পরশুরাম
ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা
{
|
অবতার
|
হিন্দু দৈবসত্তা
|
দৈবসত্তা
|
আধ্যাত্মিক সত্তা
|
বিশ্বাস
|
প্রজ্ঞা
|
জ্ঞান |
মনস্তাত্ত্বিক বিষয়
|
বিমূর্তন
|
বিমূর্ত-সত্তা
|
সত্তা
|}
হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে–
ত্রেতা যুগে আবির্ভুত বিষ্ণুর তিন অবতারের মধ্যে ইনি ছিলেন দ্বিতীয়
এবং বিষ্ণুর দশ অবতারের মধ্যে ষষ্ঠ।
ইনি জমদগ্নীর ঔরসে রণুকার গর্ভে জন্মেছিলেন।
এঁদের পাঁচ পুত্রের মধ্যে পরশুরাম ছিলেন কনিষ্ঠ।
অপর চার পুত্ররা হলেন–
বসু,
বিশ্ববসু,
বৃহদ্ভানু,
বৃহত্কণ্ব।
উদ্ধত ক্ষত্রিয়দের হাত থেকে ব্রাহ্মণদের রক্ষা করার জন্য বিষ্ণু পরশুরাম হিসাবে
পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
ভৃগু বংশে জন্ম বলে ইনি ভার্গব নামে পরিচিতি লাভ করেন।
একবার চিত্ররথ নামক রাজাকে সস্ত্রীক জলবিহার করতে দেখে এঁর মা রেণুকা কামার্তা হয়ে পড়েন। জমদগ্নি এই দৃশ্য দেখে, তাঁর পুত্রদেরকে মাতৃহত্যার জন্য আদেশ করেন। এঁর চার পুত্রের ভিতর একমাত্র পরশুরাম পিতার আদেশে কুঠার দিয়ে তাঁর মায়ের শিরোশ্ছেদ করেন। এতে জমদগ্নি খুশি হয়ে পরশুরামকে বর প্রার্থনা করতে বললে– পরশুরাম মায়ের পুনর্জন্ম, মাতৃহত্যাজনিত পাপ এবং মাতৃহত্যা স্মৃতি বিস্মৃত হওয়া, ভাইদের জড়ত্বমুক্তি, নিজের দীর্ঘায়ু ও অজেয়ত্ব লাভের বর প্রার্থনা করেন। জমদগ্নি তাঁকে সেই বরই প্রদান করেন।
মাতৃহত্যাজনিত পাপে, এঁর হাতের কুঠার হাতের সাথে সংযুক্ত হয়ে গিয়েছিল। ব্রহ্মকুণ্ডে স্নান করার পর, তাঁর হাত থেকে এই কুঠার বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। পরে ইনি মানুষের কল্যাণের জন্য ব্রহ্মকুণ্ডের জল মুক্ত করে দেন। এই প্রবাহিত জলই পরবর্তী সময়ে ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিতি লাভ করে। এরপর একদিন জমদগ্নির পুত্রদের অনুপস্থিতিতে, কার্তবীর্য আশ্রমে এসে হেমধেনুর বাছুর অপহরণ করে এবং আশ্রম তছনছ করে। পরশুরাম ফিরে এসে এই ঘটনা শুনে কার্তবীর্যকে অনুসরণ করে আক্রমণ করেন এবং ভল্লের আঘাত কার্তবীর্যকে হত্যা করেন। এর ফলে কার্তবীর্যের পুত্ররা পুনরায় আশ্রমে হানা দিয়ে তপোমগ্ন জমদগ্নিকে হত্যা করে।
কার্তবীর্যের পুত্ররা তাঁর পিতা জমদগ্নীকে হত্যা করেছে, এই সংবাদ পাওয়ার পর পরশুরাম ক্ষত্রিয় নিধন করার উদ্যোগ নেন। মহাভারতের মতে তিনি একুশবার পৃথিবীকে নিঃক্ষৎত্রিয় করেন। এই সময় ক্ষত্রিয়দের রক্ত দিয়ে পাঁচটি হ্রদ তৈরি করেন। পরে সেই হ্রদের রক্ পিতৃলোকের তর্পণ করেছিলেন। এরপর ঋচীক প্রভৃতি পিতৃগণ এসে এই কাজের প্রশংসা করেন এবং বর প্রার্থনা করতে বলেন। উত্তরে পরশুরাম বলেন যে, "হে পিতৃগণ! যদি প্রসন্ন হইয়া ইচ্ছানুরূপ বর প্রদানে অনুগ্রহ করেন, তাহা হইলে ক্রোধে অধীর হইয়া ক্ষৎত্রিয়বংশ ধ্বংস করিয়া যে পাপরাশি সঞ্চয় করিয়াছি, সেই সকল পাপ হইতে যাহাতে মুক্ত হই এবং এই শোণিতময় পঞ্চহ্রদ অদ্যাবধি পৃথিবীতে তীর্থস্থান বলিয়া যাহাতে প্রখ্যাত হয়, এরূপ বর প্রদান করুন।' পিতৃগণ সেই বর প্রদান করে, ক্ষত্রিয়দের হত্যা বন্ধ করার কথা বলে যান। এরপর পরশুরাম ক্ষত্রিয়নিধন বন্ধ করে দেন।
