নাথধর্ম
সমনাম: নাথপন্থা,
সহজিয়া
খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে
বঙ্গদেশে উদ্ভূত ধর্মমত বিশেষ।
নাথ শব্দের অর্থ ‘প্রভু’। প্রভুর দীক্ষান্তে নাথ মতালম্বীরা তাঁদের নামের শেষে
'নাথ' পদবী ব্যবহার করতেন। বিশেষ সাধন
প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মোক্ষ লাভ করাটাই ছিলই নাথ মতাবলম্বীদের প্রকৃত উদ্দেশ্য।
বৌদ্ধ সহজিয়া দর্শনের যোগ সাধনা মিশ্রিত হওয়ার ফলে- সহজিয়া এবং নাথধর্ম একই রকম মনে
হয়। তাঁরা মনে করতেন, সবার আগে প্রয়োজন দেহশুদ্ধি।
সাধনার দ্বারা মহাজ্ঞান লাভের উপযোগী দেহ পরিশুদ্ধ করাকে বলা হতো পরিপক্ক। একমাত্র পরিপক্ক দেহেই শিবশক্তির মিলন ঘটানো
সম্ভব। শুরুর দিকে পরমেশ্বরের সাথে যোগসূত্র হিসেবে যোগসাধনা করা হতো। কালক্রমে দেহ ও মনের
উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য ঋষি এবং সাধারণ মানুষ যোগের আশ্রয় নিয়েছিল। এই বিচারে
যোগ দুটি ধারায় বিকশিত হয়েছিল। এর একটি ছিল লৌকিক ধারা, অপরটি শাস্ত্রীয় ধারা।
নাথগুরুরা মনে করতেন, অ-বিদ্যা বা অ-জ্ঞান মানবজীবনে তত্ত্বজ্ঞানের পথে বাধা। তাই
জীবনযাপনে অ-বিদ্যা
বিতাড়িত করে মহাজ্ঞানে সিদ্ধি লাভের মাধ্যমে অগ্রসর হওয়াটাকে তাঁরা সবার উপরে স্থান
দিয়েছিলেন। তাঁদের মতে আধ্যাত্মিক মহাজ্ঞানের সাধনার মধ্য দিয়ে অমরত্ব লাভ
করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন যোগসাধনা।
এই ধর্ম তন্ত্র, হঠযোগ, সহজিয়া, শৈবাচারের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল। এই মতাদর্শীরা মনে
করতেন- হঠযোগ এবং কায়া সাধনার মধ্য দিয়ে অমরত্ম লাভ করা যায়।
ভারতীয় ধর্মের বিকাশ এবং ক্রমবির্তনের ধারায় উদ্ভব হয়েছিল যোগ সাধনা। এর উদ্দেশ্য
ছিল সাধনার দ্বারা দেহ ও মনের উপর নিজের ইচ্ছাশক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করা। এটি ভারতীয়
ধর্মদর্শনে ষষ্ঠ দর্শনের মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। আর্যদের ভারতবর্ষে প্রবেশের আগেই
সিন্ধু-সভ্যতায় এর চর্চা ছিল বলে ধারণা করা হয়। মহেঞ্জোদায় প্রাপ্ত পাওয়া
যোগীমূর্তির নমুনা পাওয়া যাওয়ার পর এমনটাই ধারণা করা হয়। বৈদিকযুগের ঋষিরা
উচ্চমার্গের সাধনার অঙ্গ হিসেবে যোগকে গ্রহণ করেছিলেন। তবে পতঞ্জলি মুনি এর একটি
শাস্ত্রীয় রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
খ্রিষ্টীয়
৮ম থেকে একাদশ শতাব্দীর ভিতরে মহাযান শাখার সাথে শৈবধর্ম যুক্ত হয়ে নাথপন্থীদের
হয়েছিল।
আনুমানিক ১০৮৯ বা ১০৯০ খ্রিষ্টাব্দে
গোপালভট্টের রচিত 'বল্লালচরিত্রম্'-এ নাথপন্থীদের উৎপত্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা
যায় যায়। এই গ্রন্থের উত্তর খণ্ডের ৫৬-৬০ শ্লোকে জানা যায়- রুদ্রের (শিব) ঔরসে
সূর্যবতীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিন্দুনাথ। বিন্দুনাথের অপর নাম যোগনাথ। এই
যোগনাথ থেকে নাথ জাতির উদ্ভব হয়েছিল। তবে নাথধর্মের প্রবক্তা হিসেবে মৎসেন্দ্রনাথকে
উল্লেখ করা হয়ে থাকে। স্কন্ধপুরাণ মতে- ভৃগুবংশের জনৈক ব্রাহ্মণের গণ্ডযোগে একটি
পুত্রসন্ধান লাভ করেন। এই সন্তান পিতৃমাতৃঘাতী হবে, এমন আশংকায় ব্রাহ্মণ এই
