গোরক্ষনাথ
নাথধর্
মমতাদর্শের আদি প্রচারক
মৎস্যেন্দ্রনাথের
শিষ্য এবং কণ্ফোট ও অওঘড় পন্থীদের আদি গুরু।
তারানাথের মতে বৌদ্ধ গোরক্ষনাথের নাম ছিল অনঙ্গবজ্রা। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর
মতে তাঁর প্রকৃত নাম ছিল রমনবজ্রা।
নাথ মতাদর্শের আদি প্রচারক
মৎস্যেন্দ্রনাথের
শিষ্য ছিলেন গোরক্ষনাথ। খ্রিষ্টীয় সপ্তম
শতাব্দী মধ্যভাগে
মৎস্যেন্দ্রনাথ
জীবিত ছিলেন। এই বিচারে গোরক্ষনাথকে খ্রিষ্টীয়
সপ্তম শতাব্দী মধ্যভাগের পরের সাধক হিসেবে
বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
ড. গ্রীয়ার্সনের মতে তিনি অষ্টম শতাব্দীতে তিনি বর্তমান
ছিলেন।
তিব্বতী গ্রন্থমতে, তিনি রাখাল ছিলেন। তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়ে গোরক্ষনাথ
নামে পরিচিতি লাভ করেন।
গোরক্ষনাথে জন্মস্থান নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। নেপালিরা
মনে করেন যে, গোরক্ষনাথ পশ্চিম নেপালের এক গুহায়
বাস করতেন। নাসিকের যোগীরা বলেন যে, গোরক্ষনাথ নেপাল বাস করতেন
পরে সেখান থেকে পাঞ্জাবে গিয়েছিলেন এবং পরে ভারতের নানা স্থান পরিভ্রমণ
করেন। আধুনিককালে নাথ পন্থের ঐতিহাসিক ও গবেষক ড.মোহন সিং বলেন যে, ‘প্রকৃতপক্ষে
গোরক্ষ নাথ পেশোয়ার অঞ্চলেই আবির্ভূত হয়েছিল।’ বঙ্গদেশের গবেষকরা
মনে করেন- গোরক্ষনাথের জন্মভূমি ছিল পূর্ববঙ্গে। তাঁর শিষ্য ছিলেন
হাড়িপা ও ময়নামতী। আবার ময়নামতীর পুত্র গোপীচন্দ্র ছিলেন হাড়িপার শিষ্য।
বৌদ্ধ মতে তিনি পূর্বে তান্ত্রিক বৌদ্ধমতের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। পরে তিনি বৌদ্ধ মত
ত্যাগ করে শৈব যোগী হন। তাই নেপালি যোগীরা গোরক্ষনাথকে
দল ত্যাগী বলে তার নিন্দা করে থাকেন।
গোরক্ষনাথের অলৌকিক ক্ষমতা এবং পার্বতীর সাথে তাঁর দ্বন্দ্বের
বিষয়ে-
আশুতোষ ভট্টাভর্যের সম্পাদিত গোপীচন্দ্রের গান (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়,
১৯৬১)-এর ভূমিকায় লিখেছেন-
একদিন পার্বতী শিবকে
জিজ্ঞাসা করিলেন, 'তোমার শিষ্যরা বিবাহ করিয়া সংসার ধর্ম আচরণ করে না কেন?'
