লিলিথ

ইহুদি পৌরাণিক চরিত্র। তবে লিলিথের বিষয় প্রথম জানা যায় খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় থেকে পঞ্চম শতাব্দীর ভিতরে রচিত ব্যবলনীয় তালমুদ (আদি ধর্মপুস্তক) থেকে। আসিরিয়ান এবং ব্যাবলিনে প্রচলিত প্রাচীন আক্কাদিয়ান ভাষায় লিলি (lili) এবং লিলিতু (līlītu) শব্দের অর্থ ছিল আত্মা। উল্লেখ্য, সুমেরিয়ান লিলি ছিলেন দানবী। শব্দের উৎপত্তির বিচারে এর সাথে আক্কাদিয়ান লিলু (lilu) শব্দের সাথে তেমন কোনো মিল নেই। ব্রিটিশ ভাষাতাত্ত্বিক Archibald Sayce -এর মতে আক্কাদিয়ান লিলিতু এবং হিব্রু লিলিথ (lilth) - উভয় শব্দই প্রাক্-সেমিটিক ভাষা থেকে ভাষা থেকে আহৃত হয়েছিল। অনেক ভাষাতাত্ত্বিক, লিলিথ-এর আক্ষরিক অনুবাদ করেছেন- ‘অন্ধকারের নারী’ বা ডাইনী। মেসোপটেমিয়া থেকে প্রাপ্ত কীলকলিপিতে লিলিত এবং লিলিতুকে পাওয়া যায় রোগবহনকারী কু-বাতাস। সম্ভবত সুমেরিয়ান ভাষার শব্দ লিল (বাতাস), আক্কাদিয়ান ভাষায় লিল-ইতু কৃতঋণ শব্দ হিসেবে গৃহীত হয়েছিল।

১৮০০-১৭৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের
Burney Relief

খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দের দিকে প্রাপ্ত গিলগামেশ মহাকাব্যে প্রাপ্ত পৌরাণিক দেবী ki-sikil-lil-la-ke -কে লিলিথের সমতূল্য হিসেবে অনেকে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তবে এ নিয়ে মতভেদ আছে। প্রাচীন ব্যবিলন-কালে একটি উচ্চ রিলিফ (high relief) যুক্ত টেরাকোটা পাওয়া গিয়েছে। এই টেরাকোটার চিত্রটিতে রয়েছে পাখাযুক্ত একটি নগ্ন যুবতী। যুবতী দঁড়িয়ে আছে দুটি সিংহের পিঠে ভর করে। আর এর দুই পাশে রয়েছে দুটি প্যাঁচা। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত এই টেরাকোটার বয়স ধরা হয়েছে প্রায় ১৮০০-১৭৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। এই টেরাকোটার নগ্না নারীকে অনেকে লিলিথ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। বর্তমানে ধারণা করা হয়, এটি সুমেরিয়ান প্রণয়, উর্বর্তা, সৌন্দর্য, যুদ্ধ এবং যৌনাকাঙ্ক্ষার দেবী ইনান্না'র ছবি।

ব্যবিলনীয় গ্রন্থে এমনও বলা আছে যে, কোনো পুরুষ যদি একা রাতে ঘুমায়, তাহলে সে লিলিথের ফাঁদে পড়তে পারে! বলা হতো পুরুষের সাথে মিলিত হবার মাধ্যমে লিলিথ আরো শয়তানের জন্ম দেয়। সিরিয়ায় একটি প্রস্তর খণ্ডে পাওয়া যায় লিলিথের অশুভ প্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রচিত মন্ত্র। যাতে লেখা ছিল-  “হে লিলি, হে অন্ধকারের উড়ন্ত প্রতীক, চিরদিনের জন্যে চলে যাও!”

