গোরক্ষনাথ
নাথমতালম্বী সাধক।

নাথ মতাদর্শের আদি প্রচারক
মৎস্যেন্দ্রনাথের শিষ্য ছিলেন গোরক্ষনাথ। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দী মধ্যভাগে  মৎস্যেন্দ্রনাথ জীবিত ছিলেন। এই বিচারে গোরক্ষনাথকে খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দী মধ্যভাগের পরের সাধক হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তিব্বতী গ্রন্থমতে, তিনি রাখাল ছিলেন। তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়ে গোরক্ষ নামে পরিচিতি লাভ করেন।

ধারণা করা হয়, গোরক্ষনাথের জন্মভূমি ছিল পূর্ববঙ্গে। তাঁর শিষ্য ছিলেন হাড়িপা ও ময়নামতী। আবার ময়নামতীর পুত্র গোপীচন্দ্র ছিলেন হাড়িপার শিষ্য। মৎস্যেন্দ্রনাথ ও গোরক্ষনাথকে নিয়ে ‘গোরক্ষ-বিজয়’ রচিত হয়েছিল। এই গ্রন্থ থেকে জানা যায়, একবার তাঁর গুরু মীননাথ আত্মবিস্মৃত হয়ে কদলী নামক প্রমীলারাজ্যে প্রবেশ করেন এবং সেখানকার ষোলোশত রমণীর ভোগচক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। গুরুর এই দশা থেকে উদ্ধারের জন্য গোরক্ষনাথ নর্তকীর বেশে ওই রাজ্যে যান। এরপর মৃদঙ্গবোলের সঙ্গত দ্বারা গুরুকে তাঁর যোগশিক্ষা স্মরণ করিয়ে দেন। এই সঙ্কেত বুঝতে পরে মৎস্যেন্দ্রনাথের চৈতন্য হয় এবং এই ভোগচক্র থেকে উদ্ধার পান। এই কাহিনি গোরক্ষবিজয় নামে অভিহিত হয়ে থাকে। এই কাহিনি অনুসরণে একাধিক গ্রন্থ পাওয়া যায়। তবে গোরক্ষবিজয়ের প্রথম রচয়িতা ছিলেন শেখ ফয়জুল্লাহ। এই ধারায় হাড়িপা-ময়নামতী-গোপীচন্দ্রকে নিয়ে রচিত হয়েছিল ‘মানিকচন্দ্র রাজার গান’। এই রচনা ‘গোপীচন্দ্রের গান’ নামে লিখিত ও মৌখিক ধারার একাধিক বাংলা কাব্য পাওয়া যায়। বাংলা কাব্য ছাড়া সংস্কৃত ভাষায় গোরক্ষ-সংহিতা ও গোরক্ষ-সিদ্ধান্ত নামে দুটি গ্রন্থ আছে।

গোরক্ষনাথের মাধ্যমে বঙ্গদেশ-সহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে গোরক্ষনাথের মাধ্যমে নাথধর্ম প্রচারিত হয়। বিভিন্ন স্থানে তাঁর নামে মন্দির স্থাপিত হয়েছিল। এবং এসব মন্দিরে এক সময় তাঁকে পূজা করা হতো। কথিত আছে শিবের অঙ্গ থেকে গোরক্ষনাথের জন্ম আছে। এই কারণে শিবলিঙ্গের মাধ্যমে গোরক্ষপূজা হয়ে থাকে। রাজশাহীর যোগীর গোফা-র একটি কক্ষে শিবলিঙ্গ ও ত্রিশূল আছে। উল্লেখ্য, যোগীর ধ্যানের স্থানকে ‘গোফা’ বলে।