শিব বলিলেন, 'তাহারা ব্রহ্মচারী যোগ-সাধক, তাহারা বিবাহ করিলে তাহাদের ধর্ম কি
করিয়া রক্ষা পাইবে?' পার্বতী বলিলেন, 'আচ্ছা, আমি তোমার শিষ্যদের চরিত্রবল
পরীক্ষা করিয়াদেখিতে চাই, তাহাদিগকে আমার নিকট ডাকিয়া আন।' শিব তাহার পাঁচজন
শিষ্য সিদ্ধাকে তাহার নিকট ভোজনেব নিমন্ত্র করিয়া পাঠাইলেন। তাহারা সকলেই ভোজন
করিতে বসিল। পার্বতী তাহাদিগকে পরীক্ষা করিবার নিমিত্ত মদনমোহিনী রূপ ধারণ করিয়া
তাহাদিগকে অন্ন পরিবেষণ করিতে লাগিলেন। তাহাকে দেখিয়া সকল সিদ্ধারই মন বিচলিত
হইল, কেবলমাত্র গোরক্ষনাথ অটল রহিলেন। অন্যান্য সিদ্ধা বা নাথগুরুদিগকে পার্বতী
অভিশাপ দিলেন; কিন্তু গোরক্ষনাথকে কিছুই করিতে পারিলেন না বলিয়া মনে মনে
লজ্জিত হইলেন; কি উপায়ে গোরক্ষনাথেরও মন বিচলিত করিতে পারেন, তাহার নানা কৌশল
অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। কিন্ত গোরক্ষ নিজের চরিত্রবলে তাঁহার সকল পরীক্ষাতেই
উত্তীর্ণ হইয়া গেলেন। এমন কি, গোরক্ষনাথ পার্বতীর চক্রান্ত বুঝিতে পারিয়া
তাঁহাকেই অভিশাপ দিয়া এক রাক্ষসীতে পরিণত করিয়া দিলেন। প্রতিদিন একটি মনুষ্য
আহার করিয়া তাঁহার দিন কাটিতে লাগিল। এদিকে শিব পত্নীর বিরহে নিতাস্ত কাতর হইয়া
পড়িলেন, ক্রমে তাহার অন্বেষণে বাহির হইলেন। গোরক্ষনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ
হইলে তাহাকে জিজ্ঞাস! করিলেন, 'কোথা গেল মোর নারী তুহ্মি কি করিলা।' গোরক্ষনাথ
শিবের কথা শুনিয়া। হাসিয়া উঠিলেন, বলিলেন,
ভাঙ ধুতুরা খাও কি বলিব তোরে।
কোথাত হারাইছ নারী ধর আসি মোরে ॥'
এরপর শিব গোরক্ষনাথের
সাহায্যে পার্বতী উদ্ধার করেন। এরপর শিব গোরক্ষনাথের উপর প্রতিশোধের জন্য, নানা
কৌশল অবলম্বন করা শুরু করেন। এই সময় গন্ধর্ব নামক এক রাজার কন্যা 'বিরহিণী'
পতিলাভের আশায় শিবপূজা শুরু করেন। শিব এই কন্যাকে তাঁর আকাঙ্ক্ষা কিন জানতে ইচ্ছা
করলে, বিরহিণী জানান যে, তিনি গোরক্ষনাথকে স্বামী হিসেবে পেতে চান। এমন বিবাহে
গোরক্ষকে অপদ্স্থ করা যাবে এমনটা ভেবে, শিব বিরহিণীকে সেই বরই দিলেন। কিন্তু
গোরক্ষনাথ এই বিষয়টি বুঝতে পেরে- যোগবলে নিজেকে ছয় মাসের শিশুতে পরিণত হয়ে-
বিরহিণীকে মা বলে ডাকেন। এর ফলে বিরহিণী গোরক্ষনাথকে সন্তানতুল্য বিবেচনা করে এই
বিবাহের ইচ্ছা ত্যাগ করেন।
ধারণা করা হয়, গোরক্ষনাথের জন্মভূমি ছিল
পূর্ববঙ্গে। তাঁর শিষ্য ছিলেন হাড়িপা ও ময়নামতী। আবার ময়নামতীর পুত্র গোপীচন্দ্র
ছিলেন হাড়িপার শিষ্য।
মৎস্যেন্দ্রনাথ
ও গোরক্ষনাথকে নিয়ে ‘গোরক্ষ-বিজয়’ রচিত হয়েছিল। এই গ্রন্থ থেকে জানা যায়, একবার
তাঁর গুরু মীননাথ আত্মবিস্মৃত হয়ে কদলী নামক প্রমীলারাজ্যে প্রবেশ করেন এবং
সেখানকার ষোলোশত রমণীর ভোগচক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। গুরুর এই দশা থেকে উদ্ধারের জন্য
গোরক্ষনাথ নর্তকীর বেশে ওই রাজ্যে যান। এরপর মৃদঙ্গবোলের সঙ্গত দ্বারা গুরুকে তাঁর
যোগশিক্ষা স্মরণ করিয়ে দেন। এই সঙ্কেত বুঝতে পরে