ব্যবিলনীয় তিলমুদে লিলিথের নাম পাওয়া যায়। কিন্তু তিনি যে আদমের স্ত্রী ছিলেন, তার উল্লেখ নেই। ৭০০ থেকে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে 'আলফাবেত অফ সিরাখ' পাণ্ডুলিপিতে লিলিথকে ভিন্নরূপে পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের শুরুতে রয়েছে ২২টি আরমাইক প্রবাদ। এই গ্রন্থেই রয়েছে লিলিথের উপখ্যান।

ইহুদিদের প্রাচীন হিব্রু বাইবেলের ইসাইয়া গ্রন্থের ৩৪.১৪ লিলিথের নাম পাওয়া যায়। এই অংশে রয়েছে-

'And the wild-cats shall meet with the jackals, / And the satyr shall cry to his fellow; / Yea, the nightmonster shall repose there, / And shall find her a place of rest. /

[Hebrew - english/TANAKH/ The Jewish Buble. Varada   Graphics1998]

[এবং বনবিড়ালেরা শৃগালদের সাথে মিলিত হবে। বনদেবতারা তাদের সহকারীদের সক্রন্দনে আহ্বান করবে। হ্যা রাত্রির দানবী এসে এখানে বিশ্রাম নেবে এবং সেখানে সে নিজের আশ্রয়ের জায়গা খুঁজে পাবে।

New American Bible [1986]- -এর ইংরেজি অনুবাদে  nightmonster কে  Lilith  উল্লেখ করা হয়েছে।

34.14 Wildcats shall meet with desert beasts, satyrs shall call to one another; There shall the Lilith repose, and find for herself a place to rest.

কলকাতার জেভিয়ার প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত 'মঙ্গলবার্তা বাইবেলের (প্রাক্তন-সন্ধি/ প্রথমভাগ) বঙ্গানুবাদে লিলিথ নামটি ব্যবহার করা হয়েছে।

'যত বনবিড়াল যত হায়নার সঙ্গে মিলবে সেখানে;/ বুনো ছাগলে ছাগলে চলবে ডাকাডাকি।/লিলিৎ এসে জিরোবে সেখানে, সেখানেই খুঁজে পাবে বিশ্রাম।

বাইবেলের আদি পুস্তকের ১:২৭ থেকে জানা যায় প্রথম নরনারী সৃষ্টির কথা। এখানে বলা হয়েছে- 'ঈশ্বর আপনার প্রতিমূর্তিতে মনুষ্য নির্মাণ করলেন। তাঁকে সৃষ্টি করলেন ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে, নারী ও পুরুষ হিসেবে'। এই নরনারী তৈরি হয়েছিল মাটি থেকে। কিন্তু এই গ্রন্থের ২:১৮-তে উল্লেখ পাওয়া যায় একটি পৃথক নারীর কথা। এখানে বলা হয়েছে- 'নিঃসঙ্গ আদমের জন্য একটি নারী তৈরি করা হয়েছে, তাঁরই পাঁজর থেকে। এই নারীর নাম ইভ'।

আদি পুস্তকের এই দুটি সূত্র থেকে অনুমান করা যায়, মাটি থেকে সৃষ্ট প্রথম নারীর সাথে আদমের বিচ্ছেদ হয়েছিল। এই কারণে নিঃসঙ্গ আদমের জন্য ইভকে সৃষ্টি করা হয়েছিল, তাঁরই পাঁজর থেকে। মূলত প্রথম নারী আদমকে ছেড়ে গিয়েছিলেন, কিম্বা ঈশ্বর তাঁকে বিতারিত করেছিলেন। এ বিষয়ে আদি পুস্তকের রাব্বাহতে এ বিষয়ে একটি উপাখ্যান আছে। খ্রিষ্টীয় ৯ম-১০ম শতাব্দীর দিকে ‘এলফাবেট অফ বেন সিরা’-তে এ বিষয়ে বিস্তারিত পাওয়া যায়।