বগুড়ার যোগীর ভবনের চারটি মন্দিরের মধ্যে একটি গোরক্ষনাথের বলে মনে করা হয়।  দিনাজপুরের গোরক্ষকূপে এক চূড়াবিশিষ্ট যে তিনটি মন্দির আছে, তার ভিতরে একটি গোরক্ষনাথের মন্দির। এর অন্ধকার কক্ষে শিবলিঙ্গ ও কালীমূর্তি সংরক্ষিত আছে। দমদমের গোরক্ষ বাসুলীর তিনটি মন্দিরের মধ্যে গোরক্ষনাথের মন্দিরে একটি প্রজ্জলিত ধুনি আছে। গোরক্ষভক্তরা মনে করেন এই ধুনি স্বয়ং গোরক্ষনাথ প্রজ্বলিত করেছিলেনে।

দিনাজপুর-রংপুর অঞ্চলের রাজবংশী ও পলিয়া কৃষককুল তাঁকে গো-রক্ষক দেবতারূপে পূজা করে। তাঁদের মতে গোরক্ষ গৃহপালিত গবাদিপশুকে সব রকমের রোগ থেকে রক্ষা করে থাকেন। ভক্তরা গোরক্ষনাথের প্রতীক একটি কাঠের মূর্তিকে তেল-সিঁদুর মাখিয়ে গোয়ালঘরে স্থাপন করেন। এই মূর্তিকে এঁরা নিয়মিত পূজা করেন। এ পূজায় মূলত এক কূলা ধান নিবেদন করতে হয়। একসময় বৃহত্তর পাবনায় জেলায় ‘গোরক্ষনাথের ব্রত’ এবং ময়মনসিংহ, ঢাকা প্রভৃতি অঞ্চলে ‘গোরক্ষনাথের শিরনি’ নামে উৎসব পালন করা হতো। ময়মনসিংহের এই উৎসবে, বাছুর জন্মের ৩০ দিন পর গাভীর দুধ দোহন করে গাঢ় করে জ্বাল দেওয়া হতো। এরপর গুড় মিশিয়ে সেই দুধ দিয়ে গরু ও বাছুরের মূর্তি, নাড়ু, স্বস্তিকা প্রভৃতি তৈরি করা হতো। সন্ধ্যার সময় নির্বাচিত একটি রাখাল বালক কলাপাতায় করে ওই ভোগ গোয়ালঘরের এক কোণে রেখে আসতো। গোরক্ষবিশ্বাসীরা মনে করতো, রাতের বেলা গোরক্ষনাথ এসে ওই ভোগ গ্রহণ করেন। মূলত গাভীর দুধ বেশি পাওয়ার জন্য এরা গোরক্ষনাথের 'শিরনি আচার'টি পালন করতো।

কোনো কোনো অঞ্চলে গাভীর বাছুর জন্ম নেয়ার একুশ দিন পর এ আচারটি পালিত হয়। এ উপলক্ষে স্থানীয়ার বয়াতিরা গোয়ালঘরের মাঝ দুয়ারে বসে পাঁচালি গান পরিবেশন করতো। এটি এই পাঁচালি ‘গুক্খের ধারের পাঁচালী’ নামে পরিচিত। 


তথ্যসূত্র :
চর্যাগীতিকা/মুহম্মদ আবদুল হাই ও আনোয়ার পাশা সম্পাদিত। ষ্টুডেন্ট ওয়েজ। অগ্রহায়ণ ১৪০২।
চর্যাগীতি কোষ/নীলরতন সেন। সাহিত্যলোক।  জানুয়ারি ১৯৭৮।
চর্যাগীতি পরিক্রমা/ড. নির্মল সেন। দে'জ পাবলিশিং, জানুয়ারি ২০০৫।
চর্যাগীতি প্রসঙ্গ/সৈয়দ আলী আহসান। মৌলি প্রকাশনা, জুন ২০০৩।
বাংলাভাষার ইতিবৃত্ত/ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। মাওলা ব্রাদ্রার্স, মার্চ ২০০০।
ভাষার ইতিবৃত্ত। আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। নভেম্বর ১৯৯৪।
হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা/হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। (বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ১৩২৩)
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা-সংগ্রহ (দ্বিতীয় খণ্ড)। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, নভেম্বর ২০০০/বি