পুত্রকে সমুদ্রের জলে নিক্ষেপ করেন। এই সময় একটি বৃহদাকার সামুদ্রিক মাছ শিশুটিকে
গিলে ফেলে। এই সময় শিব ও পার্বতী ক্ষিরোদসাগরের একটি দ্বীপে ছিলেন। এই সময় পার্বতীর
অনুরোধে শিব যোগশাস্ত্র বর্ণনা করছিলেন। মাছের পেট থেকে শিশুটি এই শাস্ত্রকথা শুনে
ফেলেন। তাই শিব উক্ত মাছের পেট থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করে নিজের কাছে রাখলেন। শিব
তাঁর নাম দিয়েছিলেন মৎসেন্দ্রনাথ বা মীননাথ। মৎসেন্দ্রনাথের সময়
সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগ বলে মনে করেন ড. মুহম্মদ
শহীদুল্লাহ।
মৎসেন্দ্রনাথ প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর,
শিব যোগশাস্ত্র প্রচারের জন্য তাঁকে লোকালয়ে পাঠান। পরে এই যোগধর্মকে প্রতিষ্ঠা দেন
মৎসেন্দ্রনাথের শিষ্য
গোরক্ষনাথ।
গোরক্ষনাথ তাঁর সাধনার দ্বারা অলৌকিক ক্ষমতার হয়েছিলেন। গোরক্ষনাথের দ্বারাই
নাথধর্ম বিকশিত হয়েছিল। সম্ভবত গোরক্ষনাথের দর্শনের সূত্রে বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্ম থেকে
নাথ ধর্ম পৃথক হয়ে গিয়েছিল।
নাথযোগীরা তিন দিন ধরে দীক্ষা নেন। প্রথম দিন গুরু শিষ্যের চুল কেটে দেন এবং দ্বিতীয় দিন তার কানে
কুণ্ডল পরিয়ে দেন। তৃতীয় দিনের দীক্ষা ছিল উপদেশমূলক। এতে প্রথমে হরপার্বতী, ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও গণেশের পূজা হয়, পরে গোরক্ষনাথের পূজা
হতো। সবশেষে ভাঙ ও মদমাংস দিয়ে আকাশভৈরবের পূজা হয়। এসময় সারারাত দীপ জ্বালিয়ে নানা
ধরনের অনুষ্ঠান করা হয়। এই অনুষ্ঠানের নাম ‘জ্যোৎ-জাগান’।
নাথযোগীদের মাথায় থাকে জটা। সর্বাঙ্গ ছাই-ভস্ম
মাখতো। এঁরা কানে ছিল কড়ি ও কু্ণ্ডল। এ ছাড়া এঁরা গলায় সুতা, বাহুতে রুদ্রাক্ষের
মালা ব্যবহার করতো। এঁরা হাতে ত্রিশূল, পায়ে নূপুর, কাঁধে ঝুলি ও কাঁথা বহন করতো।
এঁদের কুলবৃক্ষ ছিল বকুল এবং প্রধান আহার্য ছিল কচুশাক।
বিবাহের ক্ষেত্রে নাথধর্মীরা হিন্দু আচার-অনুষ্ঠান অনুসরণ করে থাকে। তাদের মধ্যে বাল্যবিবাহ প্রচলন
রয়েছে। বিবাহ-বিচ্ছেদের রীতি নেই। স্ত্রী বন্ধ্যা কিংবা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে স্বামী অন্যত্র বিবাহ করতে পারে, অন্যথায় নয়।
এদের মধ্যে বিধবাবিবাহ নিষিদ্ধ। নাথযুগীরা মৃতদেহ কবর দেয়, তবে সৎকারের ক্ষেত্রে হিন্দু আচার-অনুষ্ঠান পালন করে।
বৌদ্ধধর্মের মহাযান শাখার শূন্যবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নাথধর্ম। আদি দেবতা
ছিলেন নিরঞ্জন। নিরঞ্জনের সাথে যুক্ত হয়েছিল শৈবশক্তির ভাবনা। তাই শিবকে নাথপন্থীরা
আদি গুরু হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। শিবকে তাঁর বলতেন আদিনাথ। নিরঞ্জনের আজ্ঞায় শিব
গৌরীকে পত্নী হিসেবে পেয়েছিলেন।
বাংলাদেশে বিকশিত নাথ ধর্মের যোগীরা তিনটি শ্রেণিতে বিভাজিত হয়ে
গিয়েছিল। এই শ্রেণি তিনটি হলো-
- সাধারণ যোগী বা গৃহীযোগী: নাথপন্থীদের
মধ্য সংসারী যোগী। এদের পেশা ছিল কৃষি এবং সুতা থেকে কাপড় তৈরি করা।
তন্তুবায়দের গ্রাম বাংলায় জোলা নামে অভিহিত হতো। অঞ্চল বিশেষে এরা অন্যান্য
