পালি
শব্দ ‘থের’-এর অর্থ হলো
স্থবির, স্থিত, স্থিতধী, স্থিতিশীল ইত্যাদি। বৌদ্ধধর্ম মতে যিনি সংসার
ত্যাগ করে ভিক্ষুত্বে উপনীত হন এবং এই অবস্থায় কমপক্ষে দশ বছর নিরন্তর ব্রহ্মচর্য পালনে স্থিতিশীল
থাকেন তাঁকেই বলা হয় ‘স্থবির’ বা ‘থের’।
এই কারণে থেরবাদীদের
অনেক সময় স্থবিরবাদীও বলা হয়।
বুদ্ধ তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর ধর্মমত যেমনটা করতে চেয়েছিলেন, হয়তো তা অনেকাংশে পূরিত
হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা রইলো না। বুদ্ধের যোগ্য শিষ্যদের অনেকে মৃত্যুবরণ
করায়, বুদ্ধের বাণী এবং তার ব্যাখ্যা বিলীন হওয়ার আশংকা তীব্রতর হয়ে উঠেছিল।
এছাড়া অপ্রধান ভিন্ন ভিন্ন শিষ্যদের দ্বারা এর বিকৃতরূপ নিতে শুরু করেছিল। এই
সমস্যা সমাধানের জন্য,
৪৮৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে
মগধের মহারাজ অজাতশত্রুর (৪৯৩-৪৬২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) সহায়তায় অনিরুদ্ধ মহাকাশ্যপ এক
বৌদ্ধসভার আয়োজন করেন। বুদ্ধের বাণী সংগ্রহের কাজ শুরুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এই সভা
থেকে। বৌদ্ধ ইতিহাসে এই সভার নাম দেওয়া হয়েছে 'মহাসঙ্গীতি'। প্রথম মহাসঙ্গীতির
সিদ্ধান্ধ অনুসারে বুদ্ধের অন্যতম শিষ্য আনন্দের নেতৃত্বে সংগৃহীত হয়েছিল ধর্মাংশ
এবং আর বুদ্ধের অপর শিষ্য উপালি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিনায়ংশ। পরে এই দুই সংগ্রহকে
বিষায়ানুসারে ভাগ করে, তৈরি করা হয়েছিল
বিনয়পিটক ও সূত্রপিটক।
পরে সূত্রপিটকের একটি অংশ পৃথক করে অভিধম্মপিটক নামক তৃতীয় পিটক তৈরি করা হয়।
এই তিনটি পিটকের সংকলনই হলো ত্রিপিটক।
প্রথম মহাসঙ্গীতির ১০০ বৎসরে ভিতরে
বৌদ্ধ সাধকেদের ভিতরে তীব্র মতভেদের সৃষ্টি হয়। এই দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য স্থবির যশ
(মতান্তরে স্থবির যজ্ঞ) নামক একজন আচার্য খ্রিষ্ট-পূর্ব ৩৮০-৮৭ অব্দের ভিতরে ব
বৈশালীতে দ্বিতীয় সঙ্গীতির আয়োজন করেন। এই মহাসভার উদ্দেশ্য ছিল বৌদ্ধ সাধকদের
মতভেদের নিরসন করা হয়। কিন্তু সভার বৌদ্ধসাধকরা সবাই একমত হতে না পারায় তা সফল হয়
নি। বরং মতভেদের কারণে স্থবিরবাদী ও মহাসাঙ্ঘিক নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভাজিত হয়ে
যায়। এর ভিতরে রক্ষণশীল স্থবিরবাদীরা থেরোবাদী নামে অভিহিত হতে থাকে।
থেরবাদীদের মূলত বুদ্ধকে মানবিক রূপে
বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু
মহাসাঙ্ঘিকরা বুদ্ধকে অলৌকিক সত্তায় পর্যবশিত করার জন্য প্রচার চালিয়ে যেতে থাকে।
ফলে বৌদ্ধভিক্ষুরা উভয় পন্থীদের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে কৌশাম্বীতে পৃথক একটি সভার আয়োজন
করে। এই সভায় স্পষ্টত থেরবাদী ও মহাসাঙ্ঘিক নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভাজিত হয়ে যায়।
পরবর্তী সময়
মহাসাঙ্ঘিক থেকে
মহাযান ধর্মমতের উৎপত্তি
হয়েছে। এই সময়ের ভিতরে মহাযান ধারার
অনুসারীরা পালি ভাষায় রচিত মূল ত্রিপিটকের অনুবাদ করা শুরু করে। ফলে
সংস্কৃত ভাষাভাষী-সহ অন্যান্য ভাষার মানুষ ত্রিপিটক পাঠ করার সুযোগ লাভ
করে। এই ধারার অনুসারীরা বিনয় পিটকের চিরাচরিত কঠোর নিয়মাবলি বহুলাংশে
শিথিলভাবে মান্য করা শুরু করে।
------
মূলত থেরবাদীরা নিজেদেরকে অবিদ্যা, তৃষ্ণা ও মোহ থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলে। তারা মনে করে যে, ভাবনার (ধ্যান) ভিতর দিয়ে নিজেকে পূর্ণ করা যায় এবং এর মাধ্যমে নির্বাণ লাভই শুধু নয়, নিজেকে নির্বাণোত্তর বুদ্ধস্থানে উন্নীত করা সম্ভব। মহাযান ধারায় সাধনার বিশেষ স্থান দেওয়া হয় বোধিসত্তকে।