আল্-কায়দা
আরবি
মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক সুন্নি মুসলামানদের নিয়ন্ত্রিত একটি সশস্ত্র সংগঠন। ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ওসামা বিন লাদেন, এবং আব্দুল্লাহ ইউসুফ আজ্জম এই সংগঠনটি গড়ে তোলেন।
১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে
আফগানিস্তানে সোভিয়েত রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর অধিকারভুক্ত হয়। এই বাহিনী এবং
আফগানিস্তানের সেনাবাহিনী আফগানিস্তানে সমাজাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার
প্রচেষ্টা চালায়। এই সময় আফগানিস্তানের কট্টর ইসলামী গোষ্ঠীগুলো একটি সশস্ত্র সংগঠন
গড়ে তোলে। এই সংগঠনটি সাধারণভাবে 'আফগান মুজাহিদ' নামে পরিচিত লাভ করে। এই
মুজাহিদদের সাহায্যের জন্য, প্যালিষ্টাইনের বিশিষ্ট সংগঠক
আব্দুল্লাহ ইউসুফ আজ্জম একটি অর্থ-ভাণ্ডার গড়ে তোলেন।
এরপর ধীরে ধীরে এঁরা একটি সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তোলেন। এই সময় আফগান মুজাহিদের
সাহায্যের জন্য,
ওসামা বিন লাদেন আফগানিস্তানে আসেন। এখানে থাকার
সময়, আব্দুল্লাহ ইউসুফ আজ্জম -এর অনুপ্রেরণায়
ওসামা বিন লাদেন বিশ্বব্যাপী ইসলামী সশস্ত্র জঙ্গী
আক্রমণের উপযোগী সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন।
১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে আব্দুল্লাহ ইউসুফ আজ্জম,
ওসামা বিন লাদেন এবং আজমান আল্-জাওয়ারি একটি
শক্তিশালী অর্থ-ভাণ্ডার গড়ে তোলার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন 'মকতব আল্-খিদমত'। এর
আন্তর্জাতিক নাম 'MAK
(Maktab al-Khidamat)'।
বাংলায় মাক উচ্চারণ করা হয়। মাক প্রাথমিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যে ও ইউরোপ-আমেরিকার মুসলিম
প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের অনুদানের দ্বারা অর্থ সংগ্রহ করে।
১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে আব্দুল্লাহ ইউসুফ আজ্জম, অর্থ সংগ্রহের জন্য মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রে ব্রুকলিনের ফারুক মসজিদের 'আল কাফি রিফুজি সেন্টারে যান
এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করতে সংক্ষম হন। সেখানে তিনি মার্কিন এফবিআই
এবং মিশরের ইসলামিক জিহাদের দ্বৈত-চর আলী মোহম্মদের সাক্ষাৎ পান। প্রাথমিকভাবে এর ১
কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করে ১০০ সশস্ত্র মুজাহিদ দল গঠন করে। এই সময়
সোভিয়েত বিরোধী শিবির হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
মাককে এই বাহিনী
তৈরিতে পূর্ণ সমর্থন ও
সহযোগিতা দান করে।
এই সূত্রে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ আফগান মুজাহিদ-দের
সাহায্যের জন্য অপারেশন সাইক্লোন (Operation
Cyclone
) নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। এই প্রকল্পের অধীনে সিআইএ পাকিস্তানের
মাধ্যমে আফগান মুজাহিদের বিপুল
পরিমাণ অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করে। এই সময়ের আফগানিস্তানের হেজাব-ই-ইসলাম নামক দলের
প্রধান হিসেবে গুলবদন হেকমতিয়ার এই সাহায্য গ্রহণ করেন।
১৯৮৭
খ্রিষ্টাব্দে আব্দুল্লাহ ইউসুফ আজ্জম
এবং লাদেন আফগানিস্তানে একটি ঘাঁটি স্থাপন করেন। মাক-এর মাধ্যমে
অর্থ এবং মুজাহিদ তৈরি হলেও সোভিয়েত বিরোধী যুদ্ধে এরা অনেকটাই নিষ্ক্রিয় ছিল। মূলত
আফগানিস্তানের প্রায় ২,৫০,০০০ স্থানীয় মুজাহিদরা যুদ্ধ করেছে। এই সময় এক সাথে ২,০০০
বেশি বিদেশী মুজাহিদদের যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা যায় নি। উল্লেখ্য প্রায় ৩৫টি দেশ থেকে
আগত বিদেশী মুজাহিদদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৫ হাজার।
১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই
আগষ্ট,
আব্দুল্লাহ ইউসুফ আজ্জম,
ওসামা বিন লাদেন এবং আজমান আল্-জাওয়ারি একটি আলোচনা