মৎস্যেন্দ্রনাথের
চৈতন্য হয় এবং এই ভোগচক্র থেকে উদ্ধার পান। এই কাহিনি গোরক্ষবিজয় নামে অভিহিত হয়ে
থাকে। এই কাহিনি অনুসরণে একাধিক গ্রন্থ পাওয়া যায়। তবে গোরক্ষবিজয়ের প্রথম রচয়িতা
ছিলেন শেখ ফয়জুল্লাহ। এই ধারায় হাড়িপা-ময়নামতী-গোপীচন্দ্রকে নিয়ে রচিত হয়েছিল
‘মানিকচন্দ্র রাজার গান’। এই রচনা ‘গোপীচন্দ্রের গান’ নামে লিখিত ও মৌখিক ধারার
একাধিক বাংলা কাব্য পাওয়া যায়। বাংলা কাব্য ছাড়া সংস্কৃত ভাষায় গোরক্ষ-সংহিতা ও
গোরক্ষ-সিদ্ধান্ত নামে দুটি গ্রন্থ আছে।
গোরক্ষনাথের মাধ্যমে বঙ্গদেশ-সহ ভারতের
বিভিন্ন স্থানে গোরক্ষনাথের মাধ্যমে নাথধর্ম প্রচারিত হয়। বিভিন্ন স্থানে তাঁর নামে
মন্দির স্থাপিত হয়েছিল। এবং এসব মন্দিরে এক সময় তাঁকে পূজা করা হতো। কথিত আছে শিবের
অঙ্গ থেকে গোরক্ষনাথের জন্ম আছে। এই কারণে শিবলিঙ্গের মাধ্যমে গোরক্ষপূজা হয়ে
থাকে। রাজশাহীর যোগীর গোফা-র একটি কক্ষে শিবলিঙ্গ ও ত্রিশূল আছে। উল্লেখ্য, যোগীর
ধ্যানের স্থানকে ‘গোফা’ বলে।
বগুড়ার যোগীর ভবনের চারটি মন্দিরের মধ্যে
একটি গোরক্ষনাথের বলে মনে করা হয়। দিনাজপুরের গোরক্ষকূপে এক চূড়াবিশিষ্ট যে
তিনটি মন্দির আছে, তার ভিতরে একটি গোরক্ষনাথের মন্দির। এর অন্ধকার কক্ষে শিবলিঙ্গ ও
কালীমূর্তি সংরক্ষিত আছে। দমদমের গোরক্ষ বাসুলীর তিনটি মন্দিরের মধ্যে গোরক্ষনাথের
মন্দিরে একটি প্রজ্জলিত ধুনি আছে। গোরক্ষভক্তরা মনে করেন এই ধুনি স্বয়ং গোরক্ষনাথ
প্রজ্বলিত করেছিলেনে।
দিনাজপুর-রংপুর অঞ্চলের রাজবংশী ও পলিয়া কৃষককুল তাঁকে গো-রক্ষক দেবতারূপে পূজা
করে। তাঁদের মতে গোরক্ষ গৃহপালিত গবাদিপশুকে সব রকমের রোগ থেকে রক্ষা করে থাকেন।
ভক্তরা গোরক্ষনাথের প্রতীক একটি কাঠের মূর্তিকে তেল-সিঁদুর মাখিয়ে গোয়ালঘরে
স্থাপন করেন। এই মূর্তিকে এঁরা নিয়মিত পূজা করেন। এ পূজায় মূলত এক কূলা ধান নিবেদন
করতে হয়। একসময় বৃহত্তর পাবনায় জেলায় ‘গোরক্ষনাথের ব্রত’ এবং ময়মনসিংহ, ঢাকা
প্রভৃতি অঞ্চলে ‘গোরক্ষনাথের শিরনি’ নামে উৎসব পালন করা হতো। ময়মনসিংহের এই উৎসবে,
বাছুর জন্মের ৩০ দিন পর গাভীর দুধ দোহন করে গাঢ় করে জ্বাল দেওয়া হতো। এরপর গুড়
মিশিয়ে সেই দুধ দিয়ে গরু ও বাছুরের মূর্তি, নাড়ু, স্বস্তিকা প্রভৃতি তৈরি করা
হতো। সন্ধ্যার সময় নির্বাচিত একটি রাখাল বালক কলাপাতায় করে ওই ভোগ গোয়ালঘরের এক
কোণে রেখে আসতো। গোরক্ষবিশ্বাসীরা মনে করতো, রাতের বেলা গোরক্ষনাথ এসে ওই ভোগ গ্রহণ
করেন। মূলত গাভীর দুধ বেশি পাওয়ার জন্য এরা গোরক্ষনাথের 'শিরনি আচার'টি পালন করতো।
কোনো কোনো অঞ্চলে গাভীর বাছুর জন্ম নেয়ার একুশ দিন পর এ আচারটি পালিত হয়। এ
উপলক্ষে স্থানীয়ার বয়াতিরা গোয়ালঘরের মাঝ দুয়ারে বসে পাঁচালি গান পরিবেশন করতো। এই পাঁচালিটি ‘গুক্খের ধারের পাঁচালী’ নামে পরিচিত।
গোরক্ষনাথের ধর্মদর্শন-ভিত্তিক অপর একটি মতবাদ হলো-
কণ্ফোট ।
তথ্যসূত্র
:
- ভারতীয় উপাসক-সম্প্রদায়। দ্বিতীয় খণ্ড। অক্ষয় কুমার
দত্ত। কলকাতা। ১২৮৯।