বজ্রযান
বৌদ্ধ ধর্মের একটি বিশেষ মার্গ বা পথ।
এই মতে বজ্র শব্দের অর্থ হলো শূন্য বা
নির্বাণ। তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের মন্ত্রযানের সঙ্গে মহাসুখবাদের সংযোগের ফলে
এই মতবাদের সৃষ্টি হয়েছিল।
বঙ্গদেশের সমতট অঞ্চলে এই মতের
প্রসার লাভ করেছিল।
এই মতে পরমদেবতা হলেন আদিবুদ্ধ। এই পরমদেবতা হলেন আত্মা এবং পরমাত্মা। বজ্রযানের এই
মত উপনিষদ থেকে গ্রহণ করা হয়েছিল।
পরমব্রহ্মের মতো পরমদেবতা একই সাথে নির্গুণ এবং সগুণ। এই পরমদেবতার উদ্দেশ্যে
একেকেন্দ্রিক ধ্যান হলো বোধিচিত্ত। কঠোর যোগাচারের দ্বারা ইন্দ্রিয়কে দমন করে
চিত্তকে দৃঢ় করা হয়। এই অবস্থায় সাধক বোধিজ্ঞান লাভ করেন। বজ্রযানে
বিশ্বাসীরা মনে করেন নির্বাণের পর শূন্য, বিজ্ঞান
ও মহাসুখ লাভ হয়। তাই শূন্যতার পরম জ্ঞানই নির্বাণ।
বজ্রযানে এই জ্ঞানকে বলা হয় নৈরাত্মা।
এই নৈরাত্মার মধ্যে আত্মা লয়প্রাপ্ত হয়। বোধিচিত্ত যখন
নৈরাত্মার আলিঙ্গনবদ্ধ হয়ে
নৈরাত্মাতেই লীন হয়, তখন উৎপন্ন হয় মহাসুখ। এঁদের মতে চিত্তের পরমানন্দ ভাব
সৃষ্টি হয় এককেন্দ্রিক ধ্যান থেকে। তাই এ জ্ঞান হলো বোধিচিত্ত।
আর বোধিচিত্তই হলো বজ্র। কঠোর যোগের দ্বারা ইন্দ্রিয়
দমিত হলে চিত্ত বজ্রের ন্যায় দৃঢ় হয়। এ অবস্থায় সাধক বোধিজ্ঞান লাভ করেন।
আর এই বোধিজ্ঞানকে আশ্রয় করে নির্বাণ লাভের পথই হলো বজ্রযান।
বজ্রযানের সাধকরা মনে করেন- আদিবুদ্ধ বজ্রসত্ত্বরূপ, জ্ঞান এবং করুণার
আধার। বৌদ্ধ তন্ত্রে বজ্রসত্ত্ব হলো
হেরুক (হে বজ্র)। এঁর প্রকৃত নাম বজ্রসত্তাত্মিকা, বজ্রবরাহী, প্রজ্ঞা,
প্রজ্ঞাপারমিতা। একে আবাহন করা হয় 'হুং' বীজমন্ত্রে।
এই মতে বজ্র হলো পুরুষ আর প্রজ্ঞা হলো নারী। সূর্যকে সবসময় পুরুষ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। এই পুরুষ নারীর
মিলনে সৃষ্টি হয় পরম আনন্দময় দশা। এই অবস্থায় প্রাপ্ত চেতনাই হলো বোধিচিত্ত।
এক্ষেত্রে সনাতন হিনদু ধর্মের তান্ত্রিক মতের সাথে বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। নারী রূপ
কমল (প্রজ্ঞা) এবং বজ্র রূপ পুরুষের মৈথুনকে বলা হয় 'বজ্রকমল সংযোগ'। এই সংযোগে
সৃষ্টি হয় বোধিচিত্ত।
যোগশাস্ত্রের হটযোগ বৌদ্ধতন্ত্রে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। এই যোগে বিন্দু তথা
বীর্যধারণ এবং তা ষট্চক্রের ঊর্ধে প্রেরণ করা হয়। এই সাধনায় ব্যবহার করা হয়
সাধনসঙ্গিনী। এক্ষেত্রে উপযুক্ত নারী হিসেবে ব্যবহার করা হয় ডোমনী, চণ্ডালিনী ও
ব্রাহ্মণী।
বিভিন্ন বৌদ্ধগ্রন্থে মন্ত্রকে বলা হয়, ধারিণী। কারণ মন্ত্রের দ্বারা কল্যাণ বা
অকল্যাণ ধারণ করা যায়। বৌদ্ধের জীবদ্দশায় মন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল। সাধারণ মানুষকে
মন্ত্রের দ্বারা মুগ্ধ করে বৌদ্ধ তাঁর আদর্শ প্রচার করতে চেয়েছিল। খ্রিষ্টীয়-পূর্ব
দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে নানা ধরনের বৌদ্ধমন্ত্র রচিত হতে থাকে। কালক্রমে
তন্ত্র-ভিত্তিক ক্ষান্তি-পারমিতা, দাম-পারমিতা প্রভৃতি তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে। এ সকল
তত্ত্ব থেকে উৎপন্ন হয় বৌদ্ধ-তান্ত্রিক দেবী। এই সময় থেকে নানা ধরনের ধারিণী বা
বীজমন্ত্রের উদ্ভব ঘটে।