[সূত্র : মহাভারত। আদিপর্ব। দ্বিতীয় অধ্যায়। সমন্তপঞ্চকোপাখ্যান।]
এরপর তিনি যজ্ঞের দ্বারা কশ্যপকে পৃথিবী দান করে, মহেন্দ্রপর্বতে বসবাস শুরু করেন।
ভীষ্ম ও দ্রোণ পরশুরামের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করেন। তাঁর ভাই বিচিত্রবীর্যের বিবাহের জন্য, কাশীরাজ তাঁর তিন কন্যাকে (অম্বা, অম্বিকা ও অম্বালিকা) ভীষ্ম স্বয়ংবর সভা থেকে অপহরণ করেন। এর ভিতর ঘটনাক্রমে অম্বা ভীষ্মকে জানান যে- ইনি পূর্বেই শাম্বরাজকে মনে মনে পতিত্বে বরণ করেছেন। ভীষ্ম অম্বাকে শাম্ববরাজের কাছে যাবার অনুমতি দিলেও, অপহৃতা কন্যা বলে শাম্বরাজ তাঁকে প্রত্যাখান করেন। এরপর অম্বা ভীষ্মের কাছে ফিরে এসে তাঁকে বিবাহ করতে অনুরোধ করলে, ভীষ্ম তা প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর অম্বা পরশুরামের শরণাপন্ন হন। পরশুরাম এসে ভীষ্মকে এই বিয়েতে রাজী করাতে ব্যর্থ হলে, পরশুরামের সাথে ভীষ্মের ঘোরতর যুদ্ধ হয়। বহুদিন যুদ্ধের পরও পরশুরাম ভীষ্মকে পরাজিত করতে অসমর্থ হয়ে পুনরায় মহেন্দ্র পর্বতে ফিরে যান এবং অস্ত্রলাভের জন্য মহাদেবের তপস্যা করেন।
তপস্যায় খুশি হয়ে মহাদেব পরশুরামকে জগতের কল্যাণের জন্য ও মহাদেবের সন্তুষ্টির জন্য দেব-শত্রুদের ধ্বংস করার আশীর্বাদ প্রদান করেন। এরপর তিনি মহাদেবের আজ্ঞায় বহু দানব হত্যা করেন। সে কারণে, মহাদেব তুষ্ট হয়ে তাঁকে পরশু নামক অস্ত্র দান করেন। নীচ জাতীয় পুরুষ বিবেচনায় দ্রৌণাচার্য কর্ণকে শিষ্য হিসাবে গ্রহণ না করায়, ইনি ব্রাহ্মণের বেশে পরশুরামের কাছে ব্রহ্মাস্ত্র শিক্ষার জন্য যান। একবার পরশুরাম কর্ণের উরুতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় কর্ণকে অলর্ক কীট আক্রমণ করে। গুরুর ঘুম ভেঙে যাবার ভয়ে কর্ণ যন্ত্রণা নিরবে সহ্য করতে থাকেন। পরে পরশুরাম ঘুম ভেঙে উঠে সকল বিষয় দেখে এবং কর্ণের কষ্ট সহিষ্ণুতা লক্ষ্য করে তাঁর প্রকৃত পরিচয় জানতে চান। অবশেষে কর্ণ ব্রাহ্মণ নয় জেনে এবং গুরুকে প্রতারণা করার জন্য অভিশাপ দিয়ে বললেন যে, কপট উপায়ে ব্রহ্মাস্ত্র লাভের জন্য কার্যকালে কর্ণ এই অস্ত্রের কথা ভুলে যাবেন।
রামায়ণে আছে- বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরামের মৃত্যুর পূর্বেই সপ্তম অবতার রামের জন্ম হয়। রামচন্দ্রের হরধনু ভঙ্গের পর সীতাসহ যখন অযোধ্যায় ফিরে আসছিলেন, তখন পরশুরাম হরধনু ভঙ্গের সংবাদ লোকমুখে শুনতে পান। এতে ইনি রাগান্বিত হয়ে রামের মুখোমুখি হন এবং গর্বের সাথে বলেন যে- তাঁর কাছে বৈষ্ণব ধনু আছে এবং এই বৈষ্ণব ধনু ভঙ্গ করে প্রকৃত বীরত্ব দেখানোর জন্য রামকে আহ্বান করেন। একই সাথে তিনি বলেন যে- রাম এতে অসমর্থ হলে- তাঁর সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে। রাম পরশুরামের কাছ থেকে বৈষ্ণব ধনু নিয়ে পরশুরামের তপস্যার্জিত সমস্ত লোক বিনষ্ট করেন। ফলে পরশুরামের তেজ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এরপর ইনি নির্বীর্য হয়ে রামচন্দ্রকে পূজা ও প্রদক্ষিণ করে, আবার মহেন্দ্র পর্বতে ফিরে যান।