারায়ণী সৈন্য প্রার্থনা করেন ফলে কৃষ্ণ পাণ্ডবদের পক্ষে যোগদান করেন

পাণ্ডবদের প্রাপ্য রাজ্য প্রদানের জন্য অনুরোধ করার জন্য কৃষ্ণ হস্তিনাপুরে গেলে, দুর্যোধন কৃষ্ণকে বন্দী করার চেষ্টা করলে- কৃষ্ণ বিশ্বরূপ প্রদর্শন করে দুর্যোধনকে নিরস্ত করেনএকসময় যুধিষ্ঠির যুদ্ধ এড়াবার জন্য তাঁর পাঁচ ভাইয়ের জন্য পাঁচটি গ্রাম প্রার্থনা করলে দুর্যোধন তাও প্রত্যাখ্যান করেনফলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে দেখা দেয় যুদ্ধের পূর্বে দুর্যোধন উলুকের দ্বারা পাণ্ডবদের প্রতি কটুবাক্য বর্ষণ করানঅন্যায় যুদ্ধে অর্জুনপুত্র অভিমন্যুকে হত্যা করার সময় সপ্তরথীদের মধ্যে দুর্যোধন ছিলকর্ণবধের পর কৃপাচার্য সন্ধির পরামর্শ দিলে দুর্যোধন তা প্রত্যাখ্যান করেনযুদ্ধের ১৮ দিনে দুর্যোধনের সকল সৈন্য নিহত হলে- ইনি পালিয়ে দ্বৈপায়ন হ্রদে যানমায়া দ্বারা জলের স্তম্ভ তৈরি করে সেখানে লুকিয়ে থাকেনএই সময় দুর্যোধনের পক্ষের তিন সেনাপ্রধান অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য ও কৃতবর্মা যুদ্ধের পরামর্শ করতে এলে- তিনি পরদিনের জন্য এই আলোচনা স্থগিত রাখতে বলেনএই আলোচনা কয়েকজন শিকারী শুনে পাণ্ডবদের কাছে এসে দুর্যোধনের অবস্থানের কথা জানানপাণ্ডবরা সেখানে এলে, ভীমের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন উল্লেখ্য ইনি ভীমকে হত্যা করার জন্য তের বত্সর এক লৌহ মূর্তির উপর গদা প্রহারের অভ্যাস করেছিলেনসরস্বতী নদীর দক্ষিণ প্রান্তে উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়গদা যুদ্ধে ভীম অত্যন্ত বলশালী হলেও দুর্যোধন অত্যন্ত কৌশলী ছিলেনকৃষ্ণের ইক্তি ভীম অন্যায়ভাবে দুর্যোধনের উরুতে আঘাত করে তা ভেঙে দেনউল্লেখ্য গদা যুদ্ধে কটি দেশের নিম্নে আঘাত করা অন্যায় বলে বিবেচিত হতউরু ভঙ্গের পর ভীম তাঁর বাম পা দিয়ে দুর্যোধনের মাথা নিষ্পেষণ করেনএই অন্যায় যুদ্ধ দেখে উপস্থিত বলরাম ভীমকে হত্যা করতে অগ্রসর হলে কৃষ্ণ তাঁকে নিবারণ করেনদুর্যোধন এই অন্যায় যুদ্ধের জন্য কৃষ্ণকে তিরস্কার করেন

পাণ্ডবেরা মৃতপ্রায় দুর্যোধনকে পরিত্যাগ করে চলে গেলে, সেখানে কৃপাচার্য, কৃতবর্মা ও অশ্বত্থামা আসেন এরপর দুর্যোধন অশ্বত্থামাকে সেনাপতি হিসাবে নিয়োগ করেন এবং ভীমের ছিন্নমুণ্ডু আনার নির্দেশ দেনএই তিনজনই রাত্রিকালে পাণ্ডব শিবিরে প্রবেশ করে ঘুমন্ত সকলকেই হত্যা করেনএই সময় পঞ্চপাণ্ডব কৃষ্ণ ও সাত্যকি অনত্র্য থাকায় তাঁরা রক্ষা পানঅশ্বত্থামা দুর্যোধনকে এই সংবাদ প্রেরণ করলে আনন্দ চিত্তে প্রাণত্যাগ করেনঅস্ত্রাঘাতে মৃত্যুর জন্য ইনি স্বর্গলাভ করেন