বামাবোধিনী পত্রিকা
নারীদের জন্য প্রকাশির মাসিক পত্রিকা।

তৎকালীন বঙ্গদেশের অধিকাংশ বাঙালি গৃহবধূরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিল। উমেশচন্দ্র দত্তের নেতৃত্বে কিছু ব্রাহ্ম তরুণ, গৃহবধুদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এই সূত্রে ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে 'বামাবোধিনী সভা' প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সভার মুখপত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল 'বামাবোধিনী পত্রিকা'। এই পত্রিকা প্রকাশে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন যশোহরের বসন্তকুমার ঘোষ। তাঁর উদ্যোগেই এই পত্রিকা প্রকাশের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছিল। তাঁর এ ভাবনাকে প্রবলভাবে সমর্থন করেছিলেন ক্ষেত্রমোহন দত্ত এবং  উমেশচন্দ্র দত্ত। বসন্তকুমার চেয়েছিলেন যশোহর থেকে এই পত্রিকা প্রকাশিত হবে। কিন্তু অসুস্থতার জন্য বসন্তকুমার দত্ত পত্রিকার দায়িত্ব নিতে পারলেন না। পরে এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন উমেশচন্দ্র দত্ত।

১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে(ভাদ্র, ১২৭০ বঙ্গাব্দ), 'বামাবোধিনী পত্রিকা'টির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। বলাইবাহুল্য, পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন উমেশচন্দ্র দত্ত। পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো
কলকাতার সিমুলিয়ায় ১৬নং রঘুনাথ ষ্ট্রীটস্থ বামাবোধিনী সভার কার্যালয় থেকে। বামাবোধিনী পত্রিকা’র প্রথম সংখ্যায় যে রচনাগুলি ছিল সেগুলি হলো- উপক্রমণিকা; স্ত্রীলোকদিগের বিদ্যাশিক্ষার আবশ্যিকতা; ভূগোল; বিজ্ঞান (জল বহুরূপী); স্বাস্থ্যরক্ষা (গৃহ পরিষ্কার) ও নীতি উপদেশ (কবিতা)। এই সংখ্যার সকল লেখাই লিখেছিলেন- উমেশচন্দ্র দত্ত। পত্রিকাটি মুদ্রিত হয়েছিল মৃজাপুর স্ট্রিট হলওয়েল লেনের মধুরানাথ তর্করত্নের প্রাকৃত যন্ত্র থেকে। সে সময় এর মূল্য ছিল চার আনা।

প্রথম সংখ্যা প্রকাশের পর, এই পত্রিকা নিয়ে বিপুল আগ্রহের সৃষ্টি হয়। এই কারণে দ্বিতীয় সংখ্যাট বর্ধিত আকারে, উৎকৃষ্টতর কাগজ ও মুদ্রণযন্ত্রে প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই কারণে, পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যা ছাপা হয়েছিল বহুবাজারের স্টানহোপ যন্ত্রের কার্যাধ্যক্ষ গোপালচন্দ্র বসুর তত্ত্বাবধানে।

উমেশচন্দ্র দত্তের সম্পাদনায় এই পত্রিকাটি কিছুদিন প্রকাশের পর, কাজের জন্য তিনি কলকাতার বাইরে চলে যান। এই সময় পত্রিকাটি বন্ধের উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু পত্রিকার এই অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেন ক্ষেত্রমোহন দত্ত ও বসন্তকুমার দত্ত। এঁদের দুই জনের সম্পাদনায় পত্রিকা-প্রকাশ অব্যাহত থাকলেও প্রধান সম্পাদক হিসেবে উমেশচন্দ্র দত্ত ছিলেন। এই সহযোগী সম্পাদকদ্বয়ের প্রচেষ্টায় পত্রিকার আকার এবং ছাপার মান বৃদ্ধি পেয়েছিল। তাই পত্রিকার মূল্য ৪ আনা থেকে ১০ আনা করা হয়েছিল। পরে পর্যায়ক্রমে ১২ আনা এবং ১৩ আনা করা হয়েছিল। এই সময় কাজের সুবিধার জন্য আদি ব্রাহ্মসমাজ মুদ্রণযন্ত্রে পত্রিকাটি ছাপা হতো।