লিলিথের যাদুকরী প্রতীক

এই কাহিনি মতে- ঈশ্বর প্রথম নরনারী সৃষ্টি করেছিলেন মাটি থেকে। ফলে উভয়ই পরিপূর্ণ স্বাধীন ছিলেন। এই প্রথম নরের নাম আদম এবং প্রথম নারীর নাম লিলিথ। লিলিথ ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত, আত্মসম্মানবোধে পরিপূর্ণ এক নারী। তাই আদমের আধিপত্য মেনে নিতে পারেন নি লিলিথ। সকল ক্ষেত্রে তিনি নিজেকে আদমের সমকক্ষ হিসেবে বিবেচনা করতেন। উভয়ের ভিতরে সকল ধরনের সমকক্ষতার উল্লেখ এই গ্রন্থে নেই। গ্রন্থটিতে উদাহরণ হিসেবে পাওয়া সঙ্গমের অধিকারের বিষয়ে। সঙ্গমের সময় আদম লিলিথের উপরে উঠে অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে, এটা লিলিথ মেনে নিলেন না। তিনি বললনে, আদমের দেহের উপরে উঠে তিনি ভোগ করবেন। এই দ্বন্দ্বের সুরাহা না হওয়ায় লিলিথ স্বরগ ত্যাগ করে আদমকে ছেড়ে মর্তে নেমে আসে।

লিলিথের ব্যবহারে নাখোশ এডাম যায় স্রষ্টার কাছে, অভিযোগ করে লিলিথের বিরুদ্ধে। এমন সঙ্গিনী তাকে কেন দেওয়া হলো যে তার কথা শোনে না? যে পালিয়ে গেল তাকে ছেড়ে? লিলিথের উপর বিরক্ত স্রষ্টা তার তিন ফেরেশতা পাঠায় লিলিথকে খুঁজে বের করতে। এই তিন ফেরেশতা হলো ‘সেনয়’, ‘সেনসেনয়’ এবং ‘সেমানগেলফ’ (যাদের নাম পরবর্তীতে তাবিজে লিখে বাঁধা হত নবজাত শিশুদের গলায়, কল্পিত লিলিথের কবল থেকে তাদের রক্ষা করতে)। ফেরেশতারা স্রষ্টার বার্তা নিয়ে যায় লিলিথের জন্য। যদি সে ফিরে আসে, মেনে নেয় এডামের কর্তৃত্ব, তাহলে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হবে। আর যদি সে প্রত্যাখ্যান করে, তাকে সম্মুখীন হতে হবে শাস্তির। প্রতিদিন তাকে প্রত্যক্ষ করতে হবে তার ১০০ সন্তানের মৃত্যু!

ফেরেশতারা লিলিথকে মিশরের এক সমুদ্র তীরে খুঁজে পায়। তাদের সাথে ফিরে যেতে বলে তাকে। কিন্তু লিলিথ বলে সে আর ফিরে যাবে না। এরপর তাকে শোনানো হয় ফিরে না যাওয়ার শাস্তি। লিলিথ বলে,

“My friends, I know God only created me to weaken infants when they are eight days old. From the day a child is born until the eighth day, I have dominion over the child, and from the eighth day onward I have no dominion over him if he is a boy, but if a girl, I rule over her twelve days.” (আমি জানি ঈশ্বর আমাকে তৈরী করেছেন কেবলই নবজাতকের প্রতি দূর্বল করার জন্য। তাও আমার অধিকার বজায় থাকবে কেবল আটদিন যদি শিশুপুত্র হয় আর কন্যাশিশুর ক্ষেত্রে তা বারোদিন।)

লিলিথের বিশ্বাস ছিল ঈশ্বর এডামের পক্ষ নেবেন, যেহেতু লিলিথকে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন এডামকে সঙ্গ দেয়ার জন্য। শেষ পর্যন্ত শাস্তি মাথা পেতে নিয়ে স্বর্গ ত্যাগ করে লিলিথ এবং সেই সাথে অভিশপ্ত হয়ে যায়


https://www.ancient.eu/babylon/