পেশার সাথে যুক্ত ছিল। যেমন- রংপুর অঞ্চলের নাথরাচুন উৎপাদন করতো।
- ভবঘুরে যোগী: এরা ভবঘুরের মত জীবন-যাপন
করতো। এদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন ছিল ভিক্ষাবৃত্তি।
- সন্ন্যাসী যোগী: নাথ ধর্মানুসারে ধ্যান
এবং যোগের মাধ্যমে পরমশান্তির অন্বষেণ করতো। বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্মমতে যে ৮৪ জন
সিদ্ধার কথা পাওয়া যায়।
অসিত কুমার
বন্দোপাধ্যায় তার বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত গ্রন্থে নাথ সাহিত্য সম্পর্কিত
সূচনা বক্তব্যে বলেছেন নাথ ধর্মে ৯ জন গুরুর কথা। বৌদ্ধ তান্ত্রিকেরা তাদের
চুরাশিজন সিদ্ধাচার্যের সংগে এই ৯ জনেরও পুজা করতেন। নাথ ধর্ম সম্পর্কিত
পুস্তকাদিতে এই ৯জনের নামধাম উল্লেখ থাকলেও এক গ্রন্থের বর্ণনার সাথে অন্য গ্রন্থের
হুবহু কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। সে সব গ্রন্থে উল্লেখিত নামগুলো যেভাবে পাওয়া
যায় তা হচ্ছে-পূর্বে গোরক্ষনাথ, উত্তরাপথে জলন্ধর (জ্বালামুখী তীর্থ), দক্ষিণে
নাগার্জুন (গোদাবরী নদীর কাছে), পশ্চিমে দত্তাত্রেয়, দক্ষিণ-পশ্চিমে দেবদত্ত,
উত্তর-পশ্চিমে জড়ভরত, কুরুক্ষেত্র ও মধ্যদেশে আদিনাথ এবং দক্ষিণ-পূর্বে
সমুদ্রোপকূলে মৎসেন্দ্রনাথ। মোটামুটি এই ৯জন হচ্ছেন নাথ গুরু। মারাঠী কাহিনীতে
পাওয়া যায় আদিনাথ শিবের কাছে ‘মহাজ্ঞান’(পিণ্ডদেহে মোক্ষলাভ বা অমরত্ব লাভ)
শিক্ষাগ্রহণ করেন শিব ঘরণী পার্বতী, মৎসেন্দ্রনাথ ও জালন্ধরিপাদ। বাংলাদেশে মীননাথ
হিসেবে খ্যাত এই মৎসেন্দ্রনাথের দু’জন শিষ্য রয়েছে তারা হলেন গোরক্ষ নাথ ও চৌরঙ্গী
নাথ। জালন্ধরিপাদ’র দুই শিষ্য কানিফা (বাংলার কানুপা) ও ময়নামতী। এ ছাড়া গোরক্ষ
নাথের দুই শিষ্য হচ্ছেন গোপীনাথ ও চর্পটিনাথ। এ সকল শিষ্যের আবার অনেক শিষ্য পরম্পরা
রয়েছে।
এদের ধর্মাদর্শন ভিত্তিক সাহিত্যকে বলা হয়-
নাথসাহিত্য।
তথ্যসূত্র :
- গোপীচন্দ্রের গান। আশুতোষ সম্পাদিত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৬১
- গোপীচন্দ্রের গান। প্রথম খণ্ড। বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য সংকলিত। দীনেশচন্দ্র
সেন ও বসন্তরঞ্জন রায় সম্পাদিত। কলকাত বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২২। দ্বিতীয় খণ্ড ১৯২৪।
- গোরক্ষ বিজয়। শেখ ফয়জুল্লা। মুনসী আবদুল জরিম সাহিত্য-বিশারদ কর্তৃক
সম্পাদিত। বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষৎ মন্দি র।
- বাংলাভাষার ইতিবৃত্ত/ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। মাওলা ব্রাদ্রার্স, মার্চ
২০০০।
- ভাষার ইতিবৃত্ত। আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। নভেম্বর ১৯৯৪।
- মীন-চেতন। নলিনীকান্ত ভট্টাচার্য সম্পাদিত। ঢাকা সাহিত্য পরিষৎ। ১৩২২
- হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা/হরপ্রসাদ
শাস্ত্রী। (বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ১৩২৩
- হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা-সংগ্রহ (দ্বিতীয় খণ্ড)। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য
পুস্তক পর্ষৎ, নভেম্বর ২০০০/বি