সভায় বসেন। এই সময় এঁরা সোভিয়েত বাহিনী মুক্ত আফগানিস্তানে এবং বিশ্বব্যাপী কি
কার্যক্রম গ্রহণ করা উচিৎ, সে বিষয়ে আলোচনা করেন। ২০শে আগষ্ট লাদেন
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেতার সাথে আলোচনা করেন এবং এই আলোচনার মধ্য দিয়ে,
'আল্-কায়দা' আনুষ্ঠানিকভাবে সাংগঠনিক রূপ লাভ করতে শুরু করে।
১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত বাহিনী
চলে গেলে, আব্দুল্লাহ ইউসুফ আজ্জম-এর
অনুগত বাহিনী এবং আজমান আল্-জাওয়ারি'র মিশরের ইসলামিক জিহাদ দল একীভূত হয়। এই সময়
এরাই মাকের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। আল্-জাওয়ারি মাকের অর্থভাণ্ডার বৃদ্ধি করার
পাশাপাশি আফগানিস্তানে বিশুদ্ধ ইসলামিক রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করতে থাকেন। এছাড়া
বিশ্বব্যাপী তাদের জঙ্গী কার্যক্রম সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেন। লাদেন জাওয়ারির এই
মনোভাবকে সমর্থন করেন।
আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত বাহিনী চলে যাওয়ার পর, মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে নিজেদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে এবং আফগান
মুজাহিদদের দাবিগুলো অগ্রাহ্য করা শুরু করে। ফলে
আব্দুল্লাহ ইউসুফ আজ্জম এবং
ওসামা বিন লাদেন মাক-এর কার্যক্রমে পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নেয়। এই সূত্রে
আল্-কায়দা আরও শক্তিশালী সংগঠনে রূপ লাভ করে।
এই সময় লাদেনের সাথে গুলবদন হেকমতিয়ার-এর সাথেও গভীর সম্পর্ক গড়ে
উঠে।
১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ নভেম্বর পাকিস্তানের পেশোয়ারে গাড়ি-বোমা হামলায়
আব্দুল্লাহ ইউসুফ আজ্জম নিহত হলে, এই সংগঠনের
একক পরিচালকে আসনে বসেন
ওসামা বিন লাদেন এবং মাক-এর দায়িত্ব নেন। এরপর তিনি আলকায়দা প্রধান হিসেবে সৌদি
আরবে ফিরে আসেন।
১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের ২রা আগষ্ট মাসে ইরাক কুয়েত আক্রমণ করে।
ইরাকের সুসজ্জিত শক্তিশালী সেনাবাহিনীর আগ্রাসনের ফলে সৌদি আরব বিপন্ন হয়ে পড়ে। এই
অবস্থায়
ওসামা বিন লাদেন সৌদি আরবের রাজা ফাহাদকে জানায় যে, প্রয়োজন হলে তাঁর মুজাহিদিন
বাহিনী নিয়ে সৌদি আরবের পাশে দাঁড়াতে পারে। সৌদি রাজা এই প্রস্তাব প্রত্যখ্যান করে,
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য কামনা করে। এবং এই সূত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং
তার মিত্রদের নিয়ে গঠিত সেনাবাহিনী সৌদি আরবে অবস্থান নেয়। এই অবস্থায়
ওসামা বিন লাদেন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। বিশেষ করে অমুসলিম বাহিনীর দ্বারা মক্কা ও
মদিনা অপবিত্র হবে বলে, সৌদি আরবের বিরুদ্ধে জনসমক্ষে প্রচারণা চালানো শুরু করে।
ফলে সৌদি সরকার তাঁকে বহিস্কার করে।
১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সুদানের মুসলিম ধর্মীয় নেতা হাসান আবদ আলাহ আল-তুরাবির
আমন্ত্রণে লাদেন সুদানে চলে যান। এই সময় সুদানের ক্ষমতায় ছিলেন ওমর আল বশির।
উল্লেখ্য, ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ওমর আল বশির সুদানের প্রধান মন্ত্রী সাদিক আল মাহাদিকে
অপসারিত করে, সুদানে সামরিক সরকার গঠন করেছিলেন। ওমর আল বশির ক্ষমতায় বসে ইসলামী
রাজনৈতিক দর্শন কায়েম করার অঙ্গীকার করেছিলেন। লাদেন
সুদানে পৌঁছার পর
ওমর আল বশিরকে রাষ্ট্র পরিচালনায় বিভিন্নভাবে
সাহায্য করতে থাকেন। এই সূত্রে লাদেন
সুদানে বড় ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ পান। সুদানে থাকাবস্থায় তিনি
সশস্ত্র আক্রমণ চালানোর উপযোগী সদস্য তৈরির জন্য সামরিক শিবির স্থাপন করেন।
১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ইসরায়েল এবং প্যালেষ্টাইনের ভিতরে শান্তিচুক্তি ( Oslo
Accords)
স্বাক্ষরিত হলে, সৌদি আরব এই চুক্তিকে সমর্থন করে। এই কারণে লাদেন