এই মতে আদিবুদ্ধের সাধনা করা হয়। বজ্রযানে বলা হয়, গুরু ছাড়া বোধিজ্ঞান লাভ
এবং নির্বাণ লাভ সম্ভব নয়। তাই গুরুকে নির্বাণ লাভের জন্য পথের সারথি হিসেবে
বিবেচনা করা হয়। বজ্রযানে গুরুকে অবলম্বন করাটা অপরিহার্য।
বৌদ্ধ দার্শনিক ও গুরু
অতীশ দীপঙ্করের গুরু ছিলেন
জেতারি। তিনি এ বিষয়ে বহু গ্রন্থও রচনা করেন। সপ্তম শতাব্দীর বৌদ্ধপণ্ডিত
শান্তিদেব ও শান্তরক্ষিত
বজ্রযান বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচনা করেন।
বজ্রযানের অনুসারীরা মনে করেন। মানুষের
ভৌতিক দেহ পঞ্চস্কন্ধ দ্বারা গঠিত। এই পঞ্চস্কন্ধের রয়েছে রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা,
সংস্কার, ও বিজ্ঞান নামক পাঁচটি গুণ।
এই পঞ্চস্কন্ধের প্রতীকী দেবতারা হলেন
বৈরোচন, রত্নসম্ভব, অমিতাভ, অমোঘসিদ্ধি ও অক্ষোভ্য। ধ্যানের প্রয়োজনে এসকল দেবতারা
সৃষ্টি হয়েছিল। তাই এরা সবাই ধ্যানী বুদ্ধ। এদের শক্তি হলো বজ্রাধাতেশ্ধরী মামকী,
পাণ্ডরা, আর্যতারা বা তারা ও লোচনা। এদের বোধিসত্তরা হলেন চক্রপাণি, রত্নপাণি,
পদ্মপাণি (অবলোকিতেশ্বর), বিশ্বপাণি ও বজ্রপাণি। এছাড়া এরা ভূত-পিশাচ,
মাতঙ্গী পিশাচী ডাকিনী যোগীনি
প্রভৃতি লৌকিক সংস্কারজাত অপশক্তির পূজা করে। এই মতের আর্যতারা নামক দেবী
শ্যামতারা, শ্বেততারা, উগ্রতারা প্রভৃতি নামে পূজিতা হয়ে থাকেন।
সাধকের দেহস্থ পঞ্চস্কন্ধের সক্রিয় অংশকে কুল বলা হয়।
এই কুল দ্বারা সাধকের প্রাথমিক পরিচয় ছাড়াও অন্তর্নিহিত যোগশক্তির প্রভাব
সম্পর্কেও জানা যায়। কুলগুলি হচ্ছে ডোম্বী, নটী, রজকী, চন্ডালী ও ব্রাহ্মণী। এই
পঞ্চকুল আবার পাঁচটি শক্তি বা প্রজ্ঞার রূপ বিশেষ। বৈষ্ণব পদকর্তা চণ্ডীদাসের
রজকী বজ্রযান মতে তাঁর কুলেরই সূচক। বজ্রযানে সাধনমার্গ নানা দেব-দেবী, মন্ত্র,
পূজা ও আচার-অনুষ্ঠানে আকীর্ণ।
বজ্রযানী সাধকদের বলা হত সিদ্ধ অথবা
সিদ্ধাচার্য। এঁদের সংখ্যা ছিল ৮৪।
তন্ত্রবিদ্যা, সাংখ্যদর্শন এবং যোগাচার সম্মিলিতভাবে ভারতীয় ধর্মাদর্শ এবং
জীবনাচারে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল নানাভাবে। মূলত এই তিনটিই নাস্তিক মত।
ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এই মতগুলোকে ঈশ্বরভাবনার সাথে যুক্ত করে দিয়েছিলেন। অন্যদিকে এরা
আবার অবজ্ঞা করে এই মতগুলোকে লোকায়ত নাম দিয়েছিলেন। গীতা, মহাভারত ও পৌরাণিক
গ্রন্থে সাংখ্যকে গ্রহণ করা হয়েছে তাত্ত্বিক বিষয় হিসেবে। অন্যদিকে যোগ হয়ে উঠেছে
তাত্ত্বিক বিষয়ের সাধন-প্রক্রিয়াগত জ্ঞান।
খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর দিকে বজ্রযানী
বৌদ্ধ মতালম্বীদের একটি অংশ এই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। কালক্রমে এই মতাদর্শ
ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল উত্তর ভারতের পূর্ব-মধ্যাঞ্চলে। এঁদের দ্বারাই ধীরে ধীরে
বৌদ্ধ সহজিয়া মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। বজ্রযানী বৌদ্ধদের মধ্যে মন্ত্র-তন্ত্র,
পূজার্চনা, ব্রত-নিয়ম, শাস্ত্রপাঠ ইত্যাদির প্রাবল্য রয়েছে। তবে সহজিয়া বৌদ্ধরা
মনে করেন শাস্ত্রাচার পালন নিরর্থক। তাঁরা মনে করেন প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই বোধি
বা বুদ্ধ আছেন। শুধু সহজ-সাধনায় তাঁকে উপলব্ধি করতে পারলেই মোক্ষলাভ করা যায়।