গন্ধর্ব
হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে- দেবতুল্য জাতি বা উপদেবতা বিশেষ।

বিষ্ণুপুরাণের মতে, ঘোর তপস্যায় নিমগ্ন থাকা অবস্থায় ব্রহ্মা একবার ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েন। এর ফলে তাঁর মনে ক্রোধের জন্ম হয়। এই ক্ষুধা ও ক্রোধ থেকে জন্ম লাভ করেছিল- রাক্ষস। এই সৃষ্টির জন্য ব্রহ্মা দুঃখিত হলে, তাঁর চার মাথা থেকে কেশ অপসৃত হয়। এই কেশ থেকে জন্ম হয় সর্পকূল। এরপর ব্রহ্মার তপস্যার ফলে সৃষ্টি হয় বাক্। গীতরূপে এই বাক্ প্রকাশের সময় সৃষ্টি হয় গন্ধর্ব জাতির।

বৈদিক যুগে গন্ধর্বরা স্বর্গের উচ্চশ্রেণীর উপদেবতা নামে সম্মানিত ছিল। পরে এদের সংখ্যা অত্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ায় এরা নিম্নশ্রেণীর দেবতায় পরিণত হয়। এরা দেবতাদের সহচর, সোমরসের রক্ষাকর্তা, সোমরসের প্রস্তুতকারক ছিল। সোমরস বিভিন্ন রোগের ঔষধ হিসাবে বিবেচিত হত। এই কারণে এরা স্বর্গীয় বৈদ্য নামে পরিচিত ছিল। এরা সূর্যের অশ্ব পরিচালনা করতো এবং অগ্নি ও বরুণের দাস ছিল।

এদের সমাজে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ছিল। বেদোত্তরকালে অপ্সরাদেরকে এদের স্ত্রী হিসাবে বিবেচনা করা হতো। ইন্দ্রের সভায় এরা সভাগায়ক হিসাবে গান পরিবেশনের সময় সঙ্গিনী হিসাবে অপ্সরারা এদের সাথে থাকতো। এরা অনেক সময় সুন্দরী নারীর আকর্ষণে মাটিতে নেমে এসে প্রেম করতো এবং প্রচলিত রীতি অনুসরণ না করে পরস্পরের সম্মতিতে বিবাহ করতো। গন্ধর্বদের এই আচরণ থেকেই পরবর্তীকালে গন্ধর্ব বিবাহের প্রচলন হয়।

অন্যমতে কশ্যপের দুই স্ত্রী মুনি ও প্রধার গর্ভে যথাক্রমে ষোলটি ও দশটি গন্ধর্বের জন্ম হয়েছিল। হরিবংশের মতে স্বারোচিষ মন্বন্তরে অরিষ্ঠার গর্ভে গন্ধর্বের জন্মগ্রহণ করেছিল। এরা গুহ্যলোকে ও বিদ্যাধরলোকের মধ্যে বসবাস করতো। এরা ছিল অত্যন্ত রূপবান। বলা হয়ে থাকে স্বর্গে এদের চেয়ে কেউ সুদর্শন নয়। এরা স্বর্গীয় গায়ক হিসাবে সবচেয়ে খ্যাতিবান। এরা অবাধে আকাশে বিচরণ করতে পারতো। মহাকাব্য ও পুরাণাদিতে দেখা যাব, গান্ধর্বরা ইন্দ্র, যম, বরুণ, ব্রহ্মা, কুবেরর সভায় থাকতেন। কুবেরে সভায় বেশকিছু সঙ্গীতজ্ঞ গন্ধর্বের নাম পাওয়া যায়। এঁরা হলেন- বিশ্বাবসু, হাহা, হুহু, তুম্বুরু, পর্বত, শৈলনু, চিত্রসেন, চিত্ররথ। রামায়ণের সুন্দরকাণ্ডের মতে- মহেন্দ্রপর্বতে গন্ধর্বরা বাস করতো। এদের পুত্ররা রাবণের সাথে রামের যুদ্ধের সময়, রামের সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। রামায়ণের উত্তরাকাণ্ড থেকে জানা যায়, গন্ধর্বরা সিন্ধুনদের উভয় তীরে গন্ধর্বদেশের পত্তন ঘটিয়েছিল। ন্ধরবরা যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী ছিল। এই দেশ রক্ষার জন্য ৩ কোটি গন্ধর্ব যোদ্ধারা নিয়োজিত ছিল। মহর্ষি গর্গ রামচন্দ্রকে এই দেশ জয় করার জন্য উপদেশ দিয়েছিলেন। উত্তরে রাম বলেছিলেন যে, ভরত তাঁর দুই পুত্র তক্ষ ও পুষ্কলকে নিয়ে গন্ধর্বদের দেশ জয় করবেন।  ভগবত পুরাণে পাওয়া যায়, ভরত তাঁর এই দুই পুত্রকে সাথে দ্বিগ্বিজয়ে বের হন। এই সময় তিনি গান্ধার জয় করেন। পরে এই দুই পুত্র তাঁদের নামে তক্ষশীলা ও পুষ্কলবতী নগর স্থাপন করেছিলেন।

মহাভারতে আছে- অক্ষক্রীড়ায় যুধিষ্ঠির রাজ্যচ্যুত হলে, অন্যান্য ভাইদের সাথে ইনি ১৩ বৎসরের জন্য বনবাসে যান। এই সময়ে কিরাতবেশী মহাদেব- এর সাথে তাঁর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মহাদেব সন্তুষ্ট হয়ে অর্জুনকে পাশুপাত অস্ত্র প্রদান করেন। এরপর ইন্দ্র, বরুণ, কুবের ও যমের সাথে সাক্ষাৎ লাভ করেন এবং তাঁদের শ্রেষ্ঠ অস্ত্রসমূহ লাভ করেন। এরপর তাঁর পিতা ইন্দ্র তাঁকে স্বর্গে নিয়ে যান। সেখানে ইনি গন্ধর্বরাজ চিত্রসেনের কাছে নৃত্যগীতি শিক্ষা করেন। দ্বৈতবনে থাকাকালে গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন দুর্যোধনকে বন্দী করেন। এই কারণে চিত্রসেনের সাথে অর্জুনের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে অর্জুন চিত্রসেনকে পরাজিত করে দুর্যোধনকে উদ্ধার করেন। মহাভারতের সৌপ্তিক পর্বে বলা হয়েছে- কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যে সকল যোদ্ধা নিহত হয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই পূর্বজন্মে গন্ধর্ব ছিলেন। এছাড়া দ্রৌপদীর গর্ভজাত যে পাঁচ সন্তান অশ্বত্থামার হাতে নিহত হয়েছিলেন, তাঁদের সবাই পূর্বজন্মে গন্ধর্ব ছিলেন।