সৌদি আরবের উপর দ্বিতীয় বার ক্ষুব্ধ হন। এই বছরে আল্-কায়দা ইয়েমেনের এডেন বন্দরের
একটি হোটেলে মার্কিন ভ্রমণকারীদের উপর বোমা হামলা করে। একই কায়দায় সোমালিয়ার
মোগাদিসুতে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় এবং ১৮জন মার্কিন নাগরিক প্রাণ হারায়। এই বছরে
নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে যে আক্রমণ হয়, তার সাথে আল্-কায়দা জড়িত ছিল বলে
ধারণ করা হয়।
এই সময় আল্-কায়দার মূল বাহিনী পরিচালনা করছিলেন
আজমান আল্-জাওয়ারি। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে
মিশরের প্রধান মন্ত্রী আতেফ সেদিকি-কে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন জাওয়ারি। এই
প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় এবং ঘটনাস্থলে একজন স্কুল ছাত্রী নিহত হয়। এর ফলে
মিশরে সাধারণ মানুষ জাওয়ারি পরিচালিত ইসলামি
সংগঠনের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। এই সময় পুলিশ তাঁর দলের ২৮০ জনকে গ্রেফতার করে এবং ৬
জনকে দেশ থেকে বহিস্কার করে।
এই সময় লাদেন সুদানে থেকে সৌদি রাজা ফাহাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে থাকেন। ১৯৯৪
খ্রিষ্টাব্দের ৫ মার্চ, সৌদি আরব লাদেনের নাগরিকত্ব বাতিল করেন। লাদেনের পরিবার
লাদেনের বাৎসরিক ৭০ লক্ষ মার্কিন ডলারের পাবিরবারিক ভাতা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়
এবং তাঁর পরিবার-পরিজন প্রকাশ্যে লাদেনের কার্যকলাপে ধিক্কার দেয়।
১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে আল্-কায়দা মিশরে প্রেসিডেন্ট মুবারককে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ
হয়। রিয়াদে ন্যাশনাল গার্ড ট্রেনিং সেন্টারে বোমা হামলা করে।
১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে আল্-কায়দা সৌদি আরবের দাহরানের খোবার টাওয়ারে মার্কিন সামারিক
আবাসিক এলাকায় আক্রমণ চালয়। এই সময় লাদেন বিশ্ব-ব্যাপী কুখ্যাত সন্ত্রাসী হিসেবে
চিহ্নিত হয়। সুদান সরকারের অসহযোগিতার কারণে এই বছরেই লাদেন আফগানিস্তানে চলে আসেন।
১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ৭ আগষ্ট, কেনিয়ার নাইরোবিতে অবস্থিত মার্কিন
দূতাবাসে আল্-কায়দার বোমা হামলায় ২১৩জন নিহত হন এবং আহত হন প্রায় ৪,৫০০। একই দিনে
তাঞ্জানিয়ার দারেস-সালাম- আরও একটি বোমা হামলা হয়। এই হামলায় নিহত হন ১১ জন এবং আহত
হন প্রায় ৪৫ জন।
২০০০ খ্রিষ্টাব্দে ১২ই অক্টোবর, ইয়েমেন উপকূলে অবস্থিত মার্কিন ডেস্ট্রয়ারে
বিস্ফোরক ভর্তি আল্-কায়দার একটি ছোটো নৌযান আঘাত হানে। এর ফলে ১২জন মার্কিন সৈন্য
নিহত হন এবং আহত হন প্রায় ৩৮জন।
২০০১ খ্রিষ্টাব্দে
আল্-কায়দা সবচেয়ে বড় ধরনের আক্রমণ চালায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত ওয়ার্ল্ড
ট্রেড সেন্টার এবং পেন্টাগনে।
২০০২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জানুয়ারিতে আলজাজিরা টেলিভশনে বক্তৃতা
করেন।
আল্-কায়দার এই আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লাদেনকে ধরার জন্য
সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করেও, ২০১০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। অবশেষে ২০১০
খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা জানতে পারে যে, লাদেন
পাকিস্তানের
রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে ৩৫
কিলোমিটার দূরে আযবোটাবাদ শহরে অবস্থান করছেন। সিআইএ সন্ধানী ড্রোন বিমানের
সাহায্যে মার্কিন সৈন্যরা এই
লাদেনের অবস্থানের
শনাক্ত করে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ২রা মে
দিবাগত
রাতে পাকিস্তানের আযবোটাবাদ শহরে মার্কিন নৌ-কমান্ডোদের হামলায় ওসামা
বিন লাদেন নিহত হন। এরপর অস্থায়ী পরিচলাকের দায়িত্ব নেন সাইফ আল্-আদেল। ২০১৬
খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই জুন, আল্-কায়দার
পূর্ণ দায়িত্ব নেন, দলের উপ-প্রধান আজমান আল-জাওয়ারি।