১২৭৬ খ্রিষ্টাব্দে বসন্তকুমার দত্ত কাজের জন্য কলকাতা থেকে বাঁকিপুরে চলে যান। এই সময় উমেশচন্দ্র দত্ত পত্রিকার যাবতীয় ভার গ্রহণ করেন। এই সময় উমেশচন্দ্র দত্ত এবং অন্যান্য কয়েকজন মিলে 'ইস্ট ইন্ডিয়া প্রেস' নামে একটি মুদ্রণযন্ত্র স্থাপন করেন। এই যন্ত্র থেকে ৪-৫ বছর বামবোধিনী প্রকাশিত হয়েছিল। এই সময় সম্পাদক অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাঁদের মুদ্রণযন্ত্রও বিকল হয়ে গিয়েছিল। এই কারণে পত্রিকাটি  বন্ধ হয়ে যায়। এই সময় স্বর্ণময়ী নামক এক দেশীয় রাণী পত্রিকার জন্য ২০০ টাকা দান করেন। এই টাকায় পত্রিকাটির কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়া ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট রামশঙ্কর সেন পত্রিকাটি প্রকাশের জন্য বিশেষ সাহায্য করেছিলেন। শেষ পর্ন্ত ১২৮৪ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ১২৮৫ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাস থেকে পত্রিকাটি পুনরায় প্রকাশিত হতে থাকে।

এই সময় কেশব চন্দ্র সেনের নাবালক জ্যেষ্ঠা কন্যা সুনীতি দেবীর সঙ্গে কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ ভূপ বাহাদুরের বিবাহ হয়। এর ফলে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। কেশব অনুগামী উমেশচন্দ্র কোন পক্ষ অবলম্বন করবেন এই নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। পরে কেশবের বিরুদ্ধপন্থী সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করেন। এই হট্টগোলে পত্রিকার ১৭৭ সংখ্যার পরে এক বছর বন্ধ থাকে। এরপর ১৭৮তম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ১২৮৬ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে।

১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত উমেশচন্দ্র দত্তের সম্পাদনায় পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল। এই বছরে  উমেশচন্দ্র দত্ত মৃত্যুবরণ করলে, পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্ব নেন সুকুমার দত্ত ও  তারাকুমার কবিরত্ন। এই দুই সম্পাদকের সম্পাদনায় পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯০৭ থেকে ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। এরপর ১৯০৯ থেকে ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পত্রিকাটি সম্পাদনা করেছিলেন- সূর্য্যকুমার চট্টোপাধ্যায়, কুমারী ঊষাপ্রভা দত্ত, সন্তোষকুমার দত্ত এবং দেবকুমার দত্ত। ১৯১৪ থেকে ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সম্পাদনা করেন দেবকুমার দত্ত,  কুমারী ঊষাপ্রভা দত্ত ও ক্ষেত্রগোপাল মুখোপাধ্যায়। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে সম্পাদক হন আনন্দকুমার দত্ত। তাঁর সময়ে পত্রিকাটির জনপ্রিয়তা হ্রাস পায় এবং ১২শ কল্প ৩য় ভাগ (বৈশাখ - চৈত্র ১৩২৯, ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দ) প্রকাশিত হওয়ার পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়।

এই পত্রিকার বিভিন্ন ভাগ ও পর্বগুলো যেভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, ব্রজেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর 'বাংলা সাময়িক পত্র' গ্রন্থে যে বর্ণা দিয়েছেন তার চিত্র নিচে দেখানো হলো।

এ পত্রিকায় মূলত ধর্ম, ন্যায়শাস্ত্র, বিজ্ঞান, ইতিহাস, পারিবারিক চিকিৎসা, শিশুদের প্রতি যত্ন নেয়া, নারীশিক্ষা ইত্যাদি অনেক বিষয়ের ওপর প্রতিবেদন ছাপা হতো। এসকল লেখায় বিশেষভাবে জোর দেওয়া হতো নারীদেরকে সন্দেহ ও কুসংস্কারমুক্ত করার ক্ষেত্রে। এই পত্রিকায় নারীদের লেখাকে প্রাধান্য দেওয়া হতো। এই পত্রিকার সূত্রে সেকালের বেশি কিছু ভালো লেখিকা তৈরি হয়েছিল। সেকালের বাংলার নারীদের অগ্রগতিতে এই পত্রিকা বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল।


সূত্র: